• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
নেতৃত্ব খুঁজতে হবে দলের ভেতরেই

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

নেতৃত্ব খুঁজতে হবে দলের ভেতরেই

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০১৯

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যখন  জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দেয়, তখন অনেকেই সেটাকে ‘পলিটিক্যালি ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এতে দলটির লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি হবে- এমন কথাও বলেছিলেন কেউ কেউ। সে সময় বিএনপি নেতাদের একটি অংশ ওই কথার প্রতি কর্ণপাত করেননি। বরং তারা বলছিলেন, সরকারবিরোধী জাতীয় ঐক্যের পথে বিঘ্ন সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই এসব বলা হচ্ছে। কোনো এক অদৃশ্য লাভের আশায় বিএনপি তাদের লালিত নীতি-আদর্শকে একপাশে সরিয়ে রেখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব মেনে ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিল। তারা ভেবেছিল, গণফোরাম নেতা ড. কামাল বুঝি বেগম খালেদা জিয়ার শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবেন। কিন্তু তারা ছিলেন ভ্রান্ত। যদিও বিএনপি নেতাকর্মীদের একটি অংশ ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে অতিমাত্রায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তাদের এ আশাবাদ যে অন্তঃসারশূন্য কল্পনাবিলাস ছাড়া আর কিছুই ছিল না, তা ইতোমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। একই সঙ্গে ঐক্যফ্রন্ট ও ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্ব নিয়ে বিএনপি যে মোহগ্রস্ত ছিল তাও কেটে যেতে শুরু করেছে।

গত ২১ এপ্রিলের বাংলাদেশের খবরে ‘ঐক্যফ্রন্টে বিমুখ বিএনপি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সে কথাই তুলে ধরা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে গড়ে ওঠা ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনকে এখন আর তেমন পাত্তা দিচ্ছে না বিএনপি। দলটির অনীহায় ঝিমিয়ে পড়েছে ফ্রন্টের কার্যক্রম। তবে এখনই ফ্রন্ট ত্যাগ বা বিলুপ্তির কথাও ভাবছেন না তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতায় যাওয়ার আশা নিয়ে ভোটের মাঠে নিয়ামক শক্তি না হওয়া সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের পতাকাতলে শরিক হয়েছিল। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। এমনকি নির্বাচন-পরবর্তী সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্টের কাছ থেকে যে বলিষ্ঠ ভূমিকার আশা তারা করেছিল, সেটাও পূরণ হয়নি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করা ও খালেদা জিয়ার মুক্তিকে বিএনপি সবচেয়ে গুরুত্ব দিলেও ঐক্যফ্রন্ট তাতে সেভাবে সহযোগিতা করেনি। এসব কারণে ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের আগ্রহ-উৎসাহে এখন ভাটার টান চলছে।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগদান বিএনপির সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল বলা যাবে না। দলের একটি অংশ ড. কামাল হোসেনের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার ঘোরবিরোধী ছিলেন। কিন্তু মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের অতি আগ্রহ এবং তারই সমর্থক কিছু নেতার ইচ্ছার কাছে বিরোধীরা পারাভূত হন। ঐক্যফ্রন্ট-বিরোধীদের কথা ছিল- নির্বাচন সামনে রেখে বৃহত্তর ঐক্য হতেই পারে। তবে তা দল বা ২০ দলীয় জোটের স্বকীয়তা বিনষ্ট করে নয়। ঐক্যফ্রন্টের উদ্যোক্তারা বিএনপিকে পূর্বাহ্নেই শর্ত দিয়েছিলেন যে, বিএনপিকে আসতে হলে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। বিএনপি তা-ই করেছে। ঐক্যফ্রন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা ২০ দলীয় জোটকে ফেলে রেখেই ঐক্যফ্রন্টে শামিল হয়। এটা ছিল বিএনপির অবিমৃশ্যকারী একটি সিদ্ধান্ত। যে ক’টি দল ও ব্যক্তি নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে বিএনপিই ছিল সবচেয়ে বড় দল। ঐক্যফ্রন্টের তিনটি দলের একটিরও কোনো সাংগঠনিক ভিত্তি নেই। ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম বড় নেতার ছোট দল, আ স ম রবের জেএসডি একটি দলের ভগ্নাংশ, আর মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য নিবন্ধনবিহীন একটি সংগঠন। এসব সাইনবোর্ডসর্বস্ব দল ও সংগঠনের তুলনায় বিএনপি মহীরুহ। কিন্তু কার্যত দেখা গেল ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়ে বিএনপি তার নিজস্বতা হারালো। রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক শক্তিতে সবচেয়ে বড় হলেও ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের কোনো ভূমিকাই থাকল না। তারা পরিণত হলো ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার’ মার্কা তিনটি সংগঠনের আজ্ঞাবাহী দলে। এটা বিএনপির নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীদের পীড়া দিলেও তাদের করার কিছু ছিল না। কারণ শীর্ষ নেতারা ততক্ষণে চলে গেছেন ড. কামালের পক্ষপুটে।

প্রশ্ন হলো, বিএনপি এখন যেটা উপলব্ধি করছে তখন কেন সেটা করতে পারেনি। এর কারণ হলো, বেগম খালেদা জিয়াবিহীন বিএনপির অবস্থা তখন এতটাই শোচনীয় ছিল যে, তারা সামনে কোনো পথ দেখছিলেন না। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলকে নেতৃত্ব দিতে পারেন এমন একজন পাওয়া যায়নি। মূলত সে অভাব দূর করতেই বিএনপি নেতারা ড. কামালের হাতে বয়াত গ্রহণে সম্মত হন। বিএনপি ড. কামালের পরিচিতিকে ব্যবহার করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চেয়েছে। অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন চেয়েছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি, জিয়া-খালেদার ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও জনপ্রিয়তার ওপর ভর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণের পথ সুগম করতে। বলা যায়, এক্ষেত্রে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট একে অপরের কাঁধে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পথ এতই বন্ধুর ছিল যে, কেউ কাউকে গন্তব্য পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। 

 ড. কামাল হোসেনকে শীর্ষনেতা মেনে বিএনপির ঐক্যফ্রন্টে যোগদানকে অনেকেই ‘জনেশুনে বিষপান’ করার সঙ্গেই তুলনা করেছিলেন। কেননা প্রথম থেকেই ড. কামাল বিএনপির মূল দাবি- বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রতি অনাগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। এমনকি ওই দাবির কথা একবারো উচ্চারণ করেননি তিনি। তেমনি কোনো সভা-সমাবেশেই তিনি উচ্চারণ করেননি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম। বরং বিভিন্ন সময়ে তিনি এমন কিছু মন্তব্য করেছেন, যেগুলো ছিল বিএনপির জন্য বিব্রতকর। তারপরও বিএনপিকে চোখ বুজে সব হজম করতে হয়েছে।

যার ওপর বিএনপি অতিমাত্রায় ভরসা করেছিল, সেই ড. কামাল হোসেনের অতীত রাজনৈতিক ইতিহাস সাফল্যের কোনো বার্তা বহন করে না। একজন আইনজ্ঞ হিসেবে তিনি দেশে-বিদেশে সুপরিচিত সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন রাজনীতিক হিসেবে যেটা থাকা অত্যাবশ্যক, সে জনসম্পৃক্তি তার কখনোই ছিল না। সরাসরি নির্বাচনে তিনি কখনোই নির্বাচিত হতে পারেননি। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেড়ে দেওয়া একটি আসনের উপনির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হতে পেরেছিলেন। এরপর আর কোনো নির্বাচনে তিনি জয়ের মুখ দেখেননি। ১৯৮১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি বিএনপি প্রার্থী বিচারপতি আবদুস সাত্তারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন প্রায় ৮৬ লাখ ভোটের ব্যবধানে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও ঢাকার মিরপুরের আসনে পরাজিত হন বিএনপি প্রার্থী হারুন মোল্লার কাছে। নির্বাচনে ধারাবাহিক পরাজয়ের রেকর্ডধারী ড. কামাল হোসেন বিএনপিসহ তার ফ্রন্টকে জিতিয়ে আনতে পারবেন- এটা কারো কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। কারণ, বাংলাদেশের নির্বাচনী বাজারে বিপণনযোগ্য পণ্য ড. কামালের কাছে মজুত নেই। জনসাধারণ, এমনকি বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছেও তিনি গ্রহণযোগ্য নেতা ছিলেন না।  তারপরও বিএনপি তাকে সেনাপতি মেনে একটি অসম ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। কারণ বিএনপি তখন গ্রহণযোগ্য একজন নেতা খুঁজছিল দেশবাসীর সামনে উপস্থিত করার জন্য। সে ক্ষেত্রে ড. কামালকেই তারা বেছে নিয়েছিল। তারা ভেবেছিল ড. কামালের ইমেজ কাজে লাগিয়ে অভীষ্টে পৌঁছতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। কেন হয়নি, উপরে তার কিছুটা আলোকপাত করা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, ওই মুহূর্তে বিএনপির তাহলে কী করার ছিল? হ্যাঁ, এটা ঠিক বিএনপি তখন নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগছিল। সে শূন্যতা এখনো কাটেনি। নিজেদের মধ্য থেকে কাউকে সামনে রেখে এগোনোর কথা তারা ভাবেনি। বেগম জিয়ার অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব নিয়ে যে উপদলীয় কোন্দল সৃিষ্ট হয়, তাতে  দলটি আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। সেটা সামাল দিতেই ড. কামাল হোসেনকে বসাতে হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে ‘ক্যাপ্টেন’ বানিয়ে এগিয়ে গেলেই ভালো করত। প্রয়োজনে শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে একটি স্টিয়ারিং কমিটি করে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে দলটি লাভবান হতো। তাতে ফলাফল যদি অনুকূলে নাও আসত, তারপরও নেতৃত্ব থাকত বিএনপিরই নিয়ন্ত্রণে।

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নিয়ে কম-বেশি সবারই সংশয় ছিল। তাছাড়া নির্বাচনী পরিবেশ এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল সম্পর্কে তিনি কতটা ওয়াকিবহাল ছিলেন তা নিয়ে সন্দেহ ছিল অনেকেরই। স্মরণ থাকার কথা, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং প্রশাসনের চাপে বিএনপি প্রার্থীরা যখন প্রায় মাঠছাড়া, তখনো ড. কামাল বলছিলেন- ‘ভোটের আগে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।’ বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার এলাকা থেকে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশ নেই, নির্বাচন বর্জন করাই শ্রেয়।’ তিনি প্রস্তাব করেছিলেন দলের ও জোটের সব প্রার্থীকে ঢাকায় এনে নির্বাচন কমিশন অফিসের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালনের। কিন্তু তার সে প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়েছিলেন ড. কামাল হোসেন। তিনি তখনো বলেছিলেন, সেনাবাহিনী নামলেই পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। কিন্তু সেনাবাহিনী নামার পরও যখন পরিস্থিতি বদলালো না, তখন তিনি বললেন- ‘ভোটের দিন পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কিছুই পাল্টালো না। পরিস্থিতি ‘যথা পূর্বং তথা পরং’ই রয়ে গেল। কার দেওয়া আশ্বাসে, কীসের ভিত্তিতে ড. কামাল হোসেন এসব আশার বাণী শুনিয়েছিলেন, তা বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছে এখনো রহস্যময় হয়েই আছে। সন্দিগ্ধ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কী বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা এবং শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য কোথাও থেকে তিনি দায়িত্ব পেয়েছিলেন?

ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বের সাম্প্রতিক ব্যর্থতার জাজ্বল্যমান উদাহরণ তার দল থেকে নির্বাচিত দুজনের দলীয় এবং জোটগত সিদ্ধান্ত অমান্য করে এমপি হিসেবে শপথ নেওয়া। প্রশ্ন উঠেছে, যিনি তার একটি ক্ষুদ্র দলের ঐক্য ধরে রাখতে পারেন না, দলের নেতাদের তার নির্দেশ মানতে বাধ্য করতে পারেন না, তিনি কীভাবে এত বড় একটি রাজনৈতিক জোটের নেতৃৃত্ব দেবেন? ফলে এটা বলা যায় যে, সঙ্গত কারণেই বিএনপি ঐক্যফ্রন্ট তথা ড. কামালের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। দলটি যদি কার্যতই এ সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটা সময়োপযোগী এবং সঠিক বলেই বিবেচিত হবে। এটা ঠিক, বিএনপিতে এখন নেতৃত্বশূন্যতা বিরাজ করছে। সে শূন্যতা তাদের পূরণ করতে হবে দলের ভেতর থেকেই। দলের নীতি আদর্শে বিশ্বাসী নয়- এমন কাউকে হায়ার করে এনে সে শূন্যতা পূরণ করা যাবে না।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক    

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads