• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
উন্নত রাষ্ট্রের অন্তরায়

উন্নত রাষ্ট্রের অন্তরায়

প্রতীকী ছবি

সম্পাদকীয়

দুর্নীতিগ্রস্ত নাগরিকসেবা

উন্নত রাষ্ট্রের অন্তরায়

  • প্রকাশিত ১৭ মে ২০১৯

যে কোনো ধরনের দুর্নীতি বাহ্যিকভাবে ব্যক্তির উন্নয়ন ঘটাতে পারলেও, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নের অগ্রগতিকে বিঘ্নিত করে। তা ছাড়া এর মাধ্যমে অর্জিত ব্যক্তির উন্নয়নও আপেক্ষিক। কেননা দুর্নীতিগ্রস্ত একটি দেশ যখন সামগ্রিক উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে পড়ে, তখন ব্যক্তি-উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি সেই মতই প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বিজ্ঞ রাজনীতিক মোহাম্মদ নাসিম। তিনি বলেছেন, ‘পয়সা দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি আদালতও কিনতে পারা যায়।’ এরও আগে গত বছর দুদক কার্যালয়ে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিই মানুষের মুক্তির প্রধান অন্তরায়।’ তিনি আরো বলেন, সবার আইন মেনে চলা উচিত। কেউ আমাদের আইন মানাবে, সেজন্য অপেক্ষায় থাকা সমীচীন নয়। কারণ আইন না মানাই দুর্নীতি। অর্থাৎ দেশের ক্ষমতাসীনদের এসব উক্তি বলে দেয় যে, আমরা জাতি হিসেবে কতখানি দুর্নীতিগ্রস্ত।

বার্লিনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)-এর প্রকাশিত বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই)-এর ভিত্তিতে বিগত কয়েক বছর ধরেই দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। প্রথমত সরকারি কাজে আর্থিক দুর্নীতি এবং দ্বিতীয়ত ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি আমাদের এখানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত বছর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনেও তেমনটাই দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৩৬ ভাগ দুর্নীতির শিকার সেবাগ্রহীতারা। মোটা দাগে চিত্রটি এরকম— ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় সিটি করপোরেশনে এবং ইউনিয়ন পরিষদে গড় ঘুষ ৪১৭ টাকা। এমনকি টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলায় ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অডিটের নামে শিক্ষকদের জিম্মি করে লাখ লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহণের কথাও আমার জেনেছি। প্রায়ই শোনা যায় পণ্য পরিবহনে দালালচক্র-মধ্যস্বত্বভোগী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চাঁদাবাজির খবর। তার মানে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় অপরাধপ্রবণতার অন্যতম একটি চিত্র হলো ‘ঘুষ’ বা ‘উৎকোচ’। এটি এখন মারাত্মক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে।

এ কথা আজ ওপেন সিক্রেট— অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যে কোনো নাগরিক সেবা পেতে হলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘুষ বা উৎকোচ দিতে হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)-এর জরিপে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সনদ, সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির বিভিন্ন সেবা, বিচার ও সালিশ, কর সংগ্রহ, বিভিন্ন ধরনের লাইসেন্স গ্রহণ— এ জাতীয় নানাবিধ সেবা পাওয়ার জন্যে নাগরিকদের বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হতে হয়।

আমাদের ভোগবাদী মানসিকতা এবং অনেক ক্ষেত্রে অভাব দুর্নীতির পেছনে দায়ী। তবে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট দেখলে বোঝা যায় ভোগবাদী মানসিকতাই দায়ী। বাংলাদেশে বর্তমানে সব শ্রেণির ব্যক্তিরাই ঘুষ গ্রহণ করে থাকে। তবে উচ্চ পর্যায়ের কর্তারা মূলত তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে গিয়ে ঘুষ গ্রহণকে তাদের অভ্যাসে পরিণত করেছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরাও তাদের জীবনযাত্রা মান উন্নয়নে ঘুষ গ্রহণকে এখন আর অপরাধ মনে করছেন না। দেখা যায় যে প্রতি ক্ষেত্রেই মানুষ ঘুষ নামক উৎকোচ গ্রহণে দ্বিধান্বিত নয়। আর এভাবেই দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি মানুষের বিবেকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। নীতি ও শাসনকাঠামোতে দুর্নীতি-সহায়ক শক্তির প্রভাব ক্রমাগত বেড়েছে।

এই সংস্কৃতি দ্বারা মারাত্মক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ ও সমাজ। এ অবস্থায় সরকার, সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, সমাজবিজ্ঞানী, সচেতন মানুষ— সবাইকে এই ঘুষ-বাণিজ্য নির্মূলে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষের মুক্তির বড় অন্তরায় হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি দমন কিংবা প্রতিরোধ করা গেলেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি সম্ভব হবে। ২০৪১ সালে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশকে দেখতে হলে উল্লিখিত এসব দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads