• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
বজ্র আঁটুনি যেন ফসকা গেরো না হয়

আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বিশেষ নিবন্ধ

বজ্র আঁটুনি যেন ফসকা গেরো না হয়

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৯

তিলোত্তমা ঢাকা প্রসারিত হচ্ছে সব দিক দিয়ে। সুউচ্চ ভবনগুলো আকাশ স্পর্শ করতে চাইছে। আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। সুরম্য ইমারতগুলো সদম্ভে ঘোষণা করে চলেছে বাঙালির শৃঙ্গজয়ের বার্তা। আমরা আধুনিক হচ্ছি, উন্নত হচ্ছি। অন্যদিকে বাড়ছে মানুষ। প্রসারিত হচ্ছে নগরকেন্দ্রিক বাণিজ্যের দিগন্ত। পুরনো দিনের ঘিঞ্জি কাঁচাবাজারগুলো তো ছিলই এবং এখনো আছে। সময়ের ব্যবধানে সেই বাজারগুলো আরো অনেক বেশি জনাকীর্ণ ও ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি নতুন নতুন বহুতল শপিং মল হচ্ছে। পুরান ঢাকাও বদলে যেতে চাইছে। তারপরও, চোখ জুড়ানো, আলো ঝলমলে এই নাগরিক পসার ও ঊর্ধ্বমুখিনতার মধ্যে, সদা শঙ্কিত জীবন এই নগরবাসীর। মনুষ্যসৃষ্ট গোপন আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের ওপর যেন আমরা বসে আছি। কখন কোন অসতর্ক মুহূর্তে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে, তার কোনো ঠিক নেই। বিষাক্ত ধূম্রকুণ্ডলী কেন কুক্ষণে শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়, তাও জানা নেই। একটু আগেও যারা ছিলেন কর্মচঞ্চল, চোখের পলকে বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন। আকাশছোঁয়া দৃশ্যত নান্দনিক ভবনের ফ্লোরগুলো পরিণত হয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে। সর্বসংহারী উত্তপ্ত আগুন এবং ধোঁয়ার মধ্যে বিপন্ন মানুষ ভয়ানক নারকীয় যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুদূতকে দেখেন, কিন্তু পালানোর পথ খুঁজে পানে না। বাঁচার জন্য তাদের প্রাণান্তকর আকুতি কোনো কাজে আসে না। বিপন্ন মানুষের কেউ মরেন জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে, কেউ কেউ জীবনপাত করেন সুউচ্চ ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে। অকল্পনীয় ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার আগে বিপদাপন্ন মানুষের কাছে কার্যত কোনো সাহায্যও পৌঁছাতে পারে না। যারা সাহায্য করতে ছুটে যান, তারাও অপারক হয়ে পড়েন। হয় অকুস্থলে পৌঁছাবার উপযুক্ত রাস্তা নেই, নয়তো অভাব প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের। ঠিক এই রূপই তো আমরা দেখলাম পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায়, অভিজাত এলাকার এফআর টাওয়ারে। চুড়িহাট্টায় শত শত মানুষের পোড়া গন্ধ মুছে যাওয়ার আগেই, স্বজনহারা মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ-আহাজারি থেমে যাওয়ার আগেই আমরা দেখলাম এফআর টাওয়ারে মানবিক বিপর্যয়। দেখলাম মনুষ্যসৃষ্ট আগুনের অপ্রতিরোধ্য ছোবল। দেখলাম জীবনের পরাজয়, অসহায়ত্ব আর জীবন বাঁচানোর অক্ষমতা। নিদারুণ অভিজ্ঞতা হলো, কিন্তু তা থেকে মনে হয় কেউ কিছু শিখলাম না।

একের পর ঘটে যাচ্ছে এ ধরনের মানবিক বিপর্যয়। প্রতিবছর কেবল এই ঢাকা ও তার সন্নিহিত শহর-উপশহরগুলোতে রাক্ষুসে অগুন কত মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, কত পরিবার পথে বসছে, প্রকৃত প্রস্তাবে তার কোনো লেখাজোখা নেই। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর মনে হয়েছিল যে, এর আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। শাসন-প্রশাসন এবং দায়িত্বশীল যারা, ভেবে ছিলাম তারা সাবধান হবেন, তাদের ঘুম ভেঙেছে। কেমিক্যাল গুদামগুলো অবিলম্বে সরিয়ে নেওয়া হবে ঘিঞ্জি পুরান ঢাকা থেকে, অন্য কোনো নিরাপদ প্রশস্ত জায়গায়। তখন অনেক দামি ও কড়া নীতি-পরিকল্পনার কথাও আমাদের শোনানো হয়েছে। কিন্তু হা-হতস্মি। কিন্তু সব কথা, সব পরিকল্পনা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। চুড়িহাট্টার মানবিক বিপর্যয়, সেটাই আমাদের দেখিয়ে দিল চোখে আঙুল দিয়ে। তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু কেমিক্যাল গুদামের মালিকদের নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। চুড়িহাট্টা ট্র্যাজেডির পর মানুষ পোড়া উৎকট গন্ধ বাতাসে মিলিয়ে যায়নি, স্বজনহারা শোকার্ত পরিজনের বুকফাটা আহাজারি থামেনি এখনো, তারই আগে ঘটে গেল এফআর টাওয়ারের মানবিক বিপর্যয়। সর্বনাশা এই বিপর্যয়ের পর একাধিক তদন্ত কমিটি হয়েছে। টক শোগুলোয় নানা কথা বলছেন চিন্তাশীল টকারগণ। তদন্ত কমিটি সমস্যার মূল খুঁজছেন, বিশেষজ্ঞরা তালাশ করে চলেছেন সমাধান সূত্র। রিপোর্টাররা ছুটছেন সেইসব দামি সূত্র ও চিন্তার পেছনে। প্রশ্ন উঠেছে, আঠারো তলার অনুমোদন নিয়ে কী করে ভবনটিকে একুশ তলা করা হলো? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও এ প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, রাজউক কেন এ ধরনের অনুমোদন দেয়। এদিকে তদন্ত কমিটি নাকি ভবনের বর্ধিত অংশ অনুমোদন দেওয়ার ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না। ওগুলো নাকি গায়েব হয়ে গেছে। এ তো দেখি জুয়েল আইচের ম্যাজিক, ভানুমতির খেল। আছে জিনিস নেই হয়ে গেছে। রাজউকের কে বা কারা এই অন্যায় অনুমোদন দিয়েছে, তার কূলকিনারা খুঁজে পাওয়া বুঝিবা কঠিন হয়ে পড়েছে। বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ছিল না। বিপদাপন্ন মানুষ যে দ্রুত বেরিয়ে আসবেন, তারও পথ ছিল না। বহুতল ভবনে সেফ স্পেস থাকার কথা, তাও ছিল না। আগুনের ধোঁয়া বেরিয়ে আসবে তারও কোনো পথ ছিল না। যারা এই উঁচু সুরম্য ভবন বানান, নকশা করেন জানালা জিনিসটা মনে হয় তাদের খুব অপছন্দ। তারা সৌন্দর্য এবং কৃত্রিম আরামের পূজারি। এটাই আভিজাত্য এবং তথাকথিত নান্দনিকতা। ওই ভবনের এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে যাওয়ার সিঁড়িও নাকি অনেক জায়গায় কলাপসিবল গেট দিয়ে তালা লাগানো ছিল। ইন্টেরিয়র ডেকোরেটররা দাহ্য বস্তু দিয়ে ভেতরে চোখ জুড়ানো শিল্পিত সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছিলেন। রাক্ষুসে আগুন কিংবা অন্য কোনো দুর্যোগ নেমে এলে মানুষের জীবনের কী হবে, সে চিন্তা তাদের মাথায় ছিল না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি স্কাইক্র্যাপার ঠিক এভাবেই তৈরি হয়েছে। ভেতরের অবস্থা কমবেশি একই রকম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার বৈঠকে আগুনের বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পনেরোটি দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই নির্দেশনাগুলো মান্য করা হলে, আগুনের ঝুঁকি বহুলাংশে কমে আসবে। বিপর্যয় এলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নিশ্চিতভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তারপরও মনে প্রশ্ন, এই দিকনির্দেশনাগুলো খোদ প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয় কেন! পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে পরে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। আগুন এবং অন্যান্য দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। বিভাগ রয়েছে। শত শত পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা, গাড়ি-বাড়ি দেওয়া হয়। তারা যাতে ভালো থাকেন, তার জন্য সরকার একের পর এক সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে চলেছে। কাজেই নিরাপদ জীবনের এই নীতি-নির্দেশনা তো তাদের মাথা থেকেই আসার কথা। তাদেরই এই কাজগুলো করার কথা। কিন্তু তারা কোথায়। রাজউকের স্থপতি-বিশেষজ্ঞরা কোথায়! পরিবেশ দফতরের দেশে বিদেশে প্রশিক্ষণ-সেমিনার ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করা অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ অফিসাররা কোথায়, তারা কী করেন? নগর পরিকল্পনাবিদরা কোথায়, যারা এসব ভবনের অনুমোদন দেন, তারা কোথায়! তাদের কাজ কি শুধু মহার্ঘ ঘুষ খেয়ে মৃত্যুফাঁদের অনুমোদন অথবা দেখেও না দেখার ভান করা! আর জনগণের টাকায় অতি উন্নত জীবন যাপন করা! এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে! ফায়ার সার্ভিসের দক্ষ কর্মী আছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নেই। আগুন লাগলে লাফিয়ে পড়া মানুষকে বাঁচানোর জন্য সেফটি নেট নেই, সুউচ্চ ভবনের শীর্ষে পৌঁছার মতো প্রয়োজনীয় মই নেই। অনেক জায়গায় পানির সংস্থান নেই, আগুন লাগলে অথবা ভূমিকম্প বা অন্য কোনো দুর্যোগে বিপদাপন্ন মানুষকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত যে সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারযান পৌঁছাবে, তার রাস্তা নেই। সরু গলিতে দমকলের গাড়ি প্রবেশ করে না। এসবই কি একা প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হবে! যদি সব প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কী প্রয়োজন! তারা বাড়ি চলে গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোলেই পারেন।

পত্রিকায় রিপোর্ট হচ্ছে, রাজধানীতে বাংলাবাজার, গাউসিয়াসহ বহু কাঁচাবাজার রয়েছে যেগুলেতে যখন-তখন মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, আগুন লাগতে পারে, ঘিঞ্জি এসব বাজারে আগুন লাগলে পদপিষ্ট হয়ে বহু মানুষের জীবনহানির আশঙ্কা। ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও পৌঁছাতে পারবে না। এই শহরে অসংখ্য ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে। ভূমিকম্প আঘাত হানলেও এসব ভবন মৃত্যুকূপে পরিণত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা। সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কি এসব দেখেন না! জানে না! পত্রিকার রিপোর্টও কি তারা পড়েন না।

একেকটা করে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে আর কর্তৃপক্ষ ঘুম থেকে কিছুক্ষণ বা কিছুদিনের জন্য জেগে ওঠে, হম্বিতম্বি করে, তদন্ত করা হয়, দু-একজনকে ধরে খবর তৈরি করা হয়। আর এই করা হবে, সেই করা হবে, দোষীদের ছাড়া হবে না— এই ধরনের কঠিন কঠিন কথা বলা হয়। কোনো একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি ঘটার সঙ্গে সঙ্গেই সব মহল তৎপর হয়ে ওঠে। মানুষের অকাল মৃত্যুতে যখন চারদিকে হাহাকার পড়ে যায়, তখন মানুষের শোককে আপাত নিরসনের লক্ষ্যে অসংখ্য কমিটি ঘোষণা করা হয়। অসংখ্য তদন্ত দল ছোটাছুটি শুরু করে, হাঁকডাক ছাড়ে। তারপর মানুষের মাতম, শোক যখন আস্তে আস্তে প্রশমিত হতে থাকে তদন্ত কমিটিগুলোর হাঁকডাকও স্তিমিত হয়ে আসে। আবার তদন্ত কমিটির সম্পর্কেও মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা কাজ করে। ‘ওলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই’— এ ধরনের চিন্তাভাবনাও সমাজে বিরাজমান। একটি ট্র্যাজেডি ঘটলেই তাকে উপলক্ষ করে শুরু হয় হরেক রকমের আখের গোছানোর পালা। তারপর দেখা যায়, তদন্ত কমিটির আর কোনো খবর নেই, কী তাদের রিপোর্ট কেউ জানে না। রিপোর্টের মূল্যায়ন কী, তার ভিত্তিতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে— সবকিছুই থেকে যায় ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা অন্ধকারে। এবারে আশার কথা পর পর কয়েকটি বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটার পরে রাজউকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নড়েচড়ে বসেছে। ব্যাপকভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে বিভিন্ন অনিয়মের। নতুন গণপূর্ত ও গৃহায়নমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ঘোষণা দিয়েছেন, এবারের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট শুধু প্রকাশ করাই হবে না, পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জাতিকে জানানো হবে কোন ‘মহান ব্যক্তিরা’ কী পরিমাণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। এমনকি রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যেসব কর্মকর্তা বিভিন্ন অনিয়ম ও বেআইনি কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছেন তাদের নামধামও ছাপানো হবে, তাদেরও কঠিন বিচারের আওতায় আনা হবে। আমার ঠিক এটাই চাই। কোনোমতেই যেন বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো-তে পরিণত না হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মরছে, সে সমস্যার সমাধানেও একই ব্যাপার ঘটে চলেছে। সেখানেও আমরা ফসকা গেরো। এভাবে তো চলতে পারে না। এর অবসান চাই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads