• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
খাদ্যে ভেজাল, পানিও দূষিত

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

খাদ্যে ভেজাল, পানিও দূষিত

  • শাহ আহমদ রেজা
  • প্রকাশিত ১৬ মে ২০১৯

শুনতে খারাপ লাগলেও কঠিন সত্য হলো, বাংলাদেশে পবিত্র রমজান শুরু হলে শুধু নয়, রমজানকে কেন্দ্র করে কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ের চিহ্নিত গোষ্ঠীগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ব্যবসায়ী-মহাজনদের কথা তো বলাইবাহুল্য। এমন কোনো বছরের উল্লেখ করা সম্ভব নয়, যে বছরের রমজানে তারা মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি বাড়ানোর অপকর্মে ঝাঁপিয়ে না পড়েছে। এবারো ব্যতিক্রম হয়নি। একের পর এক পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন ব্যবসায়ী-মহাজনরা। পেঁয়াজ-রসুন এবং ডাল ও ছোলা থেকে বিভিন্ন ধরনের সবজির তো বটেই, মাত্র দিন দশেকের ব্যবধানে চিনি, লবণ ও সয়াবিনসহ সব নিত্যপণ্যেরই দাম বাড়ানো হয়েছে।

গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, প্রথম রমজানের আগেরদিন কমবেশি ৪৫০ কেজি দরের দেশি মুরগি বিক্রি হয়েছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা করে। সে হিসাবে দেশি মুরগির দাম গরুর মাংসের চাইতেও বেশি পড়েছে। এখনো বেশিই নেওয়া হচ্ছে। কারণ বড় বড় কিছু ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছাড়া সাধারণ বাজারে একই দিন প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হয়েছিল কমবেশি ৫৫০ টাকা দরে। ওদিকে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৫২৫ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। খাসির মাংসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৫০ টাকা।

কিন্তু খোলা কোনো বাজারেই সরকার তথা সিটি করপোরেশন নির্ধারিত দামে গরু বা খাসির মাংস বিক্রি করতে দেখা যায়নি। এখনো দেখা যাচ্ছে না। ক্রেতারা অভিযোগ করেছেন, খোলা বাজারের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও মুরগি ও মাংসের দাম বেশি রাখা হচ্ছে। কোনো কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আবার চাতুরিপূর্ণ কৌশল খাটিয়ে একই গরুর মাংসকে নানা নামে ভাগ করে ৭৮০, এমনকি ৮৫০ টাকারও বেশি দরে বিক্রি করা হচ্ছে। খাসির মাংসের বেলায়ও বিক্রেতারা সরকার ও সিটি করপোরেশনের বেঁধে দেওয়া দর মেনে চলছেন না। ফলে অত্যধিক দামে মুরগি ও মাংস কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

মাংসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয়েছে মাছের দামও। এমনিতেই বেশ কিছুদিন ধরে বাজারে মাছের সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছিল। মাছ পাওয়া যাচ্ছিল না বললেই চলে। তার ওপর রমজান এসে যাওয়ায় পরিপূর্ণ সুযোগ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্যবসায়ী নামের দুর্বৃত্তরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম ধরনের যুক্তি দেখিয়ে তারা যথেচ্ছভাবে মাছের দাম বাড়িয়ে চলেছে। ফলে মাছের দাম চলে গেছে সাধারণ মানুষের সাধ্যের অনেক বাইরে। অথচ রমজানে সুস্থ থাকার প্রয়োজনে রোজাদাররা সাধারণত মাংসের চাইতে মাছই বেশি খেয়ে থাকেন। সে মাছ এখন পাওয়াই যাচ্ছে না।

ওদিকে শাক-সবজির পাশাপাশি ফলের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে। রমজানের শুরুতেই প্রতি কেজিতে সব ধরনের ফলের দাম বেড়েছে ২০/৩০ থেকে ৫০/৬০ টাকা। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ কেজিতে ১০০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে নাশপাতির দাম। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রয়েছে খেজুর। প্রতি কেজিতে এর দাম বেড়েছে ৩০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত। প্রতিটি বেল বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা দরে— কয়েকদিন আগেও যার দাম ছিল ২৫ থেকে ৩০ টাকার মধ্যে। আম, লাল ও সবুজ আপেল, লিচু, আঙুর, মাল্টা, বেদানা, আনারস ও বাঙ্গিসহ এমন কোনো ফলের কথা বলা যাবে না, রমজানের শুরুতেই যার দাম না বেড়েছে। অথচ রমজানে বিশেষ করে ইফতারির সময় রোজাদাররা বেশি পরিমাণে ফল খেয়ে থাকেন। অনেকে ইফতারি শুরুই করেন খেজুরের মতো ফল দিয়ে। অন্যদিকে সে ফলই সাধারণ মানুষের নাগালের অনেক বাইরে চলে গেছে।

আরো কিছু কারণেও এবারের রমজানে মানুষের কষ্ট ও ভোগান্তি অনেক বেড়ে গেছে। হঠাৎ শুনলে বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু উদাহরণ হিসেবে গত ১২ মে হাইকোর্টের দেওয়া একটি নির্দেশের উল্লেখ করা দরকার। এই নির্দেশে বিভিন্ন কোম্পানির ৫২টি ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিতে বলেছেন মাননীয় বিচারপতিরা। কারণ, সরকারের মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআইর পরীক্ষায় এ খাদ্যপণ্যগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, সারা বছর নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমিয়ে কাটানোর পর বিএসটিআইর কর্তাব্যক্তিরা ঠিক রমজানের প্রাক্কালেই মহাতৎপর হয়ে উঠেছেন কেন? এখানে হাইকোর্ট কিংবা মাননীয় বিচারপতিদের দোষারোপ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, খাদ্যপণ্যগুলোর মান সম্পর্কিত রিপোর্টই তারা এ সময় এসে পেয়েছেন। হাইকোর্টের নির্দেশ কত স্বল্প সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়, সেটা যেমন একটি দেখার বিষয় তেমনি একথাও উল্লেখ না করে পারা যায় না যে, এই নির্দেশের কুফলও সাধারণ মানুষকেই ভোগ করতে হবে। রমজানে ভেজাল ও নিম্নমানের হিসেবে চিহ্নিত পণ্যগুলো তো দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠবেই, একই সঙ্গে সেগুলোর বিকল্প অন্য বিভিন্ন কোম্পানির সব পণ্যের দামও লাফিয়ে বেড়ে যাবে।

প্রসঙ্গক্রমে হাইকোর্টেরই অন্য একটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করা দরকার। গত জানুয়ারিতে এই নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল বিএসটিআইয়েরই এক রিপোর্টের ভিত্তিতে। সংস্থাটি সেবার জানিয়েছিল, দেশের খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে এমন পাঁচটি ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি মানসম্মত তথা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। জনস্বার্থে দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশ অনুযায়ী ১৫টি কোম্পানির বোতলজাত পানি পরীক্ষা করে বিএসটিআই এ সম্পর্কে জানতে পেরেছিল। বেআইনিভাবে বোতলজাত করা খাবার পানি বিক্রি ও সরবরাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পাশাপাশি ওই আদেশে মাননীয় বিচারপতিরা বিএসটিআই এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়ী কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছিলেন। আদেশে মাননীয় বিচারপতিরা একই সঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন, প্লাস্টিক বোতল ও জারে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে সরকারের ব্যর্থতাকে কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না। বিএসটিআইর উদ্দেশে অন্য এক নির্দেশে তারা বলেছিলেন, ওই পাঁচটি ব্র্যান্ডের বিরুদ্ধে কী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাইকোর্টকে জানাতে হবে। এ সম্পর্কিত আর কোনো খবর অবশ্য জানা যায়নি!

বলার অপেক্ষা রাখে না, মান তথা স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়া সত্ত্বেও খোলা বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি এবং ৫২টি ভেজাল ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যপণ্য বিক্রি হওয়ার খবর নিঃসন্দেহে আশংকাজনক। পণ্যের মান যাচাই করার জন্য বিএসটিআইর মতো একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা নিয়োজিত থাকার পরও আলোচ্য পাঁচটি ব্র্যান্ডের পানি এবং বিভিন্ন কোম্পানির ৫২টি খাদ্যপণ্য কীভাবে খোলা বাজারে বিক্রি হতে পেরেছে— সঙ্গত কারণেই সে প্রশ্ন উঠেছে। সচেতন পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কেবলই মানসম্মত নয় বলে চিহ্নিত করে হাইকোর্টে রিপোর্ট পেশ করাটাই যথেষ্ট হতে পারে না। বরং অভিজ্ঞতার আলোকে ধরে নেওয়া যায়, বাজারজাত করার প্রক্রিয়ায় বিএসটিআইসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জড়িত রয়েছে এবং ঘুষের বিনিময়ে তারাই কোম্পানিগুলোকে লাইসেন্স তথা অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং অনুসন্ধানের মাধ্যমে ওইসব ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজকেও চিহ্নিত করা এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া দরকার। কারণ ঘুষের বিনিময়ে তারা মানুষের জীবনকে বিপন্ন করেছেন।   

এখানে পানি সম্পর্কে বিশেষভাবে বলা দরকার। কারণ ‘পানির অপর নাম জীবন’ হলেও বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত সব গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারা দেশের পানিই মারাত্মকভাবে দূষিত। ২০১৮ সালের অক্টোবরেও পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন এবং স্বাস্থ্যসংক্রান্ত এক রিপোর্টে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে অত্যন্ত আশংকাজনক বলে মন্তব্য করেছিল। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, বিভিন্ন পন্থায় সরবরাহ করা ৪১ শতাংশে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা ৮০ শতাংশ পানিতেই রয়েছে ডায়ারিয়াসহ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক অনেক রোগের জীবাণু। সেই সঙ্গে সারা দেশের ১৩ শতাংশ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বিশ্বব্যাংকের ওই রিপোর্টে আরো বলা হয়েছিল, পানি ও স্যানিটেশনের সামগ্রিক অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশে পেটের পীড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ ও উপসর্গের প্রকোপ বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে শিশুরা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এসব রোগের কারণে নষ্ট হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে জানা গেছে, বিভিন্ন কারণে ধনী জনগোষ্ঠীর তুলনায় দরিদ্ররা অনেক বেশি রোগের শিকার হচ্ছে। এমন অবস্থায় দরকার যখন ছিল পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট তথা সরকারি ব্যয় বাড়ানো বাস্তবে সেখানে বিগত কয়েক বছরে বরাদ্দ উল্টো অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে বলে মন্তব্য করেছিল বিশ্বব্যাংক। রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করে বলা হয়েছিল, আগামী বছরগুলোতেও বরাদ্দ ক্রমাগত কমতে থাকবে। 

পানি ও খাদ্যপণ্য সম্পর্কিত সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে দেশপ্রেমিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত অবিলম্বে নীতি ও পরিকল্পনায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানো এবং ভেজালকারীসহ সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। বিশেষ করে পবিত্র রমজানের প্রাক্কালে এবং রমজান চলাকালে যাতে পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে না যেতে পারে এবং ব্যবসায়ী নামের টাউট-দুর্বৃত্তরা যাতে যথেচ্ছভাবে মুনাফার পাহাড় গড়তে গিয়ে জনগণকে অসহায় শিকার বানাতে না পারে— এসব বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে। না হলে সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি হবে অপূরণীয়। মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads