• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
কৃষির বিকল্প পেশার কথা ভাবছেন কৃষকরা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

কৃষির বিকল্প পেশার কথা ভাবছেন কৃষকরা

  • মোহাম্মদ অংকন
  • প্রকাশিত ২০ মে ২০১৯

বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের অবস্থা এখন নাজেহাল। অসম কৃষিজ ব্যয়, ধান ও চালের দামে অসামঞ্জস্যতা, তেল-সার-কীটনাশকের আকাশচুম্বী দাম, শ্রমিক স্বল্পতা, লাগামহীন মজুরি কাঠামো এবং বৈরী পরিবেশ যেন কৃষি ও কৃষককে কৃষির মূল ভাবধারা থেকে বিতাড়িত করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বৈদেশিক সম্পর্ক উন্নয়নের দিকে সুনজর দিলেও কৃষকদের নিয়ে বোধহয় একদমই ভাবছেন না। অথচ দেশের আশি ভাগ মানুষ এই কৃষি পেশার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। আর একশভাগই কৃষকের উৎপাদিত চালের ভাত ও অন্যান্য শস্যদানা ভক্ষণ করে থাকেন। সবাই যেন ভাত খেয়েই ভুলে যাচ্ছেন কৃষকের উপকারের কথা। দেশে কৃষকের যে দুরবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা নিয়ে কারো কোনো টুঁ-শব্দ শোনা যায় না কেন? দেশে কৃষি সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোই বা কী করছে? কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, জেলা-উপজেলা কৃষি অফিসের কাজ তাহলে কী? সরকার কৃষকদের থেকে সরাসরি ধানও কিনছেন না। কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে কী করে?

সম্প্রতি একটি দুঃসংবাদ সবারই দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে পাকা ফসলের ক্ষেতে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন এক কৃষক। পাকা ধান পোড়ানোর ভিডিও চিত্র দেখা গেছে ফেসবুক, ইউটিউবসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই অভিনব প্রতিবাদের কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রতি মণ ধানের দাম থেকে প্রতিজন শ্রমিকের মজুরির দাম দ্বিগুণ। কৃষকরা ধান আবাদ করে মাঠে মারা পড়েছেন। তাই মনের দুঃখে পাকা ধানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কতটা মনবেদনা থেকে একজন কৃষক এমন কাজ করতে পারেন, তা বলা বাহুল্য। দেশের সব কৃষকই এখন এমন মনের দুঃখে ভুগছেন। কেননা প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০ টাকায়। প্রচলিত বাজারে এ টাকা কিছুই না। এক কেজি গরুর মাংস কিনতেও ৫৫০ টাকা লাগে। তেল, লবণ, পোশাক-আশাকের লাগামহীন দামের কথা না-ই বা বললাম। এসবের বিপরীতে একজন শ্রমিকের দিনমজুরি ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশি। এতে প্রতি মণ ধানে কৃষককে লোকসান গুনতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা মানতেই কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। কৃষকের উৎপাদিত ধানের অর্ধেকই শ্রমিকরা নিয়ে যাচ্ছেন। বাকিটা দিয়ে সারা বছর সংসার চালানো সম্ভব নয়।

কৃষকরা কতটা লোকসানের শিকার হচ্ছেন এবার একটু হিসাব-নিকাশ করে দেখাা যাক। সাধারণত এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করতে ব্যয় হয় ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। এক বিঘা জমির চারাবীজের দাম দুই হাজার টাকা বাদ দিলে খরচ এসে দাঁড়ায় ১০ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকা। এক বিঘা জমির গড় ফলন ২০ মণ হলে এক মণ ধানের উৎপাদন খরচ এসে দাঁড়ায় ৫০০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা। অথচ বাজারে ধানের দাম ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ প্রতি মণ ধান উৎপাদন করে কৃষকের মাত্র ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা লাভ হচ্ছে। অথচ সরকার প্রতি মণ ধানের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন ১ হাজার ৪০ টাকা। সরকার ঘোষিত মূল্য যদি ন্যায্যমূল্য হয়, তাহলে প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে ৩৪০ টাকা থেকে ৪৪০ টাকা। ধান-চালের বাজার মন্দা দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কম মূল্যে ধান বিক্রি করতে বাধ্য করছেন। কৃষকরাও অভাবের দরুন ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। সরকার ধানের যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা এক সময় কার্যকর হবে বা ওই মূল্য ছাড়িয়ে ১২০০ টাকা মণ দরেও ধান বিক্রি হবে। ততদিনে কৃষকের গোলায় ধান থাকবে না। এভাবেই লাভের সবটুকু অংশ লুটপাট করে ব্যবসায়ীরা। সব ধান যখন তাদের হাতে জিম্মি হয়ে যায়, তখন বেড়ে যায় চালের দাম। ইরি মৌসুমে কৃষকরা ধানের দাম না পেয়ে হতাশ, অন্য সময় অকৃষিজ পেশার মানুষ চাল কিনতে হিমশিম খেয়ে যায়।

সরকার ধান-চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করে। তবে কৃষকদের কাছ থেকে ধান না কিনে মিল মালিক বা ডিলার নিয়োগের মাধ্যমে ধান-চাল কেনে সরকার। এ কারণে লোকসানের শিকার হয় কৃষক। সরকার ধান-চালের যে দাম নির্ধারণ করেছে তা কৃষকের জন্য লাভজনক না হলেও এটি সহনশীল মাত্রার দাম বলে ধরে নিয়েছেন কৃষক। দাম ঘোষণার পর থেকে যথাযথ কার্যকর হচ্ছে কি-না তা তদারকি আবশ্যক। প্রতি বছর ইরি মৌসুমে সরকারকে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছাই পারে কৃষকের অনাকাঙ্ক্ষিত লোকসান থেকে বাঁচাতে।

বর্তমান পরিস্থিতি এটা স্পষ্ট করছে যে, কৃষিতে আর কৃষকদের কোনোমতেই পোষাচ্ছে না। কৃষকরা কৃষি পেশার বিকল্প ভাবছেন। তাই অনেকে কৃষিজমি নষ্ট করে পুকুর খনন করে মৎস্য চাষ করছেন। যেখানে কৃষিজমিতে শুধু ধানের চাষ হয়, সেখানে পুকুর খনন করলে মাছ চাষের পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, ফলমূল ও শাকসবজি চাষ করেও লাভবান হচ্ছেন অনেকে। তবে এভাবে কৃষিজমির ওপর গড়ে ওঠা পুকুরের আধিক্যতা কৃষিজ অর্থনীতিকে হ্রাস করবে। মাছ চাষের মাধ্যমে শুধু আমিষের চাহিদা পূরণ হলেও দেশজুড়ে খাদ্যশস্যের দারুণ অভাব দেখা দেবে। তখন ধান, চাল ও অন্যান্য রবিশস্য আমদানির জন্য বিদেশে হাত পাততে হবে। তখন বর্তমান পরিস্থিতির চেয়েও বাংলাদেশকে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। আমরা এ কথা উপলব্ধি করতে পারছি যে, কৃষক তার ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না বলেই অকৃষিজ পেশায় যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই কৃষকদের কৃষি পেশায় বহাল রাখার জন্য সরকার দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে- এটাই প্রত্যাশিত।

 

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads