• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
গ্যাসের অপচয় রোধ এবং তিতাসের ভূমিকা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

গ্যাসের অপচয় রোধ এবং তিতাসের ভূমিকা

  • মোহাম্মদ আবু নোমান
  • প্রকাশিত ০৯ মে ২০১৯

‘তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।’ এ কথাগুলো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের। বাংলা সাহিত্যে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের মধ্যে নিম্নবর্গ মানুষের আখ্যানসমৃদ্ধ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অমরকীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই উপন্যাসে গ্রামের দরিদ্র মালো শ্রেণির লোকজনের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পরবর্তীকালে এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।

এই একটি উপন্যাস লিখে লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ যেমন আকাশচুম্বী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন; তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই তিতাস নদীর তীরে বড় গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে একটি প্রগতিশীল জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে তিতাস গ্যাস তার সেবার মাধ্যমে জনগণের মাঝে ব্যাপক আস্থাভাজন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। প্রায় ৬৪ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত তিতাস নদীর উপকূলে প্রাপ্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম এ গ্যাসক্ষেত্রটি দেশের বিজ্ঞজনের মতামতের ভিত্তিতে তিতাস গ্যাসক্ষেত্র নামে পরিচিতি লাভ করে।

বাংলাদেশিদের বুকভরা আশার ও ভরসার সেই তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে আজ কিছু দুর্নীতিবাজ অপ্রতিরোধ্য ও উৎসবমুখর আখড়ায় পরিণত করেছে। দুর্নীতিতে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এতই সিদ্ধহস্ত যে, গ্যাস বিক্রি বেশি দেখিয়ে আত্মসাৎ করাসহ সিন্ডিকেট করে বিল ভাউচারে ভুয়া সংকেত দিয়ে অবৈধ গ্রাহকের কাছ থেকে বিল আদায় করে থাকে। ভুয়া সংকেত হওয়ায় সেগুলো তিতাসের ব্যাংক হিসাবে পোস্টিং এবং লেজারে এন্ট্রি করা হয় না। দুদকের অনুসন্ধানে আরো আশ্চর্যজনক খবর বেরিয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিনজিরা, ফতুল্লা, সোনারগাঁ, নরসিংদী ও গাজীপুর- এই পাঁচ এলাকায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫টি অবৈধ চুলা বা সংযোগ চিহ্নিত করা হয়। প্রতি মাসে প্রতি চুলা বাবদ ৬৫০ টাকা হারে ওই গ্যাসের দাম হয় ৯২ কোটি ৩৯ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে আবাসিকে ডাবল চুলা ও বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহকসমেত টাকার অঙ্ক প্রতি মাসে ওই অঙ্কের দ্বিগুণ হবে। যার এক পয়সাও সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। এটা হলো একটি দিক। এছাড়া দুদকের অনুসন্ধানে শিল্প-কারখানা, আবাসিকের আরো বহু দুর্নীতির দিক বেরিয়ে এসেছে, যেখান থেকে ফিমাসে শতকোটি টাকা উসুল করলেও সরকারের হিসাবে জমা হয় না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়-আশয় সরকারের সংশ্লিষ্টরা জানেনও না, বোঝেনও না!

সবসময়ই গ্যাসের নতুন সংযোগের জন্য বা অবৈধ সংযোগ বৈধ করার জন্য আবেদন করলে সেটি সহজে অনুমোদন পায় না। অদৃশ্য হস্তক্ষেপে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়; কিন্তু অবৈধ সংযোগ খুব কমই বন্ধ বা বৈধ করা হয়। এর কারণ হিসেবে দুদক বলছে, বৈধ সংযোগের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায় না। একটি অবৈধ সংযোগ নিতে তিতাসের কর্মচারীদের ৪৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। এ কারণেই তারা অবৈধ সংযোগকে বৈধ করতে আগ্রহী নন। ভ্রাম্যমাণ আদালত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও রাতের অন্ধকারে সেটি অর্থের বিনিময়ে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়।

দুদকের প্রতিবেদনের তথ্যে, তিতাস গ্যাসে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে। যার ফলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, তিতাসে ৬ শতাংশ সিস্টেম লস হয় অবৈধ সংযোগের কারণে। এটা কোনো সাধারণ খবর নয়! শতের মধ্যে ৬ শতাংশই সিস্টেম লস অনেক বড় খবর! ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে বিশেষ করে সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, জিনজিরা, ফতুল্লা, সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ গ্যাসলাইন সংযোগের তথ্য পাওয়া যায়। গৃহস্থালির চেয়ে শিল্পেই বেশি অবৈধ সংযোগ রয়েছে।

এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের কম মূল্যে গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার নিয়ম থাকায় অনেক সময় অর্থের বিনিময়ে বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহক যেমন- হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বেকারি, সুপারশপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে শিল্প শ্রেণির গ্রাহক হিসেবে সংযোগ দেওয়া হয়। আর এ জন্যই তিতাসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে অর্থের বিনিময়ে শিল্প এলাকায় পোস্টিং নিয়ে থেকে খুব সহজেই সিন্ডিকেট গড়ে দুর্নীতি করেন। অবৈধ সংযোগের পাশাপাশি মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমেও অসাধু কর্মকর্তা ঘুষের বিনিময়ে গ্রাহকের প্রকৃত বিল গোপন করে থাকেন। এভাবে কোম্পানির কোটি কোটি টাকা লোকসান হয়। এ বিষয়ে কোম্পানির তদারকির অভাব রয়েছে বলে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

সচেতন মহলের অভিমত, জ্বালানি খাতে লাগামহীন দুর্নীতি বন্ধ না করে শুধু মূল্য বৃদ্ধি কাম্য নয়। গ্যাসের দাম না বাড়িয়ে প্রিপেইড মিটার লাগালে অপচয় যেমন বন্ধ হতো তেমনি আয়ও বাড়তো বহুগুণ। তাই সবার আগে গ্যাস অপচয় বন্ধ ও গ্যাস কোম্পানির কর্মকর্তাদের যোগসাজশে চোরালাইনের চোরাকারবারি বন্ধ করতে হবে। এসব দুর্নীতির ব্যাপারে কখনোই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই সরকার গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। জনগণের প্রতি কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা না থাকলেই সরকার যা খুশি তা করতে পারে। প্রতিবারই গণশুনানিকালে প্রমাণিত হয়েছে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো দরকার নেই। গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগে গ্রাহক, বিশেষজ্ঞ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মতামত নিতে গণশুনানির ব্যবস্থা যেমন আছে, তেমনি গণশুনানি দরকার জনগণের আয়-ব্যয়ের ওপরও।

সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্যসহিষ্ণুতার যে ঘোষণা দিয়েছে, তিতাসকে সে ঘোষণা বাস্তবায়নে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বহুমাত্রিক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। জড়িতদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত শূন্যসহিষ্ণুতার নীতি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিকে কার্যকরভাবে অনুসরণ করতে হবে। বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : নিবন্ধকার

abunoman1972@gmail.com

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads