• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
ছাত্ররাজনীতির অতীত ও বর্তমান

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ছাত্ররাজনীতির অতীত ও বর্তমান

  • মো. আখতার হোসেন আজাদ
  • প্রকাশিত ১৯ মে ২০১৯

শিক্ষা একটি জাতিকে উন্নত ও সভ্য জাতিতে পরিণত করার একমাত্র হাতিয়ার। অনাকাঙ্ক্ষিত বাধাবিপত্তি দূর করে শিক্ষাগ্রহণের পথকে সুগম করার জন্যই মূলত ছাত্ররাজনীতির উৎপত্তি। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ন্যায্য অধিকার আদায়ে আন্দোলন, শিক্ষাসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে প্রতিবাদ, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মসূচি, সমাজসেবামূলক কার্যক্রম, মেধাবী ও আর্থিক অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজের উপকারে আসে এমনসব কার্যক্রম পরিচালনা ছাত্র সংগঠনগুলোর কাছে কাম্য। কিন্তু আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতি যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে। বর্তমানে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের সাধারণ মানুষ আদর্শহীন, চরিত্রহীন, অর্থলোভী, মাস্তান, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ— সর্বোপরি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মানুষ হিসেবে মনে করে থাকেন। একসময় আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির অনেক সুনাম ছিল। দেশের বিভিন্ন ক্রান্তিকালে বা কোনো সঙ্কটে কিংবা যে কোনো ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু এখন যেন সেই ঐতিহ্যবাহী ছাত্ররাজনীতি বাংলাদেশের ক্যানসারে পরিণত হয়েছে।

’৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর সাধারণ নির্বাচন, ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা আজো সোনালি অক্ষরে লেখা আছে। কিন্তু বর্তমানে ছাত্ররাজনীতি কেমন যেন একটু কলুষিত হয়ে তার অতীত গৌরব হারিয়ে ফেলেছে। পোস্টার পোড়ানো, ব্যানার ছেঁড়া, প্রতিহিংসার রাজনীতি চর্চার ফলে এখন মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনে স্বেচ্ছায় আসতে চায় না। স্বেচ্ছায় বললাম কারণ, বর্তমানে রাজনীতি হয়ে পড়েছে সুযোগনির্ভর। প্রচলন হয়েই গেছে, প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতি করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা যাবে নচেৎ তার ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসে বিচরণ করাও নিরাপদ নয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আসে মফস্বল থেকে। এক সাগর স্বপ্ন নিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় এসে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে, তখনই ছাত্রনেতারা স্বেচ্ছায় তাদের ছায়া হয়ে আসে কেবল নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য। এরপর হলে একটা থাকার জায়গা আর টিউশনি খুঁজে দিয়ে অনুগত কর্মী হিসেবে সেই ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা যেন বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির বৈশিষ্ট্য হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ছাত্র রাজনৈতিক দলের নেতাদের নগ্ন হস্তক্ষেপ, আদর্শিক প্রতিপক্ষকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন, মারামারি, হানাহানি শিক্ষাঙ্গনে আতঙ্ক তৈরির যথেষ্ট কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসে অতিমাত্রায় রাজনীতি চর্চার ফলে একজন বাবা নিশ্চিত হতে পারেন না যে, তার ছেলে সুস্থভাবে বাড়ি ফিরে আসতে পারবে। একজন মা সবসময় আতঙ্কিত থাকেন, তার মেয়ে সম্ভ্রম নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে কি-না?

এ জন্য কখনো কখনো শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিও উঠেছিল। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো আবাসিক হলগুলো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অধিক ছাত্রকে হলে স্থান দেওয়ার জন্য এক রুমে যেখানে দুজন বা তিনজন থাকার কথা, সেখানে থাকতে বাধ্য করা হয় আট থেকে দশ জনকে। এই হল-রাজনীতির ফলে জিম্মি করা হয় হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে। মিছিলে যোগ দেওয়া হয় তাদের বাধ্যতামূলক কাজ। বিরোধীমতের শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করানো যেন নিত্যদিনের কাজ। এটি যেন আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির একটি রীতিতে পরিণত হয়েছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন তার ছাত্রসংগঠন এটি করেছে। আবার হলের ডাইনিংয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ফ্রি খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে বহুমাত্রায়। এর ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং বন্ধ থাকার খবরও পত্রিকার পাতায় শোভা পায়। শুধু তা-ই নয়, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন দোকানে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস বাকি খাওয়া ও কথিত সেসব নেতার অনুসারীদেরও ফ্রিতে খাওয়ার অভিযোগও ওঠে। যখন কোনো ছাত্রসংগঠনের কর্মী ইভটিজিং, ধর্ষণ, ছিনতাই, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়, যখন আন্তঃকোন্দল কিংবা প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন সেটি কেবল সেই ছাত্রসংগঠনের জন্য লজ্জাকর নয় বরং সেটি পুরো ছাত্ররাজনীতিকেই কলুষিত করে।

কয়েক দশক থেকেই ছাত্ররাজনীতির ট্রেন লাইনচ্যুত হলেও কোনো সরকারই ছাত্ররাজনীতির সংস্কারে মনোযোগ দেয়নি। যখন যে সরকার এসেছে, তার দলীয় ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করেছে নিজেদের স্বার্থে। আবার যখন কোনো রাজনৈতিক দল বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকে, তখন একই ভূমিকায় তার ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করে থাকে। নিজেদের মিছিল-মিটিং, সভা-সমাবেশে লোকসমাগম করা, হরতাল অবরোধে ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীদের রাজপথে নামিয়ে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করা প্রভৃতিই যেন ছাত্ররাজনীতির মুখ্য ভূমিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতায় বসানো কিংবা ক্ষমতাচ্যুত করা ছাত্র রাজনৈতিক কোনো দলের কাছে কাম্য হতে পারে না। কিন্তু বর্তমানে প্রায় সব ছাত্র রাজনৈতিক দলই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন না হয়ে যেন সহযোগী সংগঠনে রূপ নিয়েছে।

পথভ্রষ্ট ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বগুণের (!) কারণে অকারণে প্রায়ই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থির পরিবেশ তৈরি হয়। কখনো প্রেমঘটিত বিষয়কে কেন্দ্র করে, কখনো নিজের দলের ভেতর বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে আন্তঃকোন্দল, কখনো বিরোধী মতের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রায়ই ক্যাম্পাস উত্তাল থাকে। ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কাছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা থাকে অনেক। কিন্তু তারা যেন শিক্ষার্থীদের স্বার্থ-সংরক্ষণের দিক থেকে দল ভারী ও নিজের গ্রুপে লোক টানতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। একটি ছাত্রসংগঠনে কর্মীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত দলের আদর্শ মেনে সেই ছাত্রসংগঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা। কিন্তু বর্তমানে একটি বহুল প্রচলিত আদর্শ হলো আমি অমুক গ্রুপের কর্মী বা আমি অমুক ভাইয়ের গ্রুপের লোক যা ছাত্ররাজনীতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যকে লাইনচ্যুত করে দেয়।

দেশের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে। ক্যারিয়ার গঠন, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘূর্ণিঝড় ফণীতে আক্রান্ত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম সবার মন কেড়েছে। কিন্তু নানা সময়ে কর্মীদের বিভিন্ন অপকর্ম দলটির প্রতি সাধারণ মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তোলে। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোবাইল চুরি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লিচু কেলেঙ্কারিসহ নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভূমিকার প্রশ্নে কিছুটা হলেও ছাত্রলীগ ছাত্রসমাজের ভালোবাসা হারিয়েছে। একইভাবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কথাও চলে আসে। ক্ষমতাসীন থাকাকালে তারাও ধরাকে সরাজ্ঞান করেনি। আর এখন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নতুন কমিটি গঠন যেন স্বপ্নের সোনার হরিণ। বর্তমানে এই ছাত্রসংগঠনটির করুণ দশা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কার্যক্রম ও নতুন কমিটি গঠন না হওয়ার জন্য দলটি কর্মীসঙ্কটে ভুগছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদলের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শুধু ছাত্রদল নয়, বরং নিয়মিত নেতৃত্বের পরিবর্তন না হওয়ায় নতুন নেতৃত্ব গড়ে না ওঠার ফলে দাদা-নানা-বাবারা যেন এখন ছাত্রদের নেতা হয়ে যাচ্ছে!

ইসলামী রাজনীতি চর্চার কথা বললেও বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দেশে বিভিন্ন সময় আলোচনা সমালোচনার জন্ম দিয়ে এসেছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত নেতাদের রক্ষার আন্দোলনে নানা সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, হরতাল-পিকেটিংয়ে গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেওয়ার ঘটনায় নিন্দা কুড়িয়েছে দলটি। তাছাড়া একসময় বিশেষ করে রাজশাহী ও চট্টগ্রামে এই ছাত্রসংগঠনটি প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে হাত-পায়ের রগ কাটার রাজনীতির প্রচলন করেছিল। বর্তমানে এটি অনেকটা ফেসবুকনির্ভর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্য কার্যক্রম না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের সভা-সেমিনারের ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ছাত্রশিবিরের বিভিন্ন কার্যক্রম সমালোচিত হলেও এর নেতৃত্ব গঠনের বিষয়টি এখনো চলমান। অন্যদিকে নিয়মিত কার্যক্রম ও নতুন নেতৃত্ব গঠনের রীতি থাকলেও বিভিন্ন মত এবং ধারার ভিত্তিতে ভাগ হয়ে থাকার ফলে দেশের বাম ছাত্রসংগঠনগুলো প্রকৃত অর্থে ছাত্রসমাজের জন্য কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন বাম সংগঠন অনেকটা ঝিমিয়ে রয়েছে। আবার ধর্মীয় ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর মধ্যেও যথেষ্ট মতবিরোধ লক্ষ করা যায়। নিয়মিত ও প্রকৃত শিক্ষার্থীদের হাতে ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বভার যেন এখন ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে।

‘নানা মানুষ, নানা মত’ এই চিরন্তন সত্য বাক্যটিকে অস্বীকার করার অধিকার কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতাদেরই নেই। প্রত্যেকে নিজ নিজ মত বা আদর্শের ভিত্তিতে রাজনীতি করবে এটি সবার মৌলিক অধিকার। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখতে হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। তাদের চাহিদা ও স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করা এবং ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতকরণের দায়িত্ব ও কর্তব্যই হচ্ছে ছাত্ররাজনীতির সারকথা। আমাদের দেশের ছাত্ররাজনীতির পুরনো ঐতিহ্য ফিরে আসুক, মেধাবীরা যুক্ত হোক ছাত্ররাজনীতিতে এবং ভবিষ্যতের জাতীয় নেতৃত্ব গড়ে উঠুক সুষ্ঠু রাজনীতি চর্চার মাধ্যমে।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads