• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মেয়েরা মারতে শেখো 

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

মেয়েরা মারতে শেখো 

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০৯ মে ২০১৯

নুসরাত নামের একটি সহজ সরল মেয়েকে ধর্ষণ এবং পরবর্তীকালে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় দেশব্যাপী শোক ও বিক্ষোভ এখনো চলছে। সাম্প্রতিককালে তনু হত্যার পর এত বড় জাগরণ আর দেখা যায়নি।  ইতোমধ্যে নুসরাতের হত্যাকারীদের কয়েকজন ধরা পড়েছে। স্বীকারোক্তিও দিয়েছে। তার মধ্যে নুসরাতের সহপাঠীও আছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় একজন নারী নুসরাতের হত্যা মিশনে অংশ নিয়েছিল। যে নারী মা, প্রেমিকা, কন্যা, বোন- সেই নারীই যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে এমন দু-একটি ঘটনা আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। এই তো কিছুদিন আগে স্বামীকে খুন করার পর তার লাশ বস্তাবন্দি করে বোনের বাসায় গিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে এলো এক নারী। ভাবা যায়! যাহোক নুসরাতের বাবা-মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নুসরাতের ভাইকে ব্যাংকে একটা চাকরি দিয়েছেন বলে জেনেছি। একটা মহান কাজ তিনি করেছেন।

আজকাল মেয়েদের পোশাক-আশাক নিয়ে কথা হয়। মেয়েদের পোশাকের কারণেই নাকি এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। আমি তো চারদিক তাকিয়ে বেশিরভাগ ফুলহাতা জামা পরা হিজাবে আবৃত নারীকেই দেখি। তাদের শরীরের কোনো অংশ চোখে পড়ে না মুখছাড়া। নুসরাতেরও তা-ই ছিল। তাহলে পোশাকের দোষ কীভাবে হলো? নুসরাত ইরানি বোরকা পরেছিল, তাই কাম উদ্রেক হয়েছিল বলে কথা উঠেছে।  ইরানি বোরকা আর নরমাল বোরকায় তফাত কী? কামের ব্যারোমিটার ইরানি বোরকার কারণে তড়াৎ করে ঊর্ধ্বমুখী হলো কোন হেতুতে? আমি অনেকক্ষণ বোরকার দিকে তাকিয়ে থেকেও বুঝতে পারিনি।

ধর্ষণ এদেশে প্রতিদিনই ঘটছে। দিনে-রাতে ঘটছে। স্কুল কলেজ মাদরাসা বাড়ি ঘর কর্মক্ষেত্র ক্ষেত মাঠ বাস ট্রেন এমনকি প্লেনেও ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। আশ্চর্যজনকভাবে এর ব্যাপকতা বেড়েছে। এখনকার বাবা-মা সন্তানদের আগলে রাখে বলে আমরা মাঝে মাঝে বাবা-মাকে দোষারোপ করি। বলি, ছেলেমেয়েগুলোকে ফার্মের মুরগি বানিয়ে ফেলছে। আমাদের সময়ে তো বাবা-মা আমাদের পাহারা দিয়ে রাখেনি। কখন স্কুলে গেছি, কখন ফিরেছি জানতেও পারেনি। কিন্তু আজকাল মনে হয়, এটা করা ছাড়া বাবা-মায়ের উপায়ই বা কী। এত প্রটেকশন, এত নজরদারির মধ্যেও তো মেয়েরা নিরাপদ নয়। ছেলেরাও কি নিরাপদ? আদৌ নয়। মাদরাসাগুলোতে কিশোর নির্যাতনের হার বেশি। কী এক অজ্ঞাত কারণে নারী নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনা যতটা প্রকাশ পায়, ছেলেদের ক্ষেত্রে তা পায় না। কারণটা বোধহয় এই যে, পুরুষকে বলাৎকার করলে তার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমাজে তার সতীত্ব মান-সম্মান নিয়ে অত ভাবনা নেই। কারণ সে পুরুষ। তাই পুরুষকে দু-চারবার বলাৎকার করলেও তা সে চেপে যায়। বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া উচ্চবাচ্য হয় না।

যাক, বলছিলাম নুসরাতের কথা। নুসরাত মাদরাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে মামলা করল। মামলা তুলে নেওয়ার জন্য উপর্যুপরি চাপ দেওয়ার পরও মামলা তোলেনি নুসরাত। প্রতিবাদ না করলে বা মামলা তুলে নিলে জীবন দিতে হতো না নুসরাতকে। কিন্তু নুসরাত সাহসী মেয়ে, জীবন দিল কিন্তু প্রতিবাদ করে গেল। এই যে এত বিক্ষোভ, এত আন্দোলন, এত কথা, টক শোতে এত মাতামাতি, নারীবাদীরা কিন্তু চুপ। কারণ নুসরাত মাদরাসায় পড়ত। এদেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে বলেই নুসরাত মাদরাসায় পড়েছে, চালু না থাকলে পড়ত না। যে মাধ্যমে তার জন্য সুবিধা হতো, সেটা পড়ত অথবা পড়ত না। একটা শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, সেখানে সে পড়েছে, ধর্ষিত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে। তারপরও তার মুক্তি নেই।

আমাদের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, আমরা বিভাজন করে ফেলি। আমরা যদি অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখি, তাহলে সবাই সমান বিচার পায়। কিন্তু আমরা অপরাধকে শ্রেণিবিন্যাস করি মানুষের ক্লাস হিসেবে। উচ্চশ্রেণির লোকের সঙ্গে অপরাধ করলে এক ধরনের ট্রিটমেন্ট, মধ্যম শ্রেণির সঙ্গে করলে আর একধরনের আর নুসরাতের মতো দরিদ্র মাদরাসার ছাত্রীর সঙ্গে করলে এক ধরনের। আমরা যারা আন্দোলন করি, ন্যায্যতার কথা বলি, আমরা নিজেরাও নিজেদের একটা শ্রেণিভুক্ত করে ফেলি। সে কারণে এদেশে সত্যিকার আন্দোলন কখনোই গড়ে ওঠে না। উঠবেও না।

আমাদের দেশে ধর্ষণের যে ব্যাপকতা, সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে অনেক আগে। কেন ক্রমান্বয়ে এই ব্যাপকতা বাড়ছে সব শ্রেণির মধ্যে? সেটা নিয়ে কোনো গবেষণা বা তেমন কার্যকর অনুসন্ধান ব্যবস্থা নেই। আমাদের চলচ্চিত্রে যে অশ্লীল নাচ গান দেখানো হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে টেনে টেনে যে ধর্ষণ দৃশ্যগুলো দেখানো হচ্ছে তা অবলীলায় সেন্সর ছাড় পেয়ে বেরিয়ে আসছে। হ্যাঁ, ধর্ষণ দৃশ্য বিদেশি চলচ্চিত্রেও দেখানো হয়। কিন্তু সেই দেখানোটা বাস্তবসম্মত দেখানো। আর এখানে যেটা দেখানো হয়, সেটা রীতিমতো সুড়সুড়ি দেয়। আর বয়স্ক শিক্ষকরা, হুজুররা, ট্রাক ড্রাইভাররা, ব্যাংকাররা যেটা করছেন সেটা রীতিমতো গর্হিত। তাদের কলঙ্ক কোনো নিন্দাবাক্যেই প্রকাশযোগ্য নয়।

এমনসব ধর্ষণের কথা আজকাল আমরা শুনছি, যা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। সৎবাবা মেয়েকে ধর্ষণ করছে, মা সেটা জেনেও গোপন রাখছে। ভাই বোনকে ধর্ষণ করছে। এমনকি পিতা কন্যাকে ধর্ষণ করছে, এমন খবরও পেয়েছি। ভাবলে কেমন যেন গা ঘিন ঘিন করে, কেমন যেন বমি বমি লাগে। এরা মানুষ! মাতৃগর্ভ থেকে এদের জন্ম!

ধষর্েণর অভিনব সব পন্থা আবিষ্কৃত হয়েছে। জোর করে একবার এক নারীকে ধর্ষণ করার পর ধর্ষণের কথা বলে দেবে, ছবি তুলে রেখেছে- এই ভয় দেখিয়ে তাকে চার পাঁচ বছর ধরে ধর্ষণ করছে। এই নারীকে অন্যদের ক্ষুধা মেটাতেও বাধ্য করেছে ধর্ষক। এতেও ধর্ষকের খায়েশ মেটেনি। এবার তার নজর পড়েছে মহিলার মেয়ের ওপর। মায়ের ধর্ষণের ছবি ফাঁস করে দেবে বলে মেয়েকে ধর্ষণ করার হুমকি দিচ্ছে। বিষয়গুলো আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আমরা স্বাধীন দেশে বাস করি। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ভালো। চেয়ে-চিন্তে খাই না। তারপরও কেন আমরা নিজেদের মতো করে বাঁচতে পারি না। এরা কারা? এত সাহস এরা পায় কোথায়? এদের ক্ষমতা, দাপটের উৎসমুখ কী? কোন ক্ষমতাধর ব্যক্তি, কোন পদবি, না টাকা? যে নারীর ঘরে পুরুষ নেই, স্বামী মারা গেছেন অথবা বিদেশে, ছেলে দূরে কাজ করে তার অবস্থা বড় করুণ। তাকে কিংবা তাদের মনে করা হয় নিতান্তই অসহায়। এ স্বাধীন দেশে কি নারীরা স্বাধীনভাবে একক সত্তা নিয়ে বাঁচতে পারবে না? তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য সবসময়ই একজন, একাধিক পুরুষ লাগবে!

অনেক যন্ত্রণার মধ্যেও নুসরাত মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দিয়ে গেছে। মৃত্যুর আগে বাঁচতে চেয়ে সে আকুতি জানালেও শেষ কর্তব্যটা করতে ভোলেনি। জবানবন্দিতে সে খুনিদের নাম-ধাম বিস্তারিত বলে বিচার দাবি করে গেছে। সে দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ সাহসী মেয়ে। মরার আগেও সে সাহস দেখিয়ে গেছে। কিন্তু এরপর কী? নুসরাতের খুনিদের কী সত্যিই বিচার হবে এ প্রশ্ন সবার মনে। আর এ প্রশ্ন মনে আসাও অবান্তর নয়। অতীত অভিজ্ঞতা সবার মনে এই প্রশ্নটারই জন্ম দিচ্ছে। তনু হত্যায় এত এত জোরালো প্রমাণ থাকার পরও তার হত্যার বিচার ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সে সেনানিবাসের মাঝখানে মারা গিয়েছিল। এটা এক অনেক বড় ঘূর্ণাবর্ত। বিচার হওয়া কি আদৌ সম্ভব?

খুব বেশি কিছু করার কিন্তু প্রয়োজন নেই। দু-চারটি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই কিন্তু ধর্ষকরা তাদের হাত-পা দাঁত গুটিয়ে নিত। আরেকটা কথা, কেন ধর্ষণ বাড়ছে এর কারণগুলো উদ্ঘাটন করা জরুরি। তা যদি না হয়, পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে, অচিরেই মেয়েদের লেখাপড়া চাকরি-বাকরি বাদ দিয়ে ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে হবে। কিন্তু হা হতোস্মি! ঘরেও তো সে নিরাপদ নয়! এই পরিস্থিতিতে মেয়েদেরও ধর্ষকদের মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। মেয়েরা, তোমরা কুংফু কারাতে জুডো শেখো। শেখো লাঠি চালনা। প্রয়োজনে বন্দুক চালাতেও জানতে হবে। তোমাদের দুর্বল পেয়ে কেউ তোমাদের সর্বনাশ করে মেরে ফেলবে, তা তো কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। তোমরা নিজেদের বাঁচাতে শেখো। বাঁচার জন্য মারতে শেখো।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads