• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বিভাজনের বাগ্যুদ্ধ জাতিসত্তার জন্য হুমকি

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

বিভাজনের বাগ্যুদ্ধ জাতিসত্তার জন্য হুমকি

  • মো. আখতার হোসেন আজাদ
  • প্রকাশিত ০৬ মে ২০১৯

মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে নানা মতের মানুষ থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। মানুষ ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম, মতাদর্শ, আঞ্চলিকতাসহ বিভিন্ন পরিচয় নিয়ে হাজির থাকে। এই পারস্পরিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য থেকেই মানুষ ঐক্যের রসদ সংগ্রহ করে। ফলে সমাজ গতিশীল থাকে। মানুষের ভিন্নমত যদি গঠনমূলক ও যৌক্তিক ক্ষেত্রে চর্চা করা হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে দেশ, জাতি ও মানবতার জন্য অত্যন্ত মঙ্গল ও কল্যাণজনক। এজন্যই হয়তো প্রবাদটি প্রচলিত যে, নানা মানুষ নানা মত এবং যত মত তত পথ। বিভিন্ন ধারার মানুষের বসবাসের ফলে কোনো সংকট কিংবা সমস্যা তৈরি হলে সমাধানের বিভিন্ন ব্যতিক্রমী পন্থা বের হয়। অপরের সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ফলে নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, তেমনই পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। এই প্রতিযোগিতা-নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, নিজের সামাজিক মর্যাদা উন্নত করা প্রভৃতির জন্য। তবে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। একটি সমাজ কখনো দ্বন্দ্বমুক্ত হতে পারে না। সামাজিক দ্বন্দ্ব একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায়, কেবল ব্যক্তিগত বিরোধ, ধর্ম-বর্ণ বা আদর্শিক কারণেই মতপার্থক্য বা বিরোধ করার প্রতিযোগিতার চর্চা চলে। এতে পুরো সমাজ তথা দেশেরই অমঙ্গল বয়ে আনে।

আমাদের সমাজের মানুষেরা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে নানা ভাগে বিভাজিত। একজন অপরজনকে বাগ্যুদ্ধে পরাজিত করেই যেন বীরত্বের পরিচয় নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বক্তৃতার মঞ্চ, রাজনীতির ময়দান, টিভি টকশো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে ওয়াজ-মাহফিল-সর্বত্রই চলছে বাগ্যুদ্ধ। রাজনীতির ময়দানে অপরকে ঘায়েল করতে ব্যবহূত উক্তিসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-উমুক স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি, ওরা ভারতের দালাল, তারা দেশবিরোধী, উনারা দেশ বিক্রির পাঁয়তারাকারী প্রভৃতি। এসব কথা বলে সাময়িকভাবে জনতার মাঠ গরম করা গেলেও প্রকৃতপক্ষে এতে কোনো উপকার হয় না; বরং নিজেদের মধ্যেই প্রতিহিংসার সৃষ্টি করা হয়।

আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। দেশের উন্নয়ন এবং জাতীয় প্রশ্নে আমরা একই পথের পথিক। রাজনীতিতে আদর্শিক বিরোধিতা থাকবে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যেসব প্রশ্নে দেশ ও জাতির স্বার্থসংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সে ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ মন-মস্তিষ্ক নিয়ে তা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কাছে এমনটাই কাম্য। আমরা অনেক সময় দেখেছি, দেশের অনেক স্পর্শকাতর ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ আর পরস্পরের প্রতি কথার কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতে। একটি বিষয় যেন আমাদের দেশের রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। বিরোধী দল মানেই সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের বিরোধিতা করা। আবার সরকারের ভাবনা যেন এই যে ভিন্নমত প্রকাশকারী বা চিন্তা পোষণকারী ব্যক্তি বা দল মানেই নিজের দুশমন মনে করা এবং সেটিকে নিঃশেষ করে দেওয়ার মানসিকতা অনেকটা আত্মঘাতীও বটে। এমন চিন্তাধারা সহিংসতার পথ বাড়িয়ে দেয়। যদি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল পরস্পরের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি চর্চা না শুরু করে, তবে এমন রাজনৈতিক বিভাজন আমাদের নিজস্ব জাতিসত্তার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। আমি নির্দিষ্ট কোনো দলের কথা বলছি না। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে আর যারা বিরোধী দলে থাকেন, সবাই যেন এই নীতিই অনুসরণ করে চলেন।

এবার কিছু কথা বলতে চাই ওয়াজ মাহফিল নিয়ে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ঐতিহ্য ওয়াজ মাহফিল। ইসলামের সুমহান বানী সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করা হয়। কিন্তু বর্তমান সময় যেন ওয়াজ মাহফিলের ধরন বদলে যেতে শুরু করেছে। ধর্মীয় আলোচনার স্থানে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান করা। এক বক্তা আরেক বক্তাকে কাফের, মুরতাদ ফতোয়া দিতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কোনো কোনো বক্তাকে সরাসরি নারী শিক্ষা, জাতীয় সংগীত, জাতীয় দিবসসমূহ পালন নিয়ে জনবিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিতে দেখা যায়। এর ফলে সমাজে বিভাজনের সৃষ্টি হচ্ছে। আবার ধর্মীয় বিধিবিধান নিয়েও বিভেদ সৃষ্টি করে থাকেন অনেকেই। মুসলমানদের মধ্যে যে মতপার্থক্য ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, তা খোলা ও নিরপেক্ষ মন নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসলেই তা দূর করা সম্ভব। আমরা যেন আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে ভুলে গেছি। আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের বিবেকবোধ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ, সেই চিরন্তন সত্য বাক্যের আজ যেন অপমৃত্যু ঘটেছে! তাই হয়তো সমাজে এত অধঃপতন, বিভাজন। আমাদের প্রথম পরিচয় মানুষ, তা যেন আমরা ইচ্ছে করেই ভুলে যেতে চাইছি। সেজন্যই বোধহয় আমরা বলি উমুক হিন্দু, সে অমুসলিম। তাই তার বাড়িতে খাওয়া হারাম। তার সঙ্গে মেলামেশা করা, ব্যবসা করা, সামাজিক সম্পর্ক রাখা যাবে না। যারা এসব বলে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেন, তাদের একটি প্রশ্ন করতে চাই। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.) কি ইহুদিদের বাড়িতে খাননি? অন্য ধর্মের মানুষের সঙ্গে কথা বলেননি? যদি তা নাই বা করতেন তাহলে অন্যান্য ধর্মের মানুষদের কাছে ইসলামের সুমহান বাণী পৌঁছে দিতেন কীভাবে!

আবার স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এসেও যখন আমাদের জাতীয়তা বাঙালি নাকি বাংলাদেশি, আমরা আগে মুসলিম নাকি আগে বাঙালি জাতি, কে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি আর কে বিপক্ষের শক্তি-এসব নিয়ে যখন কেউ চায়ের কাপে ঝড় তোলেন, তখন তা আমাদের নতুন প্রজন্মকে চরমভাবে ব্যথিত করে। স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্য ছিল ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায় ও সাম্যের দেশ গড়ে  তোলা। তাহলে আমরা কি আমাদের স্বাধীনতার উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হচ্ছি? যদি তা না হয়, তবে সমাজে এত বিভেদ কেন? আমরা কেন অপরকে শ্রদ্ধা করতে পারি না? কেন অপর দলের নেতাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করি? তাই যতদিন না আমরা দল-মত-নির্বিশেষে একে-অপরের প্রতি সহনশীল না হব, একে-অপরের প্রতি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই থেকে বিরত না থাকব, ততদিন আমাদের সমাজ তথা পৃথিবীতে শান্তির সুবাতাস বইবে না। মানুষের করুণ আর্তনাদ বন্ধ হবে না। সমাজে বয়ে চলবে অশান্তি, হত্যা, সহিংসতার প্রলয়ংকরী ঢেউ।

 

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads