• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
শিরোনাম যখন ছাত্রলীগ

ছবি : সংগ‍ৃহীত

সম্পাদকীয়

শিরোনাম যখন ছাত্রলীগ

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৫ মে ২০১৯

এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, ছাত্রলীগ এদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন। এদেশের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী এ সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসেছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। যারা পরবর্তীকালে জাতীয় রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। দীর্ঘ ইতিহাস-ঐতিহ্যের অধিকারী সে সংগঠনটি বর্তমানে নানা কারণে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হচ্ছে। বিশেষত গত বেশ কয়েক বছর ধরে সংগঠনটির কিছু নেতাকর্মীর কার্যকলাপ জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড এবং অপরাধমূলক কাজে সম্পৃক্ত হওয়া সর্বত্র নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড়ও তুলেছে। আর এসব কাজকর্মের জন্য এ ছাত্র সংগঠনটি বার বার সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। অতি সম্প্রতি ছাত্রলীগ সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে সদ্য ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটির কারণে। ওই কমিটি ঘোষণার পর সংগঠনটিতে বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে। ঘটেছে সংঘর্ষের ঘটনাও।

 

কাউন্সিল হওয়ার প্রায় এক বছর পর চলতি মাসে ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হলে সংগঠনটিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। পদবঞ্চিতরা প্রতিবাদ করে। তারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে কমিটিতে পদ বণ্টনে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনে। এ নিয়ে তারা সংবাদ সম্মেলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, এমনকি অবস্থান ধর্মঘটও করে। ঘটে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও। প্রতিবাদী নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হয় ছাত্রলীগেরই কর্মীদের দ্বারা। ফলে বিষয়টি বেশ ঘোলাটে হয়ে ওঠে।

 

বিভিন্ন খবরে বলা হয়েছে, ঘোষিত কমিটিতে শতাধিক পদে বিতর্কিতদের পদায়ন করা হয়েছে। এদের কেউ কেউ ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত, অনেকে বিবাহিত, কেউ আবার ভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। ছাত্রলীগের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বয়সসীমা ত্রিশ বছর নির্ধারিত থাকলেও ঘোষিত কমিটিতে বেশ কয়েকজন ত্রিশোর্ধ্ব বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ কেউ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন- এমন অভিযোগও আছে। কমিটিতে ঠাঁই না পাওয়া ছাত্রলীগ নেতারা গত ১৪ মে সংবাদ সম্মেলনে ঘোষিত কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিলেও এখন পর্যন্ত তা বাতিল হয়নি। কমিটি ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা লন্ডনে ছিলেন, আর সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ছিলেন চিকিৎসার্থে দেশের বাইরে। তবে কমিটি গঠনে অনিয়মের কথা জেনে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা উষ্মা প্রকাশ করে অবিলম্বে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার নির্দেশের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিষয়টির সুরাহা করার জন্য কাজ করছেন বলে জানা গেছে। ঘটনাটি যে প্রধানমন্ত্রীকে বিরক্ত করেছে তা স্পষ্ট হয়েছে গত ১৭ মে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের আলোচনা সভায় দেওয়া বক্তৃতা থেকে। তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রজীবন থেকেই আমার রাজনীতি শুরু। কোনো বড় পদে কখনো ছিলাম না, কখনো বড় পদ চাইনি। পদ তৈরি করা ও সবাইকে পদে বসানোর দায়িত্বই পালন করতাম। পঁচাত্তরের পর দলের যে এত বড় দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে, সেটা আমি ভাবিনি, চাইনি। এমন দায়িত্ব নেওয়ার কথাও চিন্তায় ছিল না। পদের জন্য নয়, দেশের জন্যই ছাত্ররাজনীতি করেছি’ (বাংলাদেশের খবর, ১৮ মে, ২০১৯)। প্রধানমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ সন্দেহ নেই। তিনি যে কথাটি বলতে বা বোঝাতে চেয়েছেন তাহলো, দলীয় পদ কাউকে ধরে বসিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। সময়ই নির্ধারণ করে কে কখন কোন পদে বসবে। দেশের জন্য ছাত্ররাজনীতি করেছি- তার এ মন্তব্য শুধু তার একার বেলায়ই প্রযোজ্য নয়। বরং আমরা যদি অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করি দেখতে পাব, ছাত্ররাজনীতি দিয়ে শুরু করে যারা ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছেন, তারা সবাই শুধু দেশের জন্যই রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

 

কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন যারা ছাত্ররাজনীতি করেন, তারা ক’জন দেশ ও জাতির জন্য আত্মোৎসর্গের প্রত্যয়ে করেন তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে সংঘর্ষের পর একটি টিভি আলোচনায় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা, যিনি এখন দেশের একজন সুপরিচিত সাংবাদিক, মন্তব্য করেছেন- আদর্শ নয়, সম্পূর্ণ ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই আজ এ অবস্থা। ছাত্রলীগের মতো একটি সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতার তকমা গায়ে লাগাতে পারলে অনেক কাজই সহজ হয়ে যায়। তিনি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীর সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে চরম হতাশাও ব্যক্ত করেন। কমিটি নিয়ে সৃষ্ট সমস্যা হয়তো সমাধান হয়ে যাবে; কিন্তু দেশব্যাপী ছাত্রলীগের কর্মীরা একের পর এক যেসব ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছেন, তার কী হবে? গত এক যুগে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাীি, দখল, খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, শিক্ষককে লাঞ্ছিত করাসহ কোন অপরাধের সঙ্গে জড়ায়নি ছাত্রলীগের নাম?

 

এটা জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় যে, আগামী দিনে যারা জাতীয় রাজনীতির হাল ধরবেন, দেশকে নেতৃত্ব দেবেন তাদের একটি অংশ এখনই দুর্নীতি-দুষ্কর্মের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলছেন। কেন তারা অপরাধকর্মে প্রবৃত্ত হচ্ছেন এ বিষয়ে নানাজনের নানা মত রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে, আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করা ও বিত্ত-বৈভবের মোহে পড়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের একটি অংশ অনৈতিকতার পথে গমন করছে। একসময় ছাত্রনেতারা অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন। হাফ বা ফুল হাওয়াই শার্ট, তার সঙ্গে সাধারণ মানের প্যান্ট আর স্যান্ডেল- এই ছিল তাদের পরিধেয়। আর যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন বাস। আর এখন ছাত্রনেতাদের রাজধানীতে একাধিক বাড়ি বা ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি থাকার কথা শোনা যায়। কী করে সম্ভব এসব? যার ছাত্রত্বই শেষ হয়নি, কর্মজীবন যিনি শুরু করেননি, তার কীভাবে বাড়ি-গাড়ি হয়? শুধু আওয়ামী লীগ বলে কথা নয়, আমাদের দেশের ক্ষমতাসীন দলগুলোর ছাত্র ও যুব সংগঠনের দোর্দণ্ড প্রতাপের কথা নতুন করে নিশ্চয়ই বলার দরকার পড়ে না।

 

ছাত্ররাজনীতি হলো রাজনীতির প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানে অনুশীলন হওয়ার কথা নিজেকে দেশ ও জাতির স্বার্থরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে গড়ে তোলার। ছাত্ররা সোচ্চার থাকবে তাদের পড়াশোনার স্বার্থের পক্ষে। তারা নিবেদিত থাকবে দেশ ও জাতির স্বার্থরক্ষায়। প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করবে সব ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের। তারা ট্রেনিং নেবে কী করে দেশ বা রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে হয়। আর সেই ট্রেনিং তারা পাওয়ার কথা তাদেরই পূর্বসূরিদের কাছ থেকে। কিন্তু যাতনার বিষয় হলো, সেখানেই লুকিয়ে আছে আসল সমস্যা। ছাত্রকর্মীদের সুপথে পরিচালিত করার কথা যাদের, তারা নিজেরাই যে বিপথের যাত্রী!

 

শুধু ছাত্রলীগ নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সে দলের ছাত্র-যুব সংগঠনের কর্মীরাই নানা ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষে নিহতও হয়েছে বহু তরুণ। তবে বর্তমানে ছাত্রলীগ যেভাবে প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার খবরের শিরোনাম হচ্ছে, অতীতে এমনটি হয়নি। সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বেপরোয়াভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। এরা আইন-কানুন, থানা-পুলিশ কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না। এমন বেপরোয়া কেন তারা? অভিভাবক সংগঠন কি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? স্মরণ থাকার কথা, ছাত্রলীগের এমন বেপরোয়া কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট হয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েক বছর আগে সংগঠনটির সাংগঠনিক নেত্রীর পদ ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তখন তার কাছে মাফ চেয়ে ছাত্রলীগ নেতারা তাকে সে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে রাজি করিয়েছিলেন। স্বৈরশাসক এরশাদ তার জাতীয় ছাত্রসমাজ নামের ছাত্র সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘোষণা করেছিলেন এই একই কারণে। সে সময় ক্ষমতামদে মত্ত ওই সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বত্র এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, যা নিয়ন্ত্রণ করা অসাধ্য হয়ে উঠেছিল তার সরকারের পক্ষে। এখনো মাঝে মধ্যে শোনা যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা জেলায় কোনো কোনো ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম স্থগিত করার খবর। নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েই যে অভিভাবক রাজনৈতিক দলগুলো এমন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়, সে কথা বলাই বাহুল্য।

ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড যে আওয়ামী লীগ তথা সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঐতিহ্যবাহী এ ছাত্র সংগঠনটির সাবেক অনেক নেতাই এ বিষয়ে তাদের হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের আফসোস, যে ছাত্রলীগ এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রসৈনিকের ভূমিকা পালন করেছে, সেই ছাত্রলীগ আজ নানা ধরনের নেতিবাচক বিশেষণে অভিহিত হচ্ছে। একসময় যারা এ সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়েছেন, পালিত ভূমিকার জন্য অহংবোধ করেন- তাদের জন্য এটা পীড়াদায়ক বৈ কি!

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads