• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
শ্রমিক আন্দোলন ও আমাদের পাটশিল্প

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

শ্রমিক আন্দোলন ও আমাদের পাটশিল্প

  • প্রকাশিত ১৬ মে ২০১৯

মো. আজহারুল ইসলাম

 

এই তো কিছুদিন আগে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বজুড়ে পালিত হয়ে গেল মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস ছিল এই দিনটি। মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার আর শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটার স্বপ্ন দেখে বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিক দিনটির মাধ্যমে। প্রতিবারের মতোই, বাংলাদেশেও বেশ উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমেই পালিত হয় দিনটি। তবে শ্রমিকদের স্লোগানে ছিল এবার ভিন্ন সুরের ব্যঞ্জনা। স্লোগানে উচ্চারিত হচ্ছিল- ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও, লড়াই করো’, ‘কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই চলবে না’, ‘কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’।

শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনগুলো ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লব, ১৯৪৯ সালের চীনের গণবিপ্লবকে ভালোভাবেই স্মরণ করিয়ে দেয়। যে বিপ্লবগুলোর ভয়ার্ত চিৎকার দুনিয়ার সব মহাশক্তির মনে ভয়ের সঞ্চার করেছিল। প্রতিটি আন্দোলনের সূত্রপাত কিন্তু শ্রমিক শ্রেণির সর্বহারা মানুষের ন্যায্য দাবিকে কেন্দ্র করেই ছিল। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন বা বিপ্লবগুলো এমন বিপ্লবে রূপ নেয়, যাকে বলা হয় পৃথিবীর ইতিহাসে বুর্জোয়া শ্রেণির হাত হেকে প্রলেতারিয়েতদের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার বিপ্লব। ইতিহাস সাক্ষী আছে, অক্টোবর বিপ্লবে এবং চীনের গণবিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে শুরু করে বিপ্লবকে সংগঠিত করা এবং বিপ্লবকে চূড়ান্ত পর্যায়ে সফল করার ক্ষেত্রে রাশিয়ায় সর্বহারা শ্রমিক শ্রেণি এবং চীনে সর্বহারা কৃষক শ্রেণি একক ও নিরঙ্কুশ ভূমিকা পালন করেছিল।

বর্তমান সরকার পাটকে বিশেষ কৃষিপণ্যের মর্যাদা দিয়ে এর গুরুত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে। সেজন্য পাট তার হারানো ঐতিহ্য পুনরায় ফিরে পাওয়ার দিকে হাঁটছে। বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে যাচ্ছিল পাটের হারানো ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক যাত্রা। মোটের উপর ভালোই চলছিল এই সোনালি আঁশের পাট খাত। কিন্তু হঠাৎ করেই এর একটি ছন্দপতন লক্ষ করা যাচ্ছে। পাটশিল্পে শুরু হয়ে গেছে শ্রমিক অসন্তোষ। যশোর ও খুলনাসহ সারা দেশের কিছু কিছু জায়গায় ৯ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন করছে। অথচ গত শতাব্দীর শেষ দশকে পাটকলগুলো আস্তে আস্তে সীমিত আকারে যখন চালু হলো তখন বেকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, পাটের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারকে ফিরিয়ে আনা, বিশ্বমানের পাটজাত দ্রব্য তৈরি ও আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি ইত্যাদি বিষয় সামনে রেখে তা করা হয়েছিল। পাটের সহজপ্রাপ্যতার অনিশ্চয়তা, জনমনে পাটজাত দ্রব্যের গ্রহণযোগ্যতায় ব্যর্থতা, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার ধরে রাখতে না পারা ইত্যাদি কারণে এই সোনালি শিল্প লাভের মুখ দেখতে পারেনি। তাই বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) এই কলকারখানাগুলো চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তারা এ শিল্পের ক্রমাগত লোকসানের কারণে বছরে মাত্র পাঁচ থেকে সাত মাসের শ্রমিক মজুরি পরিশোধ করতে পারে। তাছাড়া ২০১৫ সালে সরকার ঘোষিত পে-স্কেলও বাস্তবায়ন করতে পারছে না বিজেএমসি। সেজন্য শুরু হয়েছে সারা দেশে পাটকল শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিকরা সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করছে, ধর্মঘটের ডাক দিচ্ছে, আন্দোলন অব্যাহত রাখছে।

সর্বহারা শ্রেণির শ্রমিকরা বুর্জোয়াদের বলছে, ‘আমাদের সড়ক অবরোধের কারণে মানুষের কষ্ট হচ্ছে জানি। কিন্তু  প্রায় আড়াই মাস ধরে আমরা মজুরি পাচ্ছি না। মানবেতর জীবনযাপন করছি। তাই আমাদের সন্তানদের কথা ভেবে আপনারা সাময়িক কষ্ট মেনে নিয়ে আমাদের সহযোগিতা করুন। ভাই, আমাদের পেটে ভাত নেই, শরীরে ভালো কাপড় জোটে না।’ কথাগুলো হূদয় স্পর্শ করে যায়। প্রতিটি কথার পরতে পরতে নির্যাতিত নিপীড়িত মানবের অগ্নি স্ফুলিঙ্গের প্রতিধ্বনি লুক্কায়িত রয়েছে। একেবারেই সাদাসিধে কথা বলছে সোনালি আঁশের সেবকরা। তারা বলছে— ‘আমরা রাস্তায় নামতে চাই না। আমরা চাই ন্যায্য মজুরি সঠিক সময়ের প্রাপ্যতা।’ প্রায় ৯ সপ্তাহের মজুরি বকেয়া রয়েছে শ্রমিকদের। পরিবার নিয়ে তারা দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন। ফলে তারা বলছেন, ‘রাস্তায় নামা ছাড়া তাদের কোনো বিকল্প নেই।’ আন্দোলন থেকে শ্রমিকরা বকেয়া মজুরি পরিশোধ, মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন ও রোজার ঈদে উৎসব-ভাতার দাবি জানাচ্ছে। এছাড়া বেশকিছু দাবিকেও তারা সামনে নিয়ে এসেছে, যেমন— অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক কর্মচারীদের পিএফ, গ্র্যাচুইটি প্রদান, মৃত শ্রমিকের বীমার বকেয়া প্রদান, টার্মিনেশন ও বরখাস্ত হওয়া শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল, শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়োগ ও স্থায়ী করা, পাট মৌসুমে পাট ক্রয়ের অর্থ বরাদ্দ, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিলগুলোকে পর্যায়ক্রমে আধুনিকায়ন করা।

এবারে পাটশিল্পে এ শ্রমিক অসন্তোষ যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখাসহ তীক্ষ নজরদারি রাখতে হবে। পাটশিল্প শ্রমিকরা প্রলেতারিতদের ভূমিকা নিয়ে আন্দোলন করছে, ন্যায্য দাবি নিয়েই হুংকার দিচ্ছে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকেও আন্তরিকতার কোনো অভাব দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান সরকার সোনালি আঁশের শ্রমিকদের ৯ দফা আন্দোলনের প্রতি যথেষ্ট সংবেদনশীল। যেহেতু সরকার নিয়ন্ত্রিত পাটকলগুলো থেকেই অধিক পরিমাণে লোকসান গণনা করতে হচ্ছে। শ্রমিক অসন্তোষের পরিমাণও এখানেই বেশি এবং সরকার আশানুরূপ ফলাফল পাচ্ছে না সরকার নিয়ন্ত্রিত পাটকলগুলো থেকে। তাই সরকারি পাটকলগুলোকে বেসরকারিকরণের কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে। এ বিষয়টিও খেয়াল রাখা দরকার। শ্রমিক আন্দোলন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির দিকে যাওয়ার আগেই তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির আন্দোলনকে বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ বা পলিটিক্যাল গ্রুপ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে যেন তাদের স্বার্থে পরিচালনা করতে না পারে, এ বিষয়েই সজাগ থাকা জরুরি। আমরা আশা করি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুততার সঙ্গে পাটকল শ্রমিকদের অসন্তোষ নিরসনে কাজ করবে এবং আমাদের পাটশিল্প বাঁচিয়ে রাখবে। 

 

লেখক : শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads