• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
উদিত সূর্যের দেশে নতুন সম্রাট

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

উদিত সূর্যের দেশে নতুন সম্রাট

  • মাহবুবউদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ১১ মে ২০১৯

ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে পুবের দেশ বলে খ্যাত জাপান। ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হিসেবে একসময় খ্যাতি ছিল জাপানের। সেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করে এখন দেশটি অর্থনীতিতে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধিশালী দেশ। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সেখানে রয়েছে দীর্ঘদিনের সম্রাট-শাসিত ব্যবস্থা। যদিও কালবিবর্তনে এখন তা প্রতীকী মাত্র। কিন্তু দেশের জনগণ সম্রাটকে তাদের দেবতুল্য মনে করে থাকেন। তাই আজো এ ব্যবস্থার কোনো পালাবদল ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রীশাসিত দেশে সম্রাট নিয়মতান্ত্রিক প্রধান মাত্র। সম্প্রতি দেশটিতে নতুন সম্রাট হিসেবে শপথ নিলেন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবরাজ নারুহিতো।

১ মে ২০১৯ থেকে জাপানের সিংহাসনে নতুন সম্রাট হিসেবে নারুহিতোর আবির্ভাব। ৩০ এপ্রিল ২০১৯ জাপানের রাজপরিবারের ঐতিহ্যের ছেদ ঘটিয়ে দুইশ বছরের মধ্যে প্রথম সম্রাট হিসেবে স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করলেন নারুহিতোর পিতা সম্রাট আকিহিতো। বয়স ও অবনতিশীল স্বাস্থ্যের কারণে নিজের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না বিধায় ৮৫ বছরের বৃদ্ধ সম্রাটকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ বা সিংহাসন ত্যাগ করতে হয়। ১ মে ২০১৯ সম্রাট আকিহিতোর জ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ নারুহিতো সিংহাসনে আরোহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে নারুহিতো এবং তারই স্ত্রী মাসাকো ওয়াদা সম্রাজ্ঞী হিসেবে জাপানের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন। জাপান আজ বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত। রাতারাতি জাপানের এ অবস্থা বদলায়নি। ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপ, দূরদৃষ্টি, কর্মক্ষমতা, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা ও ভদ্রতা জাপানকে আজ সাফল্যের স্বর্ণ শিখরে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।

যুবরাজ নারুহিতো জাপানের ১২৬তম সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫৯ বছর বয়সী নারুহিতো অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন এবং মাত্র ২৮ বছর বয়সে জাপানের যুবরাজ হন। বর্তমান সম্রাজ্ঞী মাসাকা ওয়াদা যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় কথা বলতে পারেন। স্বভাবে খুবই শান্ত ও দৃঢ়চেতা। তিনি কোনো রাজ পরিবারের মেয়ে নন। তিনি জাপানের শিল্পপতি পরিবারের মেয়ে। ওয়াদার শাশুড়ি সদ্যবিদায়ী সম্রাজ্ঞী মিচিকোও একজন শিল্পপতির মেয়ে। বর্তমান সম্রাটের পিতা  আকিহিতো ১৯৫৯ সালে যুবরাজ থাকতে সাধারণ পরিবারের মেয়ে মিচিকোকে বিয়ে করেছিলেন। সেজন্য বলা হয়, জাপান রাজপরিবারের জন্য আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন আকিহিতো। স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর বর্তমান সম্রাজ্ঞী মাসাকো ওয়াদা যুক্তরাষ্ট্রে লোভনীয় চাকরির প্রস্তাব লাভ করা সত্ত্বেও তিনি তা ফিরিয়ে দেন। তিনি দেশের জন্য কাজ করতে বেশী উৎসাহ বোধ করেন। ১৯৮৫ সালে দেশে ফিরে এসে আরো অনেক ডিগ্রি লাভের পর টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেন। সেখানে ৩ জন পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যে তিনিও একজন। ছয় মাস পর জাপানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরির জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৮০০ জনের মধ্যে মাত্র ৩০ সফল প্রার্থীর অন্যতম একজন ছিলেন সম্রাজ্ঞী মাসাকো ওয়াদা। ওয়াদা স্কি, টেনিস, বাস্কেটবল খেলতে ভালোবাসতেন। তিনি ভদ্র, নম্র, শান্ত, ধীরস্থির, কূটনীতিক ও বুদ্ধিমতী। আস্থাবোধ ও সিরিয়াসনেস তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দুর্লভ ব্যক্তিত্বের এবং দয়ামায়া ও মানবিক গুণের অধিকারিণী।

যুবরাজ থাকা অবস্থায় বর্তমান সম্রাট নারুহিতোর জন্য ৬ বছর ধরে কনে খোঁজা হয়। রাজপ্রাসাদ কর্মীরা ১০০ তরুণীকে সম্ভাব্য কনে হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু নারুহিতো সবাইকে নাকচ করে দেন। কারণ তিনি ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম ওয়াদাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। একটি চায়ের আসরে বর্তমান সম্রাজ্ঞী ওয়াদার সঙ্গে বর্তমান সম্রাট নারুহিতোর পরিচয়ের সূত্রপাত। ওই বছরই তাদের ‘বাগদান’ হয়। পরে ১৯৯৩ সালে তাদের বিয়ের পর এই দম্পতির একমাত্র মেয়েসন্তান প্রিন্সেস আইকোর জন্ম হয় ২০০১ সালে। যদিও জাপানের বর্তমান আইন অনুসারে কোনো নারী সিংহাসনে বসতে পারেন না, যে কারণে প্রিন্সেস আইকো সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী নন। সম্রাট নারুহিতোর পর উত্তরাধিকারীর তালিকায় রয়েছেন তার ছোট ভাই ফুমিহিতো। এরপর রয়েছেন ফুমিহিতোর সন্তান হিসাহিতো। জাপানের সম্রাটের যদিও কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই, তবু তাকে জাতীয় প্রতীক হিসেবে জাপানিরা দেখে থাকেন। সম্রাট আকিহিতোর দায়িত্ব ত্যাগ ও নতুন সম্রাট নারুহিতোর দায়িত্ব গ্রহণের অনুষ্ঠান বা আয়োজন উৎসবের মতো আকার ধারণ করেছিল জাপানে। অথচ ৩০ বছর আগে যখন আকিহিতো তার পিতার মৃত্যুর পর সম্রাট হন, তখন গোটা দেশ (জাপান) শোকের সাগরে ভাসছিল। জাপানের রাজবংশ বিশ্বের পুরনো রাজকীয় পরিবার। পৌরাণিক কাহিনীতে বলা, যিশুখ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে থেকে এই রাজতন্ত্র চলছে। একসময় জাপানের সম্রাটদের ঈশ্বরের মতো করে দেখা হতো। তবে সম্রাট আকিহিতোর পিতা অর্থাৎ নতুন সম্রাট নারুহিতোর দাদা সম্রাট হিরোহিতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের পর তার সেই দেবত্ব ত্যাগ করেন।

১৯৮৫ সালে জাপানের আকাসাকা রাজকীয় প্রাসাদে জাপানের বিদায়ী সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকোর সঙ্গে বাংলাদেশ-জাপান যুব মৈত্রী সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের যুব প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তখনই আমাকে জানানো হয়েছিল যে, আকাসাকা প্রাসাদের ভেতরে রাজকীয়দের সঙ্গে দেখা করার সময় পকেটে হাত রাখা যাবে না এবং হাত তুলে কথা বলা নিষেধ ইত্যাদি। সাক্ষাতের সময় তৎকালীন সম্রাট আকিহিতো ও সম্রাজ্ঞী মিচিকো বাংলাদেশের বন্যা, দরিদ্রতা, ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় বলে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, জাপান সবসময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে। কেননা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি জাপানের দুর্বলতা রয়েছে। তারা যুবরাজ ও যুবরাজ্ঞী থাকার সময় ১৯৭৫ সালের ২১-২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফরের সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা উভয়েই বাংলাদেশ ও জাপানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো জোরদারের কথা ব্যক্ত করি। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশের হাজারো তরুণ একসময় জাপানে চাকরির সুবাদে গিয়ে আজ দেশে প্রতিষ্ঠিত। আশা করি, জাপানের নতুন সম্র্রাট নারুহিতোর আগমনের ফলে বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার সুসম্পর্ক আরো চমৎকার হবে। জাপানের নতুন সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকো ওয়াদার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিকনির্দেশনা জাপানকে যেমন বিশ্বদরবারে নতুন আঙ্গিকে তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে সহায়তা করবে, তেমনি অন্যান্য দেশের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদারকরণে সহায়ক হবে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক অতীতের মতোই বন্ধুত্বপূর্ণ গভীরতায় স্থায়ী হবে বলে বিশ্বাস করি।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads