• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
মানবতার মহাক্রান্তিকাল

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

মানবতার মহাক্রান্তিকাল

  • সোলায়মান মোহাম্মদ
  • প্রকাশিত ২৯ এপ্রিল ২০১৯

নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে বর্বরতম হামলায় নিহত মানুষের শোকের রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতে শ্রীলঙ্কায় আবারো সন্ত্রাসী হামলা। প্রায় তিনশ মানুষ সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। পাঁচ থেকে ছয়শ মানুষ মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসীরা বুনো উল্লাসে মেতে উঠেছে। বুনো উল্লাস শেষে হয়তো তারা আবারো বিশ্বের অন্য কোথাও শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের দেশেও নাকি এমন সন্ত্রাসী বোমা হামলার চেষ্টা চলছে যা প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট দক্ষ ও সচেতন বলে সুযোগ পাচ্ছে না। সন্ত্রাসী হামলা না হলেও আমাদের দেশে মানবতা বলতে আজ আর কিছু নেই। স্বার্থবাদিতা, অর্থলোভ ও ক্ষমতার মোহে মানবতা আজ নিরুদ্দেশ। কোথায় হারালো মানবতা বলতে পারেন?

কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির বিদেহী আত্মা আজো মানবতা খুঁজে ফিরছে। সবশেষ নুসরাত সেই মানবতার খোঁজে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল। তনুর মা আনোয়ারা বেগম এখন আর প্রশাসনের কাছে বিচার চান না, আকাশের পানে আল্লাহর কাছে মেয়ে হত্যার বিচার প্রার্থনা করেন। নুসরাতের বিচার শেষবেলায় এসে কোথায় পৌঁছবে বলা মুশকিল। মিডিয়ার কল্যাণে শুনেছি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তাও নাকি সোনাগাজীর অভিযুক্ত সেই ওসি মোয়াজ্জেম খানের পক্ষে সুপারিশ করেছেন।

হায় মানবতা! দেশে দেশে আজ তাকে খুঁজে ফিরছে সাধারণ মানুষ। শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের শিশু নাতি জায়ান চৌধুরীও নিহত হয়েছে। দেশের প্রায় সব মিডিয়াতেই বিষয়টি উঠে এসেছে। দুঃখজনক বিষয় হলো, অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে প্রকাশিত জায়ানের মৃত্যুসংবাদে অগণিত লোক হা হা রিঅ্যাক্ট দেখিয়েছে। বিষয়টি একদিক থেকে খুবই তুচ্ছ। এগুলো ভাবার হয়তো কারো সময় নেই। কিন্তু মানবিকতার দিক থেকে খুবই লজ্জার। একটি শিশুর নির্মম মৃত্যুসংবাদেও যারা অসভ্যের মতো হাসিতে ফেটে পড়তে পারে, তাদের কাছ থেকে জাতি কী আর আশা করতে পারে! শিশুরা নির্দোষ ও নিষ্পাপ। তাদের এমন নির্মম মৃত্যুতেও যারা রাজনীতি টেনে আনেন, তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষা জানা নেই। মনে হচ্ছে, সবকিছুই আজ নষ্ট রাজনীতির দখলে চলে যাচ্ছে।

আমরা মানুষ, সৃষ্টির সেরা জীব। সবদিক থেকেই সৃষ্টির সেরা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের চলায়, বলায়, আদব কায়দায়, আচার-আচরণে, পোশাকে-আশাকে এমনকি ধর্মে-কর্মেও মনুষ্যত্বকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সৃষ্টির সেরা জীবের যেমন বৈশিষ্ট্য থাকার কথা, তা যেন একেবারেই হারিয়ে বসেছি। এখন মানুষের মুখে মুখে মানবধর্মের কথা শোনা যায়। কিন্তু পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। সেই কল্যাণই মানবধর্ম। আমাদের নৈতিকতা লোপ পাওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের মূল সারবত্তা থেকে সরে যাওয়াও একটি কারণ। আর তাই সবাই একধরনের সুযোগসন্ধানী হয়ে উঠেছি। আর কয়েকদিন পরেই মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজান শুরু হচ্ছে। অথচ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যেখানে রমজান মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগের চেয়ে কমে যায়, সেখানে বাংলাদেশে প্রতিটি পণ্যের দাম আগের তুলনায় বহুগুণ বেড়ে যায়। বলা যায় ধর্মের নাম ভাঙিয়েই সব থেকে বেশি ফায়দা হাসিল করছে একদল সুযোগসন্ধানী ধর্ম ব্যবসায়ী।

বর্তমান সময়ে মানবতা আজ চরমভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যেই নিজ স্বার্থ হাসিলের ধান্দা পরিলক্ষিত হতে দেখি। তাই ব্যতিক্রম বাদে, নতুন কোনো সম্ভাবনার ক্ষেত্র রচিত হলে প্রমাদ গুনতে হয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে এও কি নতুন কোনো প্রতারণার ফাঁদ? সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে প্রতারণার যতগুলো ধাপ থাকে, প্রতিনিয়তই আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ ডাক্তার তা অতিক্রম করে থাকেন।

আমাদের দেশে মানবতার বর্তমান যে রূপ দাঁড়িয়েছে তা হলো, নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা যত অসহায়ই হোক না কেন, ঠিক তাদের কাছ থেকেই ফায়দা হাসিল করে নানা শ্রেণির লোভী মানুষ নামের অমানুষগুলো। ‘কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ’ প্রবাদের সাথে বর্তমানে শতভাগ মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। উদাহরণ টেনে বলা যায়— কিছুদিন আগে গাজীপুরে হঠাৎ করেই ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। এতে কৃষকের ফসল, ঘরবাড়ি সব এক নিমিষেই তছনছ হয়ে যায়। গ্রামের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে যায়। টিন পরিবর্তন ছাড়া পরিবার নিয়ে রাতযাপন অসম্ভব ছিল। যে কারণে টিন জরুরিভিত্তিতে পরিবর্তন করতে হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, ওই শিলাবৃষ্টির পরদিনই টিনের দাম বাড়িয়ে দেয় একশ্রেণির টিন ব্যবসায়ী। টিনের বানপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে রাখে তারা। গ্রামের অসহায় কৃষক পরিবারকে যেখানে সহানুভূতি দেখিয়ে হলেও দাম কিছু কম রাখার কথা, সেখানে সুযোগের সদ্ব্যবহার শুরু করে লোভাতুর ওই ব্যবসায়ীরা।

ঢাকার চক বাজারের কথাই একবার ভেবে দেখুন, যে রাতে আগুন ধরলো ঠিক তার পরেরদিন সারাক্ষণ পোড়া মানুষ উদ্ধার কাজ চলছে, স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সারা শহর ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেদিনও আমাদের আশপাশের পিকনিক স্পটগুলোতে নাচ-গান, আনন্দফুর্তি দেদার চলেছে।

কাজেই বলা যায়, আমরা এখন মানবতার মহাক্রান্তিলগ্নে বাস করছি।

মানবতা হারিয়েছে কারণ আজ আমরা স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজের বিবেক-বুদ্ধিকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি, আমরা আজ মনুষ্যত্বহীন মানুষ নামের খোলস। মানুষ যেখানে বাস করে, ঠিক সেখানেই মানবতা বাস করবে- এমনটাই হওয়ার কথা। কাজেই এখন থেকে নতুন করে মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে মানুষ হতে পারে, সেভাবেই তাদের গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন শুধু মানুষের চেহারায় কিছু হায়েনা বাস করবে, মানব-পৃথিবী মহাশ্মশানে পরিণত হবে। নিউজিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কায় যেভাবে বোমা হামলা হয়েছে, ঠিক সেভাবে প্রতিনিয়তই বোমা হামলাসহ আরো অন্যান্য বিধ্বংসী হামলাও একের পর এক চলতে থাকবে।

এখন এই সমাজ থেকে নৈতিকতা উঠে গেছে। স্কুল, কলেজ এমনকি পরিবার থেকে বিসর্জন দেওয়া হয়েছে নৈতিক শিক্ষাগুলো। পৃথিবীর কোনো ধর্মই বলে না— মিথ্যা বলো, চুরি করো, ঘুষ খাও, স্রষ্টাকে স্মরণ করো না। কিন্তু আজ আমরা নামধারী ধর্মপ্রাণ মানুষ মাত্র। যখন অন্তরের বিশ্বাস থেকে ধর্মীয় অনুশাসনের চর্চা হয় না, পরিবার ও সমাজে তা যখন লোক দেখানোর কাজে পরিণত হয়, তখন সে জাতির অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের অভিভাবকদেরও জানতে হবে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষাই পারে একজন মানুষকে সঠিক ও সুন্দর পথ দেখাতে। তবে কি আজকের অভিভাবকরা সেই নৈতিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত? তারা কি তাদের বাল্যজীবনে আদর্শ পরিবার কিংবা শিক্ষকের দেখা পাননি? প্রকৃত শিক্ষা আমাদের ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, আলো-অন্ধকার, বৈধ-অবৈধ, পাপ-পুণ্য, জানা-অজানা, দুনিয়া-আখিরাত, রাত-দিন প্রভৃতি অর্জনের শিক্ষা দেয়। আজকের স্মার্ট ফোন,  ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সন্তানের যেমন প্রকৃত জ্ঞানার্জনের সুযোগ রয়েছে, তেমনি খারাপ হওয়ার পথও খোলা রয়েছে। সুতরাং সন্তানকে অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভেতরে ঠেলে না দিয়ে তাকে নৈতিক শিক্ষায় আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন। তবেই সমাজে মানবতা ফিরে আসবে। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ ফিরে পাবে তার নিশ্চিত বসবাসের আপন ঠিকানা এই সুন্দর পৃথিবী। কবির ভাষায় তখন বলা সম্ভব হবে- ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’

 

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads