• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
সুপেয় পানির শরবতে অরুচি কেন

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সুপেয় পানির শরবতে অরুচি কেন

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১১ মে ২০১৯

শরবত একটি মজাদার পানীয়। পারিবারিক বা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার ব্যাপক। মেহমান বাড়িতে এলে প্রথমেই এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা আমাদের আতিথেয়তার ঐতিহ্য। আগে বিয়েবাড়িতে বরযাত্রীদের প্রথমেই শরবত দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। এখন অবশ্য সে প্রচলন অনেকটাই কমে গেছে। নানা ধরনের বোতলজাত পানীয়’র দাপটে শরবত এখন অনেকটাই কোণঠাসা। তারপরও পারিবারিক অতিথি আপ্যায়নে শরবতের ব্যবহার কমে যায়নি। সে শরবত এবার গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম হয়েছে ঢাকা মহানগরবাসীকে পানি সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষ ঢাকা ওয়াসার এমডি মহোদয়ের বদান্যতায়। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ ও সুপেয়’- এমডি সাহেবের এ মন্তব্য শুনে এক নগরবাসী সম্প্রতি সপরিবারে ওয়াসা অফিসে গিয়েছিলেন তাকে সেই পানির শরবত খাওয়ানোর জন্য। কিন্তু এমডি সাহেব অফিসে অনুপস্থিত থেকে বিশুদ্ধ পানির শরবত গলাধঃকরণের ঝামেলা এড়িয়ে গেছেন। গত ২৪ এপ্রিল প্রায় সব দৈনিকে খবরটি বেশ গুরুত্বসহকারেই প্রকাশিত হয়েছে।

কাহিনীর সূত্রপাত মাসখানেক আগে। গত ১৭ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি ‘ঢাকা ওয়াসা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি নিম্নমানের হওয়ায় নগরীর ৯১ শতাংশ মানুষ তা ফুটিয়ে পান করে। এতে বছরে প্রায় ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকার গ্যাস অপচয় হয়। টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেন ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান। তিনি এর তিন দিন পর ২০ এপ্রিল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন যে, ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি ‘শতভাগ বিশুদ্ধ ও প্রতিটি ফোঁটা সুপেয়’। টিআইবির প্রতিবেদন একেবারেই গবেষণামূলক নয় এবং সেটা একপেশে ও ধারণামূলক বলেও মন্তব্য করেন ওয়াসা এমডি। গণমাধ্যমে এ খবর জানতে পেরে রাজধানীর ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান গত ২৩ এপ্রিল ওয়াসার এমডি সাহেবকে তাদেরই সরবরাহ করা ‘বিশুদ্ধ পানি’র শরবত পান করাতে বন্ধু ও স্ত্রী-কন্যাসহ চলে আসেন কারওয়ান বাজারস্থ ওয়াসা কার্যালয়ে। এ খবর পেয়ে এমডি সাহেব সেদিন আর অফিসমুখো হননি। অন্যদিকে পুলিশ এবং ওয়াসার নিরাপত্তা প্রহরীরা মিজানুরদের অফিসে ঢুকতে বাধা দেয়। তারা অফিসের সিঁড়িতেই বসে পড়েন। এ সময় তাদের হাতে ছিল ‘আর কত কালা পানি খাওয়াবেন?’, ‘দূষিত পানির ওয়াসা’, ‘পানি দাও ময়লা নয়’, ‘দূষিত পানির দায় নিতেই হবে’ ইত্যাদি স্লোগান সংবলিত পোস্টার। ঘণ্টাখানেক পরে গণমাধ্যমকর্মীসহ তাদের অফিসের ভেতরে ডেকে নেন ওয়াসার পরিচালক (টেকনিক্যাল) একেএম সহিদউদ্দিন। তিনি দূষিত পানির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করলেও অভিযোগকারীদের সঙ্গে আনা পানি দিয়ে শরবত খেতে রাজি হননি। পরিচালক সহিদউদ্দিন ওই পানি ওয়াসার কি-না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ সময় মিজানুর রহমান বলেন, ২০১২ সালে দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানির বিষয়ে সাড়ে তিন হাজার স্বাক্ষরযুক্ত এলাকাবাসীর একটি দরখাস্ত তারা ওয়াসাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তিনি আরো অভিযোগ করেন, সেই দূষিত ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি সরবরাহ এখনো অব্যাহত রেখেছে ওয়াসা। জুরাইন এলাকায় ওয়াসার যে পানির লাইন রয়েছে তা চল্লিশ বছরের পুরনো এবং তাতে যে পানি সরবরাহ করা হয় তা পান করা তো দূরের কথা, দুর্গন্ধে হাতেই নেওয়া যায় না।  যেহেতু ওয়াসার এমডি তাদের পানিকে বিশুদ্ধ ও সুপেয় বলেছেন, তাই সে পানি দিয়ে শরবত বানিয়ে তাকে খাওয়াতেই তারা এসেছিলেন। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পরিচালক সহিদউদ্দিন বলেন, ঢাকার কোথাও দূষিত পানি নেই। তিনি ২০১২ সালে জুরাইনবাসীর দেওয়া দরখাস্তের কথাও অস্বীকার করেন।

ঘটনাটি চমকপ্রদ সন্দেহ নেই। বিশেষ করে মিজানুর রহমানের প্রতিবাদের কায়দাটি অভিনব। তার এ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে বসবাসকারী মানুষগুলোর নিত্যদিনের ভোগান্তির একটি বিষয় সবার নজরে এসেছে। এক্ষেত্রে টিআইবি ধন্যবাদার্হ এ জন্য যে, তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে মানুষের জীবন ধারণের একটি অতিপ্রয়োজনীয় বিষয় সামনে চলে এসেছে। একই সঙ্গে তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও অবহেলার বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। ওয়াসার এমডি ওই প্রতিবেদনকে গবেষণামূলক নয় বললেও সচেতন নগরবাসীর কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কারণ তাতে ঢাকা মহানগর অঞ্চলে পানি সরবরাহের অব্যবস্থা ও দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেছে। একই সঙ্গে প্রতিভাত হয়ে উঠেছে ওয়াসার গাফিলতির বিষয়টিও। ফলে এমন একটি সত্য প্রকাশিত হওয়ার পর সংস্থার শীর্ষকর্তার নাখোশ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আর ওয়াসার এমডির নাখোশ হওয়ার বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তার বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি তার সংস্থাকে সম্পূর্ণ ‘দুর্নীতিমুক্ত’ বলেছেন। হতে পারে এমডি তাকসিম এ খান একজন সৎ মানুষ। তাই তিনি তার সংস্থায় কর্মরত অপরাপর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদেরও সৎ মনে করছেন। কিন্তু তিনি কি জানেন, তার সংস্থার কোন কর্মচারীর ঢাকায় কয়টি বাড়ি আছে, কত ভূ-সম্পদ, টাকা-কড়ি আছে?  ওয়াসার একজন লাইনম্যান, পাম্প অপারেটর, মিটার রিডার কী পরিমাণ অর্থ গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন, তা বোধকরি এমডি মহোদয়ের জানা নেই। ওইসব জানতে হলে তাকে খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলের খলিফাদের মতো ছদ্মবেশে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। একই সঙ্গে তিনি যদি তার সংস্থার কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সহায়-সম্পত্তির খোঁজখবর নেন, তাহলে যে তাকে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হবে, তাতে আমার অন্তত সন্দেহ নেই। তাকে জানতে হবে কীভাবে মিটারের কাঁটা পেছন দিকে ঘোরানো হয়, তাকে তত্ত্ব-তালাশ করতে হবে এই নগরে কত হাজার অবৈধ পানির লাইন রয়েছে। তাকে এটাও খোঁজ নিতে হবে বৈধভাবে একটি পানির লাইন পেতে একজন গ্রাহককে কত ঘাটে কত কী ঢালতে হয়, কতজনকে খুশি করতে হয়। একটি সংস্থার সর্বোচ্চ পদে অবস্থানকারীর পক্ষে মাঠে-ময়দানে নেমে এভাবে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয় সেটা স্বীকার্য। তবে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অভিযোগ আহ্বান করলে এর একটি চিত্র সহজেই পাওয়া যেতে পারে। ওয়াসাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে তেমন পদক্ষেপ তাকসিম এ খান গ্রহণ করে দেখতে পারেন।

ওয়াসার পানি বা সেবা নিয়ে নগরবাসীর অভিযোগ নতুন নয়। বহু বছর ধরেই এ সংস্থাটির কাজ-কর্মে নগরবাসী ক্ষুব্ধ। পানির অভাবে মহিলাদের শূন্য কলস বা ঝাড়ু মিছিলের নজির তো নিকট অতীতেই আছে। বেশ কয়েক বছর আগে শনিরআখড়া এলাকায় পানির দাবিতে বিক্ষোভরতদের সামনে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিলেন তৎকালীন সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য। এরকম মিছিল-বিক্ষোভ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রায়ই হয়। ওয়াসার পানিতে জোঁক, ছোট মাছ, ব্যাঙাচি (ব্যাঙের বাচ্চা), নানা ধরনের জলজ কীটপতঙ্গ, শ্যাওলা ইত্যাদি  পাওয়ার খবর মাঝে-মধ্যেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এমনকি সরবরাহ করা পানিতে মানুষের মল-মূত্রের ‘সুবাস’ পাওয়ার খবরও ইতঃপূর্বে পাওয়া গেছে। এসব কথা ওয়াসার এমডি সাহেব না জানলেও ভুক্তভোগী নগরবাসীর ভালো করেই জানা আছে। আর এমডি সাহেবের এসব জানার কথাও নয়। কারণ তিনি তো আর পাইপ দিয়ে আসা পানি পান করেন না। তার জন্য ঘরে-বাইরে রেডি আছে বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি। তাছাড়া তিনি কত ব্যস্ত মানুষ! এই মিটিং, সেই মিটিং, এখানে সেমিনার, ওখানে আলোচনা সভা, কত কিছু করতে হয় তাকে! তার ওপর আছে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশ সফর। এর বাইরে যেটুকু সময় পান, তা তো ফাইলে সই করতেই ব্যয় হয়ে যায়। ফলে ওয়াসার সেবাদানের মাঠ পর্যায়ের হালহকিকত সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার ফুরসৎ তার কোথায়? কিন্তু মিজানুররা জানে ওয়াসার পানির কী গুণ! কারণ, তারা ওই পানিতেই রান্নাবান্না, কাপড় কাঁচাসহ সব কাজ করেন। এমনকি তা চুলোয় ফুটিয়ে পানোপযোগী করেন। ফলে ওয়াসার পানির প্রকৃত খবর তো মিজানুরের মতো ভুক্তভোগীরাই রাখবেন। ওয়াসার পানি নিয়ে সর্বশেষ যে খবর পত্রিকায় এসেছে তা রীতিমতো পিলে চমকানো। গত ৬ মে’র সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসার ৯০০ পাম্পের মধ্যে অন্তত ৪০০ পাম্পেই পানি পরিশোধন করা হয় না। গভীর নলকূপের পানির সঙ্গে পরিমিত ক্লোরিন মিশিয়ে পাইপে পানি সরবরাহ করার কথা থাকলেও ওইসব পাম্পে তা করা হচ্ছে না। ফলে ঢাকা মহানগরীর অধিবাসীদের একটি বিরাট অংশই অপরিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে। এ বিষয়ে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেননি।

যাহোক, শরবত পানের ভয়ে ওয়াসার এমডির পালিয়ে যাওয়া নগরবাসীকে বিস্মিত করেছে সন্দেহ নেই। তার সংস্থার কয়েকজন সেবাগ্রহণকারী এসেছিল তারই ঘোষিত ‘বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানি’র শরবত তাকে পান করাতে। কিন্তু সে শরবত পানের সৎ সাহস তিনি দেখাতে পারেননি। তার এ আচরণ মিজানুরের অভিযোগকে আরো শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। একই সঙ্গে প্রকারান্তরে তিনি এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া তার বক্তব্য অসত্য। মজার বিষয় হলো, ঘটনার একদিন পর গত ২৪ এপ্রিল তাকসিম খান মিজানুরের শরবত কর্মসূচিকে ‘নাটক’ বলে অভিহিত করেছেন। বলেছেন, মিজানুরের মানসিক সমস্যা রয়েছে। একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার এ ধরনের বক্তব্য কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রতিবাদ করলেই যদি তা নাটক হয় এবং প্রতিবাদকারী হন মানসিক রোগী, তাহলে তো সমাজে কোনো অন্যায়েরই কেউ প্রতিবাদ করবেন না। তবে এসবের জন্য ওয়াসার এমডিকে হয়তো তেমন কোনো প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হবে না। কারণ আমাদের দেশে এসব কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না। উল্টো জুরাইনের মিজানুর রহমানের কপালে দুর্ভোগ নেমে আসার আলামত দেখা যাচ্ছে। গত ২৫ এপ্রিলের পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, ওয়াসার কর্মচারীরা মিজানুরকে হুমকি দিতে শুরু করেছে। এরপর হয়তো খবর হবে তার বাড়ির পানির লাইনটি রাতারাতি অবৈধ হয়ে গেছে! সব সম্ভবের এ দেশে কত কিছুই তো ঘটে। সাধে কী আর আলেকজান্ডার তার সেনাপতি সেলুকাসকে বলেছিলেন- ‘কী বিচিত্র এই দেশ, সেলুকাস!’

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads