• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
ঢাকার সামনে ‘ব্যর্থ মহানগরীর’ পরিণতি

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ঢাকার সামনে ‘ব্যর্থ মহানগরীর’ পরিণতি

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৭ এপ্রিল ২০১৯

জনগণের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ, নতুন বছর ১৪২৬ সালের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে এবার ঝড় দূরে থাকুক, রাজধানী ঢাকায় সামান্য বৃষ্টিও হয়নি। অথচ আশঙ্কা করা হয়েছিল, ঝড়-বৃষ্টিতে দিনটি ‘মাটি’ হয়ে যাবে। নষ্ট হয়ে যাবে উৎসবের আনন্দ। অমন আশঙ্কা কিন্তু এমনি এমনি করা হয়নি। পহেলা বৈশাখের পূর্ববর্তী কয়েকটি দিনের কথা স্মরণ করে দেখুন। ৯ এপ্রিল মাত্র ঘণ্টাখানেকের বৃষ্টিতেই রাজধানী ঢাকা পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল। আগের দিন ৮ এপ্রিল সোমবারও রাজধানীবাসীকে একই পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। অথচ পরিমাণের দিক থেকে বৃষ্টি কিন্তু বেশি হয়নি। আবহাওয়া বিভাগের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, ৮ এপ্রিল বৃষ্টি হয়েছিল মাত্র ৪৮ মিলি লিটার।

দুই দফায় হলেও ৯ এপ্রিলও এত বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয়নি, যার ফলে পুরো রাজধানীই তলিয়ে যাবে। অন্যদিকে সেটাই ঘটেছিল। এমন কোনো এলাকার নাম বলা যাবে না, যেখানে হাঁটু পর্যন্ত শুধু নয়, কোমর পর্যন্তও পানি না জমেছিল। ফলে প্রাইভেট কার ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা তো বটেই, বাস ও ট্রাকের মতো বড় বড় যানবাহনও স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেনি। বহু এলাকায় উল্টে গেছে যাত্রীসহ অসংখ্য রিকশা। মিরপুর ও শেওড়াপাড়ার মতো বেশ কিছু এলাকায় কোনো যানবাহনই দেখা যায়নি। রামপুরা, বাসাবো, ধানমন্ডি, গুলিস্তান, মিরপুর, সদরঘাট, বংশালসহ কোনো কোনো এলাকার প্রধান সড়কগুলোতে এমনকি হাঁটু পর্যন্ত পানি জমেছিল। অনেক এলাকায় সৃষ্টি হয়েছিল জলাবদ্ধতার। ফলে অফিসগামী চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও বিপদে পড়েছিল। যানবাহনের অভাব তো ছিলই, সেই সঙ্গে সিএনজি ও রিকশাচালকরাও পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তাদের ভাড়া অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। চালকদের অনেকে কম দূরত্বের গন্তব্যেও যেতে রাজি হয়নি। সে কারণে মানুষকে বৃষ্টির পানিতে ভিজতে এবং বহু সময় ধরে হাঁটতে হয়েছে। যাতায়াতের ক্ষেত্রে বেশি বিপদে পড়েছিল ছোট ছোট শিক্ষার্থী এবং তাদের মা ও অভিভাবকরা। মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তিও সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

পরদিন ১০ এপ্রিলের সব সংবাদপত্রেই এসব দৃশ্যসহ সচিত্র রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে যথারীতি প্রাধান্য পেয়েছে জলাবদ্ধতার বিভিন্ন কারণ। নগরবিদসহ বিশেষজ্ঞরা তাদের মূল কথায় আবারো নদী ও খাল ভরাট করে ফেলার এবং অপরিকল্পিত সুয়ারেজ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের পথ তথা খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টির স্বল্প পরিমাণ পানিও বেরিয়ে যেতে পারছে না। তার ওপর রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চলছে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল চলাচলের জন্য ব্যাপক নির্মাণকাজ।

এসব কারণে একদিকে যেখানে-সেখানে মাটির স্তূপ জমা করা হচ্ছে, অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সব ড্রেন ও ম্যানহোল। পরিণতিও যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় নির্মাণকাজ চলছে সেসব এলাকায় পানি সরে বা বেরিয়ে যেতে পারছে না। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতার— অবিশ্বাস্য পানিজটের। কিন্তু এসব বিষয়ে যাদের নজর দেওয়ার ও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা, সেই ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনসহ কোনো সংস্থাই বড় বড় বাগাড়ম্বর করার বাইরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। শুধু তা-ই নয়, দুই মেয়র এবং কর্তাব্যক্তিরাও বিশেষজ্ঞদের সুরে এমনভাবে খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়ার তথ্য শোনাচ্ছেন, যেন এসব বিষয়ে তাদের করার কিছু নেই! এ অবস্থার সুযোগ নিয়েই রাজধানীর অলি-গলিতে পর্যন্ত এখনো খোঁড়াখুঁড়ি এবং নানারকম স্থাপনা নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে স্বার্থান্বেষীরা। এজন্যই ঘণ্টায় মাত্র ১০ মিলি লিটার বৃষ্টি হলেও তলিয়ে যাচ্ছে পুরো রাজধানী।

বলার অপেক্ষা রাখে না, অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটানো না হলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কারণ এরই মধ্যে ঝড়ের মাস বৈশাখ শুরু হয়েছে। তার পর পর আসবে বৃষ্টি-বাদলের মাস আষাঢ় ও শ্রাবণ। ওদিকে এগিয়ে আসছে পবিত্র মাস রমজান। বড় কথা, দেড় কোটি মানুষের বসবাস যে ঢাকায় তা শুধু বিরাট একটি মহানগরী নয়, বাংলাদেশের রাজধানীও। সে কারণে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে নানা কাজে। রাজধানীবাসীর পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সব মানুষকেও চরম ভোগান্তির কবলে পড়তে হয়। এমন ভয়ঙ্কর অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যই ঘটানো দরকার।

এ প্রসঙ্গে একাধিক ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল প্রকল্পের কথা আগেই বলা হয়েছে। এগুলোর পাশাপাশি রাজধানীর প্রায় সব এলাকারই কোথাও চলছে ভূগর্ভস্থ বিদ্যুৎ, টেলিফোন, গ্যাস ও অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল্ প্রতিস্থাপনের কাজ, কোথাও আবার চলছে ওয়াসার পানি সরবরাহের সংযোগ পাইপ বসানোর কাজ। সবই চলছে কয়েক বছর ধরে। ফলে মানুষের ভোগান্তিরও অবসান ঘটছে না। প্রশ্ন উঠেছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিতেও। কারণ, নগরায়ণের নামে শত শত পুকুর ও খাল ভরাট করা হয়েছে। এসব স্থানে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য বহুতল ভবন ও স্থাপনা। ভবনগুলোর আশপাশে মাটির নিচে প্রাকৃতিক নিয়মে পানি নেমে যাওয়ার মতো যথেষ্ট জায়গা রাখা বা প্রশস্ত ড্রেন তৈরি করা হয়নি। এছাড়া পলিথিনসহ নানা ধরনের আবর্জনা জমে গিয়ে ড্রেনগুলো সংকুচিত হয়ে পড়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, রাজধানীর কোনো এলাকাতেই চারপাশের নদ-নদীতে পানি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা বা ব্যবস্থা নেই।

অথচ নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা এ কথা অতীতেও বহুবার বলেছেন, দখল ও ভরাট করে ফেলা খালগুলোকে উদ্ধার এবং সুয়ারেজ তথা নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নতি ছাড়া রাজধানীকে পানি আবদ্ধতার ভয়াবহ সমস্যা থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়। তথ্যাভিজ্ঞরা জানিয়েছেন, অতীতের প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় সিটি করপোরেশনের আড়াই হাজার কিলোমিটার উন্মুক্ত ড্রেন দিয়ে ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট ও সাড়ে তিনশ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ হয়ে বৃষ্টির সব পানি গিয়ে আশপাশের নদ-নদীতে পড়ার কথা। পানি নিষ্কাশনের এ ব্যাপারে চারটি নদ-নদী এবং ৬৫টি খাল অতীতে বিশেষ ভূমিকা রাখত। সে কারণেই ২০১০ সালে প্রণীত ড্যাপ বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে রাজধানীর পাঁচ হাজার ৪২৩ একর জায়গা বিল-পুকুর, ২০ হাজার ৯৩ একর জায়গা খাল ও নদী এবং ৭৪ হাজার ৫৯৮ একর জায়গা বন্যাপ্রবাহ অঞ্চল হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। কিন্তু দখলদারদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে ২৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নদী ও খালের আয়তন ২০১৪ সালের মধ্যেই কমে মাত্র ১০ দশমিক ২০ বর্গকিলোমিটার হয়ে গেছে। এমন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পানি আবদ্ধতার অশুভ পরিণতি থেকে মুক্তি পেতে হলে নদী ও খালগুলোকে অবশ্যই উদ্ধার করে রাজধানীর অভ্যন্তরে এবং চারপাশে সার্কুলার ওয়াটারওয়ে তৈরি করতে হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। সচেতন মানুষ মাত্রই মনে করেন, সিটি করপোরেশন ও সরকারের উচিত দখল ও ভরাট হয়ে যাওয়া সব খাল ও নদী উদ্ধার করে অবিলম্বে সার্কুলার ওয়াটারওয়ে তৈরি করার কাজ শুরু করা। সরকারকে একই সঙ্গে ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলসহ সব নির্মাণকাজ দ্রুত সমাপ্ত করতে হবে। কোনো স্থাপনার নির্মাণকাজের জন্য রাজধানীর যেখানে-সেখানে ইট-সিমেন্ট ও বালুর মতো সামগ্রীর এবং মাটির স্তূপ জমিয়ে রাখার কার্যক্রম অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দিতে হবে, যাতে সব ড্রেন ও নালা-খন্দক পরিষ্কার করা হয় এবং যাতে কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনার স্তূপ জমতে না পারে। এ কথা বুঝতে হবে যে, সামনের দিনগুলোতে বৃষ্টি যেমন প্রচুর হবে তেমনি এখনই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে রাজধানী আবারো যেকোনো সময় স্থবির হয়ে পড়তে পারে। এজন্যই বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আগেই সরকার তথা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনের উচিত দ্রুত তৎপর হয়ে ওঠা।

বলা দরকার, বিশেষ করে পানিজট ও মানুষের দুর্ভোগের বিষয়কে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যার এই দেশে কয়েক দিনের, এমনকি মাত্র এক দিনের বৃষ্টিতেই পুরো রাজধানী তলিয়ে যাবে, অচল হয়ে পড়বে এবং মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তির শেষ থাকবে না— এমন অবস্থা কল্পনা করা যায় না। কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটেছে। একই কারণে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা এ কথা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, রাজধানী হিসেবে ঢাকা একটি ‘ব্যর্থ মহানগরীর’ অশুভ পরিণতি বরণ করতে চলেছে। এমন আশঙ্কা নিঃসন্দেহে ভীতিকর। আমরা মনে করি, ঢাকাকে যাতে ‘ব্যর্থ মহানগরীর’ পরিণতি বরণ করতে না হয় সে লক্ষ্যেই সরকারের উচিত তৎপর হয়ে ওঠা। এ জন্য খাল ও পুকুর দখল করে ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ প্রতিহত করার পাশাপাশি বাধাহীন পানিপ্রবাহের জন্য রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় যথেষ্ট প্রশস্ত ড্রেন নির্মাণ করতে হবে এবং কোনো ড্রেনেই আবর্জনা জমতে দেওয়া যাবে না। দুই সিটি করপোরেশন এবং ওয়াসা, তিতাস, বিটিসিএলসহ রাস্তা বিভিন্ন নির্মাণ ও খোঁড়াখুঁড়িতে নিয়োজিত সব সংস্থার কাজে অবশ্যই সমন্বয় করতে হবে। সব মিলিয়ে এমন আয়োজন নিশ্চিত করা দরকার, রাজধানী ঢাকা যাতে আর কখনো এবারের তথা ৯ ও ১০ এপ্রিলের মতো বিপর্যস্ত না হয়ে পড়ে এবং ঐতিহাসিক এই মহনগরীকে যাতে ‘ব্যর্থ মহানগরীর’ অশুভ ও ভয়ঙ্কর পরিণতি বরণ করতে না হয়।

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads