• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ওয়াসার পানি বনাম গ্যাসের অপচয়

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ওয়াসার পানি বনাম গ্যাসের অপচয়

  • মোহাম্মদ আবু নোমান
  • প্রকাশিত ২৮ এপ্রিল ২০১৯

পানি একদিকে আমাদের জীবন বাঁচায়, আবার এই পানি আমাদের জীবননাশের কারণ হতে পারে। সাধারণত পানি যদি পানযোগ্য না হয়, পানি দূষিত হলে পানিবাহিত অনেক রোগ হতে পারে। পানিবাহিত রোগের মধ্যে ডায়রিয়া, আমাশয়, পোলিও, অধিকাংশ চর্মরোগ, হেপাটাইটিস এ ও ই, টাইফয়েড, প্যারাটাইপয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি অন্যতম। ডায়রিয়া এবং অন্যান্য পাকস্থলীর পীড়া, খাদ্যনালির প্রদাহ যেসব পরজীবীর কারণে ঘটে তাদেরকে পানিবাহিত রোগ বলে এবং এগুলো পানির মাধ্যমেই সংক্রমিত হয়। বাংলাদেশে সংঘটিত রোগব্যাধির শতকরা প্রায় ২৫ ভাগের কারণ দূষিত পানি পান।

ওয়াসার পানি ‘শতভাগ’ সুপেয়- ওয়াসার এমডির এ কথাও ‘শতভাগ’ সঠিক হওয়াই কাম্য। আবার গৃহস্থালি পর্যায়ে পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে প্রতি বছর প্রায় ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয়- এ কথাও সঠিক না-ও হতে পারে। কিন্তু এ কথা তো ঠিক, ওয়াসার পানি সরবরাহে পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় অধিকাংশ গ্রাহককেই মোটর দিয়ে পানি টানতে হয়, এতে যে অহেতুক ব্যাপক বিদ্যুৎ খরচ হয়, তার হিসাব টিআইবির গবেষণায় দেখা যায়নি। তবে ওয়াসার পানি যে বিশুদ্ধ নয়, তা নগরবাসীর কাছে স্পষ্ট। ঢাকাবাসীকে ওয়াসার পানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। খাবার পানি ফুটিয়ে ব্যবহার করলেও গৃহস্থালির অন্যান্য কাজে সরাসরি পাইপলাইনের পানিই ব্যবহার করা হয়। থালা-বাসন ধোয়া, রান্নার কাজেও পাইপলাইনের পানি ব্যবহার হয়ে থাকে। কাজেই এসবের ভেতর দিয়েও রোগজীবাণুতে আক্রান্ত হতে পারে মানুষ। টিআইবি এক গবেষণায় জানিয়েছে, ঢাকা ওয়াসার নিম্নমানের পানি ও পয়োনিষ্কাশন সেবায় রাজধানীর এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সেবাগ্রহীতা অসন্তুষ্ট। একই সঙ্গে ওয়াসার অপরিষ্কার ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সেবন করে পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে নগরবাসী। টিআইবির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে সেবাগ্রহীতার ৫১.৫ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি অপরিষ্কার এবং ৪১.৪ শতাংশ সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সেবাগ্রহীতাদের মতে, তাদের পরিবারের ২৪.৬ শতাংশ সদস্য পানিবাহিত কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এর আগে গত অক্টোবরে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরাঞ্চলে পাইপলাইনে সরবরাহ করা ৮২ শতাংশ পানিতে ক্ষতিকারক ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। ওই প্রতিবেদনের পর উচ্চ আদালতে একটি রিটও হয়েছিল।

সবাই ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খায় এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘জারের পানি ও বোতলজাত পানি তাহলে কোথায় যায়।’ এখানে কিন্তু একটি ‘মহা শুভঙ্করের ফাঁকি’ লক্ষণীয়! দেশের জারের পানি, বোতলজাত পানি বা পিওর ওয়াটার ট্রিটমেন্টের নামে যত কোম্পানি পানি বাজারজাত করে থাকে, তারা কেউই এ কথা বলে না আমরা ওয়াসার পানি থেকে সরবরাহ করে থাকি। তাহলে তারা নিশ্চিত বাজার হারাবে। বরং তারা প্রচার করে আমরা গভীর নলকূপ থেকে পানি সরবরাহ করি। যদি ওয়াসার পানি শতভাগই সুপেয় হয়, তাহলে ওয়াসা অফিসসহ সরকারি সব অফিসে সরাসরি ওয়াসার পানি খাওয়া বাধ্যতামূলক করা কেন হয় না?

বিভিন্ন সময় ময়লা, দূষণ, দুর্গন্ধ ও কালো পানি আসার কারণে ওয়াসার পানি সরাসরি খাওয়ার কথা চিন্তাও করতে পারেন না সচেতন কেউ। এজন্য প্রত্যেকেই পানি ফুটিয়ে খেয়ে থাকেন। এতে গ্যাসের ব্যয় হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় পানি ফুটানোতে গ্যাসের অপচয় হয় বলাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? অপচয় হয় তখন, যখন মানুষ অপ্রয়োজনে ব্যবহার করে।

গ্যাসের অপচয় সম্পর্কে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘টিআইবির গবেষণায় অপচয়ের কথা বলা হয়েছে কিন্তু রাজস্ব আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে বছরে ৪০০ কোটি টাকা এবং সিস্টেম লস কমানোর মাধ্যমে আরো ২০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করছে ওয়াসা। বিষয়টি টিআইবির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়নি।’ ওয়াসা রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও সিস্টেম লস কমানোর মাধ্যমে আয় করছে এটা ভালো খবর! সরকারি অনেক খাত রয়েছে, যা অলাভজনক, সেবামূলক। কিছু রয়েছে লোকসানি। কিন্তু ওয়াসার রাজস্ব আয়ে লাভের চিন্তার চেয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করাই অতি জরুরি। কেননা পানির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে মানুষে রোগব্যাধিসহ বাঁচা-মরা ও সুস্থতার লড়াই।

যে দেশে পৃথিবীর প্রায় ৯৮ শতাংশ প্রবহমান প্রাকৃতিক মিঠাপানির উৎস রয়েছে, সেখানে বছরে শতকোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন দেশের ওয়াটার ট্রিটমেন্ট আমদানি করাকেই অপচয় বলা যেতে পারে। আবার সীমিত লোকবল ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে ওয়াসা ইউরোপ, আমেরিকা মানের সুপেয় পানি সরবরাহ করবে সে আশা করাই ভুল। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতেও ওয়াটার পিউরিফায়ার কোম্পানিগুলো সার্ভিস দিয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে শতভাগ সুপেয় না হোক, অন্তত নিরাপদ খাবার পানির দাবি একজন নাগরিক হিসেবে ওয়াসার কাছে প্রত্যেকেই করতে পারেন। রাজধানীবাসীর জন্য ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে প্রশ্ন অনেক পুরনো। ওয়াসার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, সেবার মান, দুর্নীতি, গ্রাহক সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি, অনিয়ম, সীমাবদ্ধতা, পানি সঞ্চালনের চারদিকে অব্যবস্থাপনার জাল ইত্যাদি বিষয়ে অনুধাবন করতে গেলে বলতে হয়- এভাবে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব নয়। ওয়াসার পানি সুপেয় বা শতভাগ সুপেয় থাকা বড় কথা নয়! আসল কাজ হলো গ্রাহকের হাতের মুঠোয় পর্যন্ত নিরাপদ ও জীবাণুমুক্ত সুপেয় পানি পৌঁছে দেওয়া।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads