• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ধর্ষণ প্রতিরোধে চাই আইনের সর্বাত্মক প্রয়োগ

  • প্রকাশিত ১৪ মে ২০১৯

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান

 

ধর্ষণ একটি জাতীয় সমস্যা এবং এর নিরসন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। আমাদের দেশে কিছুদিন পরপর কোনো না কোনো নারী বা শিশু ধর্ষণের খবর এখন মামুলি ব্যাপার যেন। কোনো একটি ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চলে জনসাধারণের জোরদার আন্দোলন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন শুরু হয়। অনেকেই রাস্তায় নেমে আসেন ওই ধর্ষণ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে। তখন ওই ধর্ষণের ঘটনা ও আন্দোলন নিয়ে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সবাই নিউজ কাভারেজে থাকেন সরব। সরকার কিছুটা চাপে পড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সাময়িকভাবে ওই নির্যাতনের ঘটনায় কিছু ইতিবাচক ভূমিকা গ্রহণ করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এভাবেই ধারাবাহিকভাবে চলছে একই দৃশ্যপট, কেবল প্রেক্ষাপটগুলো ভিন্ন হয়। জনমনে প্রশ্ন থেকে যায়, এই দৃশ্যপটগুলোর অবসান কোথায়?

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে (২০১৪-১৮) ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের চেষ্টা এবং ধর্ষণজনিত হত্যার শিকার হয়েছে অন্তত প্রায় ৪ হাজার নারী ও শিশু। এই তথ্যটি বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও নিজস্ব তদন্ত থেকে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে ১৯ হাজারের বেশি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। তাদের বক্তব্য, দেশে যত নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, সে তুলনায় মামলার সংখ্যা কম। অনেকেই ঝামেলা মনে করে মামলা করতে চান না। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন, ২০১৫ সালে ৫২১ জন, ২০১৬ সালে ৪৪৬ জন, ২০১৭ সালে ৫৯৩ জন এবং ২০১৮ সালে ৫৭১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে প্রায় দু’শতাধিক শিশু।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে যে হারে ধর্ষণের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, তার অতি নগণ্য পরিমাণ বিভিন্ন তথ্যে উঠে আসছে। প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। অধিকাংশ ধর্ষণজনিত ঘটনা প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ধামাচাপা দেওয়া হয়। আবার অনেকেই আছেন, ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরও সামাজিকভাবে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার ভয়ে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চান না। সর্বোপরি ধর্ষণের অভিযোগে থানায় মামলা করার পর বিভিন্ন আইনি জটিলতা ও হয়রানির কথা চিন্তা করে অনেকেই মামলা করা হতে বিরত থাকেন। বিশেষ করে, ধর্ষণের সুরতহাল রিপোর্ট করেন পুরুষ ডাক্তার ও পুলিশ। এটাও অনেকের কাছে গণধর্ষণের মতোই মনে হয়। এ ছাড়া মামলা করার পর নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন অধিকাংশ ধর্ষিতা। অনেককেই বিচার চেয়ে মামলা করে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত নিজের প্রাণ পর্যন্ত দিতে হয়, তবু বিচার পাওয়া যায় না। এসব অনেক সমস্যার কারণে অধিকাংশ ধর্ষণের ঘটনা মাটিচাপা পড়ে।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার মতে, ধর্ষণের মতো অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অধিকাংশ পুলিশ ঘুষ নেয়। ধর্ষিতাকে সহযোগিতার পরিবর্তে উল্টো বিভিন্নভাবে হয়রানি করে। আবার অনেক পুলিশ আছে, মামলা পর্যন্ত নিতে চায় না। তাদের কারণে বিভিন্নভাবে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করেও ধর্ষক পার পেয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তবে সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় উল্লেখ আছে, ধর্ষণ বা ধর্ষণ-পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে এবং পাশাপাশি সর্বনিম্ন ১ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এমন একটি কঠিন আইন থাকা সত্ত্বেও এর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। যার কারণে আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা সীমা ছাড়িয়ে মহামারী আকার ধারণ করেছে।

জামিন অযোগ্য অপরাধ হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্নভাবে ধর্ষণ মামলার আসামি জামিন পেয়ে যায়। টাকা-পয়সা খরচ করে কিংবা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ধর্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে যায়। একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মামলা হয়েছে ৭ হাজার ৮৬৪টি। এ সময় মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি। সাজা হয়েছিল ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস পেয়ে গেছে। নারীপক্ষের এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলায় ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে করা তিন হাজার ৬৭১টি মামলায় মাত্র চারজনের সাজা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি আর অদক্ষতার কারণে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। অনেক সময় আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযোগ্যতা ও গাফিলতি থাকে। অনেক সময় টাকা খেয়ে মামলা ঘুরিয়ে দেওয়ার অনেক ঘটনাও রয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ করে। সামাজিকভাবে ধর্ষণের মতো অপরাধ অতি ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। ধর্ষণের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে অনেক ইতিবাচক বিবৃতি পাওয়া যায়। তবু আশাহত হতে হয় যখন দেখি আইনের চোখকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ধর্ষক বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে করে জনমনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আইন ও প্রশাসন দুর্বলকে রক্ষার জন্য নয়?  আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার এ বিষয়ে আরো অধিক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। দলমত নির্বিশেষে দেশে প্রচলিত আইনে প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিতে হবে অচিরেই। এক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিই সাধারণের কাম্য। সর্বোপরি ধর্ষণের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে এবং সেটা অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প নেই।

 

লেখক : লোক গবেষক

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads