• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ইহা একটি সামাজিক ব্যাধি

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ইহা একটি সামাজিক ব্যাধি

  • এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
  • প্রকাশিত ২৭ এপ্রিল ২০১৯

ধর্ষণ সাম্প্রতিক সময়ের একটি অন্যতম উদ্বেগজনক ও আলোচিত বিষয়। যৌনতার এই বিকৃত লালসা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সমাজে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নারী এবং শিশু ধর্ষিত হচ্ছে। আবার ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ঘটছে। এর মধ্যে কিছু খবরে আসে, অনেকগুলো আবার আসে না। কারণ ধর্ষণের বেশিরভাগ ঘটনাই ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। দু-একটি ঘটনা মিডিয়ায় এলে আমরা দু-চার কথা বলি। তারপর সবাই যার যার কাজে আবার ব্যস্ত হয়ে যাই। এভাবে চলতে থাকলে সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধ ধ্বংস হওয়া নিশ্চিত। ধর্ষণের ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও এর প্রতিকার করা খুবই জরুরি।

গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি পরীক্ষা দিতে এলে মাদরাসার অধ্যক্ষের ইন্ধনে কিছু চিহ্নিত দুর্বৃত্ত তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে নয়টার দিকে নুসরাত মারা যান। এই হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করার জন্য স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পুলিশের ভূমিকা ছিল বিতর্কিত, নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য। পরবর্তীকালে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের তৎপরতায় অপরাধীরা গ্রেফতার হচ্ছে। এর আগে ২০১১ সালে ঢাকার ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের বসুন্ধরা শাখার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের ধর্ষণের ঘটনা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক যৌন নির্যাতনের বড় ঘটনা। যথাযথ বিচারের মাধ্যমে পরিমল জয়ধরের সাজা হয়েছে, যা এখন সে ভোগ করছে। আমরা চাই ফেনীর ঘটনারও দ্রুত ও যথাযথ বিচার হোক।

গত ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের পর নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণ ছিল ব্যাপক আলোচিত। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আলোচিত ধর্ষণগুলোর মধ্যে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর তরুণী রূপাকে হত্যা, বরগুনার বেতাগী উপজেলার উত্তর করুণা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে শিক্ষিকাকে গণধর্ষণ, বগুড়ার তুফান কাণ্ড, বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ধর্ষণ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যা উল্লেখযোগ্য। অবাক হলেও সত্যি, পবিত্র ঈদুল আজহার দিনেও ধর্ষকরা নিজেদের নিবৃত্ত রাখেনি। হাসপাতালে মাকে রেখে বাড়ি ফেরার পথে এক তরুণী গণধর্ষণের শিকার হয় পটুয়াখালীর বাউফলে। আবার এমন অনেক ধর্ষণের ঘটনা আছে, যেগুলো কখনোই প্রকাশিত হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে, অপ্রকাশিত ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশিত ঘটনার বহুগুণ বেশি।

ধর্ষণের মূল কারণগুলো হলো নগ্নতা, অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্ক্ষা, বেহায়াপনা, অবাধ যৌনাচার, রাস্তার পাশে দেয়ালে নগ্ন পোস্টার, ফুটপাতে অশ্লীল ছবি সংবলিত উত্তেজক অবৈধ বইয়ের রমরমা ব্যবসা, অশ্লীল পত্রপত্রিকা, অশ্লীল ছায়াছবি প্রদর্শন, চলচ্চিত্রে খলনায়ক কর্তৃক নারীকে জোরপূর্বক ধর্ষণের দৃশ্যের মাধ্যমে সমাজে রাস্তাঘাটে ধর্ষণ করার উৎসাহ জোগানো, ইন্টারনেটে অশ্লীল সাইটগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া, প্রেমে ব্যর্থতা ইত্যাদি কারণে আজ যুবসমাজের মধ্যে দিন দিন ধর্ষণপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণের আরো একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও ছেলেমেয়েকে বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের উদাসীনতা।

একাকিত্ব বোধ, অক্ষমতাবোধ, রাগ, অপমানজনক অনুভূতি, হতাশা, ব্যর্থতা বা ব্যক্তিজীবনে কষ্ট, অপ্রাপ্তি এসব থাকলে ধর্ষণের আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পায়। কোনো মেয়ে প্রেমে বা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে রাজি না হলে মেয়েটির ‘না’-কে সহ্য করতে না পেরে ধর্ষণ করে। সাইকোপ্যাথিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী লোকেরা ধর্ষণ করে। ধারাবাহিক ধর্ষণের কারণও এটি। মাদকাসক্তি মানুষের স্বাভাবিক বিবেচনাবোধ লোপ করে, এটিও ধর্ষণের আরেকটি কারণ। ক্ষমতাশীল ব্যক্তি সুযোগ পেয়ে কোনো দুর্বল মেয়ে, শিশু বা ছেলের ওপর ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটায় ধর্ষণের মাধ্যমে।

ধর্ষণের আরেকটি অন্যতম কারণ হলো আইনের প্রতি মানুষের ভয় না থাকা। ২০১৩ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোতে প্রতি চারজনের মধ্যে একজন পুরুষ জীবনে অন্তত একবার কোনো নারীকে ধর্ষণ করেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ পুরুষকেই কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। অথচ আমাদের রয়েছে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত-২০০৩)’, যেখানে ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড (বিশেষ ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড) ও অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় সংবিধানের ২৮ নং অনুচ্ছেদে বিশেষ ক্ষেত্রে নারীর অগ্রাধিকার প্রদানসহ রাষ্ট্র ও জন-জীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভের বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। সংবিধান ও জাতিসংঘের সিডও সনদের আলোকে তৈরি করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১’। এতকিছুর পরও বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ নামক এই মহামারী সামাজিক ব্যাধি।

ধর্ষণের প্রতিকারের বিষয়ে প্রথমে আমাদের পারিবারিক শিক্ষাকে বিবেচনায় নিতে হবে। পরিবার থেকে আমরা সঠিক শিষ্টাচার ও মূল্যবোধের শিক্ষা পাই। পরিবারের মুরব্বি ও কর্তাব্যক্তিদের সচেতন হতে হবে, ছোট সদস্যদের সচেতন করতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকলে অপরাধ গোপন না করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে ধর্ষণ রোধে চাই সরকারের কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ। ধর্ষণকারীর বিচার হতে হবে অতি দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক। ধর্ষণ শুধু একটি ব্যাধি নয়, এটি দেশ ও জাতির জন্য অনেক বড় একটি অভিশাপ। এই অভিশাপের কালো অধ্যায় থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। আর সেই গুরুদায়িত্বটি আমার, আপনার ও সবার।

 

লেখক : চাকরিজীবী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads