• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
সুবক্তা হতে হলে

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সুবক্তা হতে হলে

  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৯

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

 

কেউ কেউ আছেন, বক্তৃতা দিতে গেলে হার্টবিট বেড়ে যায়। কারো কারো আবার হাত-পা কাঁপে, গলা শুকিয়ে যায়। কেউ কেউ আছেন, অতিরিক্ত নার্ভাস হয়ে, যা বলতে এসেছিলেন, সেটাই ভুলে যান। এমনও আছেন, বেশি মানুষের সমাগম দেখলে কিংবা অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সামনে বক্তৃতা দিতে অতিরিক্ত মানসিক চাপে ভোগেন। তখন বক্তব্য তালগোল পাকিয়ে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেন। আমাদের অনেকের এই সমস্যাগুলো আছে, যে কারণে আমরা ভালো বক্তা হতে পারি না। ভালো বক্তা হওয়ার কিছু কলাকৌশল আছে। এই কলাকৌশলগুলো রপ্ত করতে পারলে একজন ভালো বক্তা হওয়া যায়।

আমরা প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের বক্তৃতা শুনে থাকি। এই যেমন ধরুন অফিসে, স্কুল, মাঠে-ঘাটে-রাস্তায়, রেডিও-টেলিভিশনে, বিভিন্ন ধরনের সভা-সেমিনারে। আমাদের অনেকের ধারণা হচ্ছে, যিনি যত বেশি শিক্ষিত, তিনি তত ভালো বক্তা হবেন। এই ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভুল, যার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। আমরা দেখতে পাই, দেশের কিছু রাজনৈতিক নেতা, কবি, সাহিত্যিক হাজারো শ্রোতার সামনে অকপটে দুর্দান্ত বক্তব্য রাখছেন। তাদের দেওয়া বক্তব্য শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন এবং উজ্জীবিত হচ্ছেন। তাদের মধ্যে কারো কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা অতি অল্প কিন্তু উনারা বিশাল মাপের জনপ্রিয় বক্তা। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য ব্যক্তির নাম বলা যাবে, যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম থাকা সত্ত্বেও তারা অনেক জনপ্রিয় বক্তা ছিলেন। আবার এমনও অনেক ব্যক্তি ছিলেন, যারা অতি উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু ভালো বক্তৃতা দিতে না পারার কারণে অন্য কেউ উনাদের লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করতেন। আমরা কিছু কিছু বক্তার খুব সাধারণ কথা শুনলেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে উনাদের বক্তব্য শুনে যাই। আবার কিছু কিছু বক্তা অতি জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য দিলেও অল্প সময় পরেই আমরা বক্তৃতা শুনতে বিরক্ত বোধ করি। সহজেই বুঝতে পারি, কে ভালো বক্তা, কিন্তু তিনি কেন ভালো বক্তা, সেটা অনেকেই জানি না।

ভয়কে জয় করুন: একজন বক্তা হওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে, মনের ভয়টাকে জয় করা। নিজের মনের ভেতরে ভয় নিয়ে কখনো বক্তা হওয়া যাবে না। মনের ভয়টাকে জয় করার সবচেয়ে সহজ কৌশল হচ্ছে, মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করা ও খোলা মনে কথা বলা। মনের ভেতরের জড়তা, সংকোচ পরিহার করে সবার সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা বলা। অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। সর্বোপরি, অন্য কারো সঙ্গে কথা বলার সময় ভাবতে হবে, তিনি আমার মতোই একজন মানুষ, অন্য কিছু নন। তবে হ্যাঁ, যিনি যতটুকু সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তাকে সেই সম্মান অবশ্যই দিতে হবে।

অনুশীলন করুন: একজন ভালো বক্তা হওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই প্রথমে অনুশীলন করতে হবে। সবচেয়ে ভালো অনুশীলন করার জায়গা হচ্ছে আয়না। আমরা যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিয়মিত বক্তৃতা দিই, তাহলে জড়তা কেটে যাবে এবং মুখের বাচনভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গিতে দৃষ্টিকটু কিছু মনে হলেও সেটা সংশোধন করে নেওয়া যাবে। তারপর সাহস বৃদ্ধির জন্য মাঝেমধ্যে কৌশলে কাছের কিছু বন্ধুর সামনে বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে কথা বলে যাওয়া। এছাড়াও বিভিন্ন বক্তার বক্তৃতা মনোযোগ দিয়ে শোনা। কে কীভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন, মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করা। সেই ভাবে নিজেকে তৈরি করা।

প্রস্তুতি নিন: বক্তব্য দেওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে, যা বক্তব্যের সময় খুব সহায়ক হবে। বক্তব্য দেওয়ার আগে আলোচ্য বিষয়টি জেনে তার ওপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু বুলেট পয়েন্ট লিখে নিয়ে যাওয়া যেতে পাবে। বক্তৃতার সময় যা দেখে নিলে অনায়াসে নির্ভুল বক্তব্য দেওয়া সম্ভব। অনেকেই আছেন, খুব সাধারণ কিছু বিষয়ে ভুল করেন। যেমন বক্তৃতার আলোচ্য বিষয়টি বলতে গিয়ে ভুল করেন। ব্যক্তির নাম, পদবি কিংবা প্রতিষ্ঠানের নাম বলতে ভুল করেন। এছাড়াও আরো অনেক ভুল তথ্য প্রদান করে বক্তব্য দিয়ে যান। বক্তৃতা প্রদানকালে ভুল তথ্য দিলে মানুষের কাছে হাসির খোরাকে পরিণত হতে হয়। তাই বক্তব্যে কোনোভাবে ভুল তথ্য দেওয়া যাবে না।

শ্রোতাদের প্রতি দৃষ্টি রাখুন: অনেকেই আছেন, বক্তৃতা প্রদানকালে শ্রোতাদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না। কেউ কেউ ওপরের দিকে, কেউ কেউ নিচের দিকে, আবার নির্দিষ্ট কিছু মানুষের দিকে তাকিয়ে বক্তব্য রাখেন। এতে করে শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় না। বক্তৃতা প্রদানকালে শ্রোতাদের দিকে সমান দৃষ্টিপাত করতে হবে। নির্দিষ্ট কারো সঙ্গে নয়, উপস্থিত সবার ওপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সমান দৃষ্টিপাত করতে হবে। এতে খুব সহজেই শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তখন শ্রোতারা ভিন্নদিকে মনোযোগী হওয়ার সুযোগ পায় না এবং মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শোনে।

ঠিক রাখুন অঙ্গভঙ্গি ও বাচনভঙ্গি: অনেকেই আছেন, যাদের বাচনভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গি সুন্দর না হওয়ায় শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। কেউ কেউ আবার বক্তৃতা প্রদানকালে বাচনভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গির কারণে শ্রোতাদের হাসির খোরাকে পরিণত হোন। বক্তৃতা প্রদানকালে বাচনভঙ্গি ও শারীরিক অঙ্গভঙ্গি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বক্তৃতা কখনো একই রকম স্বরে দেওয়া যাবে না। আবার খুব উচ্চ স্বরেও বক্তৃতা দেওয়া যাবে না, তেমনি খুব নিচু স্বরেও বক্তৃতা দেওয়া যাবে না। বক্তৃতা দেওয়ার সময় বক্তব্যের ধরন অনুযায়ী স্বরের ওঠা-নামা করাতে হবে।  বক্তৃতা প্রদানকালে হাসির কথায় স্বর কোমল ও মুখে হাসি ফোটাতে হবে। কষ্টের কথায় স্বরে ব্যথিত ও চেহারায় কষ্ট ফোটাতে হবে। খুব শক্ত ও কঠিন কথায় স্বর বলিষ্ঠ ও চেহারা রূঢ় করতে হবে। মোটকথা, বক্তৃতার মাঝে একটি স্বরে ও চেহারার ভঙ্গিতে রিদম থাকতে হবে, যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখবে।

প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখুন: অনেকেই আছেন, বক্তৃতা প্রদানকালে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের বাইরে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে নিয়ে বেশি কথা বলেন। এতেও শ্রোতাদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যায় এবং এটি শ্রোতাদের বিরক্তির অন্যতম কারণ। যে প্রসঙ্গে আলোচনা হবে, সেই প্রসঙ্গের বাইরে না যাওয়াই উত্তম। সব সময় চেষ্টা করতে হবে, প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর বক্তব্য প্রদান করা। যদি প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ভালো ধারণা না থাকে, বক্তৃতা দীর্ঘ না করে সংক্ষিপ্ত করে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

বিবেচনা করুন শ্রোতার ধরন ও মনোভাব: বক্তৃতা প্রদানকালে সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, শ্রোতারা কোন ধরনের। অনেক সময় দেখা যায়, শ্রোতাদের অধিকাংশ উচ্চ শিক্ষিত আবার কখনো দেখা যায়, অধিকাংশ শ্রোতাই কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত। উচ্চ শিক্ষিত শ্রোতাদের সামনে যেভাবে বক্তব্য প্রদান খুব বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়, অনুরূপ বক্তব্য কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের কাছে মনোযোগ আকর্ষণ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। শ্রোতাদের ধরন অনুযায়ী বক্তব্য প্রদান করলে, সেই বক্তৃতা শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এছাড়াও শ্রোতাদের মনোভাব বুঝতে হবে এবং সেই মনোভাব অনুযায়ী বক্তব্য দিতে হবে। যেমন, অতি ধার্মিক মনোভাবের শ্রোতাদের কাছে যেমন প্রগতিশীল চেতনার বক্তব্য আবেদন রাখতে পারে না, তেমনি প্রগতিশীল মনোভাবের শ্রোতাদের কাছে ধার্মিক মনোভাব থেকে বক্তব্য দিলেও সেটা আবেদন রাখতে ব্যর্থ হয়। তেমনি ছাত্রদের কাছে যে বক্তব্য খুব আকর্ষণীয় কিন্তু একই বক্তৃতা বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে পুরোপুরিভাবেই ব্যর্থ। এভাবেই বিভিন্ন বয়স, শ্রেণি ও মতাদর্শের কারণে ভিন্ন ভিন্ন মনোভাবের শ্রোতা থাকে এবং তাদের মনোভাব বুঝে বক্তৃতা দিতে পারলেই খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

অব্যক্ত কথা বলা: অনেক বক্তা আছেন, শ্রোতারা আসলে কী শুনতে চান, সেটাই ধরতে পারেন না। তাই খুব সুন্দরভাবে বক্তব্য দেওয়ার পরেও শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হন। শ্রোতাদের মনের অব্যক্ত কথাগুলো অনুধাবন করতে হবে এবং সেই কথাগুলো বলতে পারলেই খুব সহজেই শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করা যায়। শ্রোতাদের তখন মনে হয়, তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো বক্তা তার বক্তৃতায় বলছেন। শ্রোতারা সব সময় প্রত্যাশা করে, তাদের মনের অব্যক্ত কথাগুলো বক্তারা বলুক। তাই এই বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্বারোপ করতে হবে।

 

লেখক : লোকজ গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads