• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ভূমিকা এবং সংবাদকর্মীদের অধিকার

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

মুক্ত গণমাধ্যম দিবস

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ভূমিকা এবং সংবাদকর্মীদের অধিকার

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ০৩ মে ২০১৯

বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যাপক জোরালো ভূমিকা পালন করতে হয়। আজকের বিশ্বে গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা কতটুকু স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করতে পারছে বা নিজেরাই নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। কোনো দেশের উন্নয়নে মুক্ত গণমাধ্যম অন্যতম শর্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া উচিত। কারণ গণমাধ্যম রাষ্ট্র পরিচালিত ব্যবস্থার খুঁটিনাটি দিকগুলো চিহ্নিত করে এবং তা বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ বাতলে দেয়। গণমাধ্যমের প্রকার এখন বিস্তৃত। টেলিভিশন চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া এবং রেডিওর সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পত্রিকা, অনলাইন টিভি এবং অনলাইন রেডিও রয়েছে প্রচুর। আরো নতুন নতুন পত্রিকা ও অনলাইন আসছে।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল কথা হলো রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জনগণ। তাই তথ্য জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। আর তথ্য জানানোর দায়িত্বও রয়েছে। জানার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তি পূরণের জন্যই গণমাধ্যমগুলো কাজ করে। এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা প্রতিনিয়ত মানুষের তথ্য জানার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে তা সংগ্রহ এবং প্রচার করছে। এই তথ্য জানানোর কাজটি সবক্ষেত্রে সহজ হয় না। অনেক সময় ক্ষমতাশালীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই তাকে তার কাজ করতে হয়। তাই হরহামেশাই সাংবাদিককে তথ্য সংগ্রহের সময় হয়রানির শিকার হতে হয়। প্রতিটি মুহূর্তে একজন গণমাধ্যমকর্মী ঝুঁকির মধ্যে, সব বাধা উপেক্ষা করেই কাজ চালিয়ে যান। আর সেজন্য গণমাধ্যমকে সমাজের আয়না হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আয়নায় যে রূপ নিজের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গণমাধ্যমেও সমাজের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই ছবি ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নেন গণমাধ্যমকর্মীরা। দেশে এখন শত শত পত্রিকা। জাতীয়, স্থানীয়, সাপ্তাহিক, মাসিক ও পাক্ষিকসহ বিভিন্ন পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইনে কাজ করা বহু সাংবাদিক সারা দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। পত্রিকায় কাজ করা প্রান্তিক পর্যায়ের সাংবাদিকদের পরিশ্রম করতে হয় ঠিকই; কিন্তু তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেওয়া হয় না।

পত্রিকা প্রকাশের বিজ্ঞাপন দিলেই প্রচুর সংখ্যক আবেদন পাওয়া যায়। তারা এটা জানে যে, এখান থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাবে না। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্মানের জন্যই মূলত এত আগ্রহ দেখা যায়। তবে দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, সংবাদ সংগ্রহের বিপরীতে তাদের আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। গণমাধ্যম এসব দেশ ও বিদেশের সংবাদ প্রকাশ এবং বিশ্লেষণ করে জনগণকে সচেতন করে। এছাড়া বিনোদন এবং শিক্ষামূলক কাজেও গণমাধ্যম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গণমাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। গণমাধ্যম তখনই সার্থকতা পায় যখন জনগণের উপকারে এসে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। এজন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মুক্ত প্রকাশ সবার আগে প্রয়োজন। সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমকর্মীদের নানাভাবে নির্যাতিত হতে হয়। জেল জরিমানা, হুমকি-ধমকি এসব সহ্য করতে হয়। তারপরও গণমাধ্যমকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহ থেমে থাকে না।

রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের সৈনিকদের থেমে থাকলে চলে না। ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়। ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব চিরকালের। গণমাধ্যম বরাবরই দুর্বলের পক্ষে লড়াই করে। তাই এ পথটা বেশ কঠিন হয়। গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে তীক্ষ দৃষ্টি রাখা। রাষ্ট্রের একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নে কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম হচ্ছে কি-না, সেদিকে খেয়াল রাখা। জনগণের প্রাপ্য জনগণ ঠিকমতো পাচ্ছে কি-না তাও দেখার দায়িত্ব রয়েছে। গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা সমাজের সবক্ষেত্রে আবশ্যক। সরকারের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত জনগণকে অবহিত করার কাজটিও গণমাধ্যম করে থাকে। কারণ গণমাধ্যম হলো উন্নয়নের অংশীদার। দেশের উন্নয়নের বার্তাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে সবাইকে উন্নয়নের মূলধারায় একীভূত করতে হলে গণমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কেননা যে দেশ গণমাধ্যমকে মুক্তভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে, সেসব দেশ এগিয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই আজকাল মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার সুযোগ নিয়েই মূলধারার বাইরের কিছু গণমাধ্যম নামের লেবাসধারী সমাজে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়ায়। এটা সমাজের জন্য হিতকর নয় এবং গণমাধ্যমের কাজও এটা নয়। এটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক এবং এসব গণমাধ্যম তার উদ্দেশ্য সাধন করেই শেষ হয়। সাংবাদিকরা জনগণের ভেতরের শব্দ ফুটিয়ে তোলেন। সেক্ষেত্রে বলা যায়, সাংবাদিকতা একটি ক্ষমতা। তবে এই ক্ষমতা মানুষের জন্য, কোনো ব্যক্তিবিশেষকে সন্তুষ্ট করার জন্য নয়।

ক্ষমতা শব্দটি দায়িত্বশীলতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকাই উত্তম। এর অর্থ আপনার ক্ষমতাকে দায়িত্বে রূপান্তর করা উচিত। কেননা কলম তরবারির চেয়েও শক্তিশালী। আর গণমাধ্যমকর্মীদের যুদ্ধ কলম দিয়ে। এই যে আজ বাংলাদেশে শত শত গণমাধ্যম রয়েছে এবং প্রতিদিন আরো গণমাধ্যম যোগ হচ্ছে, তার ওপর সাধারণ মানুষ কতটুকু আস্থা রাখতে পারছে বা পাঠক কতটুকু সময় সেই গণমাধ্যম দেখছে। গাড়িতে প্রেস লিখে অনেকে অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। পকেটে পাওয়া যাচ্ছে একেবারে অচেনা কোনো ডটকম জাতীয় পত্রিকার পরিচয়পত্র। অনেক পত্রিকার পরিচয় ফেসবুকে খবর শেয়ারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারা গণমাধ্যমের নাম দিয়ে কেবল অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন বা নিজের পিঠ বাঁচাতে এসেছিল। এসব গণমাধ্যম থেকে সাবধান থাকতে হবে। ভালো লক্ষণ হচ্ছে, গণমাধ্যমে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে দেশের শিক্ষিত শ্রেণির ভেতরেও। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকেই গণমাধ্যমে কাজে আগ্রহী হচ্ছে। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের আকর্ষণ করছে। এছাড়া নারীদের একটি বড় অংশ এখন গণমাধ্যমে কাজ করছে। দিন দিন এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কাজের ক্ষেত্রে একটি সমতা গণমাধ্যম করে যাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, কয়টি গণমাধ্যম আজ মফস্বল এলাকায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বেতন ভাতা নিশ্চিত করে। কয়টি গণমাধ্যম ওয়েজ বোর্ডের নিয়ম মেনে সংবাদকর্মীদের বেতন সুবিধা দেয়? এসব বিষয়ে তদারকি প্রয়োজন। ওয়েজ বোর্ড আইন অনুসরণ না করলে সেসব গণমাধ্যমের ডিক্লারেশন বাতিল করার আইন প্রণয়ন করারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে আজকাল নিয়োগ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ মনে করেন উদ্যোক্তারা। গণতান্ত্রিক সুব্যবস্থার স্বার্থেই এই অনিয়মের ভেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads