• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
ন্যায্যমূল্যে রুটি চাই

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সুদানের কথা

ন্যায্যমূল্যে রুটি চাই

  • প্রকাশিত ০৭ মে ২০১৯

মো. আজহারুল ইসলাম

 

২০১১ সালে বিভক্ত হয়ে দক্ষিণ সুদানের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত সুদান ছিল আফ্রিকার সবচেয়ে বড় দেশ। পশ্চিমাশক্তির হস্তক্ষেপ এবং অভ্যন্তরীণ শাসনতান্ত্রিক ব্যর্থতার কারণে গণভোটের মাধ্যমে সুদান থেকে আলাদা হয় দক্ষিণ সুদান নামক সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত রাষ্ট্র। কিন্তু সুদান থেকে দক্ষিণ সুদান আলাদা হওয়ার পর সুদানের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় হয়ে ওঠে। কারণ অবিভক্ত সুদানের মোট খনিজসম্পদের ৭৫ ভাগ দক্ষিণ সুদানের অংশে চলে যায়। সম্প্রতি সুদানে রুটি ও জ্বালানির দাম বাড়ানোকে কেন্দ্র করে গত ডিসেম্বরে বিক্ষোভ শুরু করে জনতা। প্রলেতারিয়েতদের আন্দোলনের মুখে গত ১১ এপ্রিল ক্ষমতার মসনদ হারাতে হয় সুদানের দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল ৩০ বছরের ক্ষমতাসীন ওমর আল বশিরের পতন এবং সুদানে নতুন করে বেসামরিক শাসন কায়েম করা। আন্দোলনকারীদের প্রথম দাবি ওমর আল বশিরের পতন নিশ্চিত হলেও দ্বিতীয় দাবিটি কি আদৌ পূরণ হবে? বেসামরিক সরকার কি সুদানে সত্যিই প্রতিষ্ঠিত হবে?

১৯৮৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা বশিরের বিরুদ্ধে দ্রব্যমূল্য ও জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা রূপ নেয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে। জনগণের দাবির মুখে ৩০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী ক্ষমতার মসনদ দখল করে পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল দেশটির সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা ও নবগঠিত সামরিক কাউন্সিলের প্রধান আওয়াদ ইবনে আউফ।

আন্দোলনকারীদের অভিযোগ পুনরায় উত্থাপিত হয় এবং বলা হয়, ‘আওয়াদ ইবনে আউফের সঙ্গে সাবেক প্রেসিডেন্ট বশিরের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে অর্থাৎ সেনাপ্রধান সাবেক প্রেসিডেন্টেরই বিশ্বাসযোগ্য প্রতিনিধি।’ পরবর্তী সময়ে ঘটনার মোড় নিল অন্যদিকে এবং আন্দোলন শুরু হয় সামরিক শাসন ও নব্য দায়িত্ব নেওয়া স্বৈরশাসক ওয়াদ ইবনে আউফের বিরুদ্ধে। আন্দোলনের ভয়াবহতা ও বৈদেশিক চাপের সামনে ক্ষমতাগ্রহণের মাত্র একদিনের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন সামরিক কাউন্সিলর আওয়াদ।

সাধারণ মানুষের প্রাণের দাবি বেসামরিক সরকার গঠন। সেই বেসামরিক সরকার কাজ করবে একমাত্র জনকল্যাণের স্বার্থে। জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সব অধিকার নিশ্চিত করবে, প্রতিষ্ঠিত হবে সুশাসন। প্রলেতারিয়েতরা স্বপ্ন দেখছে এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে আর কখনো রুটির মূল্যবৃদ্ধির জন্য সর্বস্তরের জনতাকে সরকার উৎখাতের আন্দোলন করতে হবে না; নিশ্চিত হবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ সব ধরনের অধিকার।

এখন আসি সুদানের সামরিক শাসনের লোকসানের হিসেবে। প্রথমেই বলে রাখি সামরিক প্রফেশনালিজমের কথা। সামরিক বাহিনীর প্রফেশন কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করা নয়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কারণ যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যে কাজে দক্ষ তাকে সেই কাজে পরিচালিত করাই রাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য মঙ্গলজনক। সুদানের মতো রাষ্ট্রে যেখানে অর্থনীতির অবস্থা আশঙ্কাজনক, সেখানে সামরিক শাসনের ফলে যদি সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী বুর্জোয়া শ্রেণির ভালো বাড়ি, ভালো গাড়ি, ভালো পোশাক, বিলাসবহুল জীবন ইত্যাদি প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় তখন কেবল বৈষম্যের প্রবৃদ্ধিই চিহ্নিত হবে না, বরং প্রচণ্ড সামাজিক ক্ষোভেরও জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। আর এই ক্ষোভ থেকে রাষ্ট্রের অধিকার বঞ্চিতরা প্রলেতারিয়েতদের চরিত্র নিয়ে পুনরায় বিপ্লবের স্বপ্ন দেখবে। এই সুযোগে পরাশক্তির দেশসমূহ নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে আদর্শতগত ইন্ধন জোগাবে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিবদমান পক্ষের মধ্যে কেউ নেবে বুর্জোয়া শ্রেণির পক্ষ, কেউ নেবে প্রলেতারিয়েতদের পক্ষ। ট্র্যাডিশনাল অ্যাপ্রোচ বা হিস্ট্রিক্যাল অ্যাপ্রোচের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ওই বিষয়ের কথাই বলছে।

একদিকে রাশিয়া সুদানের সামরিক হস্তক্ষেপকে সমর্থনের কথা জানিয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন বলছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যদি সুদানে রাষ্ট্রক্ষমতা বেসামরিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তবে সুদানকে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার রাষ্ট্র তালিকা থেকে মুছে ফেলার বিষয়টি বিবেচনা করবে। একটু মনে করিয়ে দিতে চাই, আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের সুদানের কথা অর্থাৎ ১৯৮৯ সালের প্রসঙ্গটি। তখনো কিন্তু কর্নেল ওমর আল বশির একদল সামরিক কর্মকর্তার সমর্থন নিয়েই রক্তপাতহীন এক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ক্ষমতা দখলের পরবর্তী পদক্ষেপটি ছিল বেশ ভয়াবহ। তিনি দেশটিতে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। মানুষের গণতন্ত্র চর্চার অধিকারকে হরণ করে ১৯৯৬ সালে তিনি একটি সাধারণ নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন এবং ওই নির্বাচনের একমাত্র প্রার্থী ছিলেন তিনি নিজেই। পরবর্তী সময় নিজেকে সুদানের প্রসিডেন্ট ঘোষণা করলেন। এরপর  যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয়েছিল সুদানকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়ার মাধ্যমে। 

আগামী দিনগুলোতে সুদান সঙ্কটের চিত্র যাই হোক না কেন, একটি বিষয় হলফ করে বলা যায় সুদানে তৈরি হবে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বিভাজন, যার ফলে হিংসা-বিদ্বেষ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে ফায়দা লুটবে পশ্চিমাবিশ্ব। যেমনটা লুটেছিল আফগান, সিরিয়া, মিশরে। তাই সুদানের সঙ্কট দূর করার জন্য বেসামরিক সরকারের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই। রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য শুধু সুদান নয়, যে কোনো রাষ্ট্রের উচিত অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো বহিঃরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমাধান করা। তাই সুদানের বর্তমান ক্ষমতাসীদের উচিত হবে রাষ্ট্রীয় কল্যাণের স্বার্থে সব সমস্যার যৌক্তিক ইতি টানা এবং সব দল-মত নির্বিশেষে অখণ্ডিত সংহতিপূর্ণ সুদান প্রতিষ্ঠা করা। যদি এই কাজে পুনরায় ব্যর্থ হয় সুদানীয় রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, তাহলে পরাশক্তির দেশগুলোর নিজ নিজ স্বার্থের বিষাক্ত ছোবলে সুদানের অবস্থা মধ্যপ্রাচ্যর দেশসমূহের থেকে ব্যতিক্রম কিছু হবে না।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads