• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
শিক্ষকতা জীবনের ঘানি

ছবি :সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

শিক্ষকতা জীবনের ঘানি

  • প্রকাশিত ২৬ মে ২০১৯

ড. আহমেদ ইমতিয়াজ

 

আরমান পারভেজ মুরাদ, ডলি জহুর, রাইসুল ইসলাম আসাদ এবং নাজনীন হাসান চুমকী অভিনীত কাজী মোর্শেদের অসাধারণ একটি জীবনমুখী সিনেমার নাম ঘানি (The Cycle)। যেখানে নিত্য অভাবে জর্জরিত গ্রামের একটি পরিবারের নিষ্ঠুর মূল্যহীন খাটুনির চিত্র অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও হূদয়বিদারকভাবে ফুটে উঠেছে। অধ্যাপক মার্শাল শিক্ষাকে পুঁজি বিনিয়োগের সর্বোৎকৃষ্ট ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বটে কিন্তু যারা শিক্ষিত সমাজ বিনির্মাণের কারিগর, সেই শিক্ষকরাই যুগে যুগে পুঁজিহীন জীবন যাপন করে থাকেন।

জীবনের যে অন্ধকার আলোতে দূর হয় না, যে কালো ধুয়ে পরিষ্কার করা যায় না— সেই অন্ধকার, সেই কালো দূর হয় কেবল শিক্ষার মাধ্যমে। এমনকি কলংকের কালো দাগও শিক্ষার আলোতে দূর হতে পারে। কিন্তু শিক্ষকরা পুঁজিহীন মূল্যহীন অসফল দুর্বিষহ জীবনের কলঙ্ক ঘানি টানে আজীবন। এটা দূর হওয়ার নয়। ডায়োজিনিসের ভাষায় ‘শিক্ষা হলো গরিবের ধন, যুবকের মাধুর্য, বৃদ্ধের সান্ত্বনা আর ধনীর অলঙ্কার’। আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না অগ্নি দেয়।’ কিন্তু শিক্ষকদের জীবনে ডায়োজিনিস ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষার প্রতিফলন ঘটেনি। অথচ শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে কিছু চটকদার কথাবার্তা কম-বেশি আমরা সবাই বলি। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা উন্নয়নের চাবিকাঠি, শিক্ষাই শক্তি, শিক্ষকতা মহান পেশা, শিক্ষকরা সম্মানের প্রতীক ইত্যাদি।

আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের স্বভাবই হলো যেনতেন কাজে আন্দোলন করা। একই ব্যক্তির শাস্তি চাইতেও মিছিল করি আবার মুক্তি চাইতেও করি। নিরীহ আইন হ্যাঁ/না কণ্ঠভোটের মতো শক্তিবানদের উচ্চ আওয়াজের পক্ষেই রায় দেয়। তাই আন্দোলনই হয়ে ওঠে আমাদের দাবি আদায়ের একমাত্র পথ। কিন্তু সকল পেশার মানুষদের আন্দোলনের পথ ও ভাষা এক নয়। পরিবহন শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক ও বন্দর শ্রমিকরা যেভাবে দাবি আদায় করে শিক্ষকরা তা পারে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর শিল্প কারখানার আন্দোলনের পথ ও ভাষা ভিন্ন। আবার ডান্ডা বাহিনী ও ডাক্তারদের দাবি আদায়ের ভাষাও আলাদা। ফলে শিক্ষকদের মানবিক দাবি ও অধিকার যুগ যুগ ধরে অনাদায়ী রয়ে গেছে।

একজন ডাক্তার মিনিটে মিনিটে একজন করে রোগী দেখবেন, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, বাড়তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর খামখেয়ালি অপারেশন করে রোগীকে আরো ঘায়েল করার প্রাণবন্ত অভিলাষ। এভাবে এক এক করে সবার চরম অনৈতিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্র ও জনগণ অনেকটা মেনেই নিয়েছে। সমস্যা শুধু শিক্ষকদের নিয়ে। রাষ্ট্র ও জনগণের যত নিয়মনীতি আর সততা নিষ্ঠার কথা জানা আছে সব মাস্টার মশাইদের দ্বারা মানাতে হবে। এদের আশা আকাঙ্ক্ষা থাকতে নেই, স্বপ্ন উচ্চাভিলাষ অমার্জনীয়, গাড়ি বাড়ি থাকাটা দৃষ্টিকটু, দামি মোবাইল, ল্যাপটপ, ৪২ ইঞ্চি এলইডি টেলিভিশন অগ্রহণযোগ্য। তাদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি স্কলারশিপের দরকার নেই, বিদেশ ভ্রমণের জন্য অফিসিয়াল পাসপোর্টের প্রয়োজন সীমালঙ্ঘন, জীবনে একবারের জন্য হলেও বিদেশ ভ্রমণ বাতুলতামাত্র, উন্নত চিকিৎসা নিষ্প্রয়োজন। অফিস তো দূরের কথা, বসার জন্য নিজের একটা চেয়ার টেবিল পর্যন্ত থাকতে নেই। সবাইকে আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখাবে কিন্তু নিজেকে চলতে হবে ভাবহীন, প্রভাবহীন, চরম অর্থকষ্টে নিষ্পেষিত হওয়া নিত্য দুশ্চিন্তায় কপালে ভাঁজ পড়া পোড় খাওয়া মানুষের মূর্তরূপ নিয়ে।

জাবির ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে নবীন-বরণ ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপাচার্যদের মূল্যায়ন নিয়ে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম উষ্মা প্রকাশ করে বলেছিলেন, সব জায়গায় নিমন্ত্রণ পাই কিন্তু যেখানেই যাই বসার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে খুব অসহায় লাগে। উপাচার্য কোথায় বসবেন তার কোনো নির্দেশনা থাকে না। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সেক্রেটারি এমনকি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন র‍্যাংকের অফিসারদেরও নাম-ঠিকানা লেখা থাকে। কিন্তু উপাচার্য বসবেন সেটা কোথাও লেখা থাকে না। আমরা সবখানেই জায়গা পাই; কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে। যদিও এতে কিছু আসে যায় না কিন্তু বুঝতে পারি শিক্ষা-শিক্ষক কোথায় যেন একটা নিম্ন মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে। উপাচার্য যথার্থই বলেছেন। শিক্ষা তথা শিক্ষককে খাটো করার এক ঘৃণ্য তৎপরতা অনেকদিন থেকেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশে সকল স্তরের শিক্ষকরা বেতন-ভাতা তো বটেই, শ্রেণি-সম্মানেও বেশ দীর্ঘকাল যাবৎ করুণার পাত্র হয়ে একেবারে মানবেতর জীবনযাপন করে শিক্ষকতা করে আসছেন। ক্ষমতার দুর্দান্ত প্রতাপ তো আছেই, সেই সঙ্গে জনগণের টাকায় গাড়ি বাড়ির অসীম চাহিদা বিলাস ব্যসন আর দেশ-বিদেশে প্রমোদ ভ্রমণের রঙিন আকাঙ্ক্ষা এবং আবশ্যকতা একান্তই শুধু আমলারা গণিমতের মালের মতো গত চার-পাঁচ যুগ ধরে উপভোগ্য করে রেখেছেন।

যে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আলো দেন, চিন্তা ও কর্মে উদ্দীপনা দেন, যিনি আলোকিত সফল মানুষ তৈরির স্বপ্ন বীজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে রোপণ করেন। নির্মোহ সত্য হলো যে সমাজের কাছে, সন্তানের কাছে, স্ত্রী-শ্যালিকা-শ্যালকের কাছে সেই শিক্ষকই কিনা পোড় খাওয়া অসফল ব্যক্তির মোক্ষম উদাহরণ। পরিবারের চাহিদা যখন প্রশাসনে চাকরি করা মানুষের মতো সানন্দে চালানো যায় না কিংবা প্রতিদিন বেতন (ঘুষ) খাওয়া পুলিশের বউয়ের মতো বেপরোয়া কেনাকাটার ভাব দেখানো যায় না; তখন স্ত্রী-সন্তানের সব প্রশ্ন শুধু নীতিকথা দিয়ে মেটানো দায় হয়ে দাঁড়ায়। তবু জীবনের ঘানি তাকে টানতেই হবে। উর্দিতে ১৭টি পকেট থাকলে বুঝতে হবে উনি চৌকিদার। উর্দি দেখেই পুলিশ, র্যাব, আর্মি আর বিজিবি চেনা যায়। তৈলময় স্যারগিরি ও মাত্রাতিরিক্ত দাপট-প্রভাব দেখলে জানতে হবে তিনি আর কেউ নন, তিনি বিসিএস প্রশাসন। কিন্তু শিক্ষক চেনার উপায় কী? নিত্য অভাব তার পরিচিতি, শর্করা-আমিষহীন হাড় জিরজির শরীর তার রূপ, অক্ষমতা ও মুখাপেক্ষিতাই তার নিয়তি। সমাজ ও রাষ্ট্র তা-ই চায়! কারণ তিনি যে শিক্ষক।

অপরপক্ষে হায়দার হোসেনের গানের ভাষায় ‘আমি সরকারি অফিসার, আমি একালের জমিদার, আমাকে ছাড়া চালাবে এ দেশ সাধ্য কার বাবার?’ এই গানই জানিয়ে দিয়েছে সরকারি অফিসারদের চারিত্রিক মাধুর্যতা। নচিকেতার কণ্ঠেও শুনেছি ডাক্তাররা কত বড় মাপের সেবক ও দেশপ্রেমিক। আর সেবার ব্রত নিয়ে যিনি আজ শিক্ষক, সবাইকে চাকচিক্য জীবন চেনাতেই তাকে জীর্ণশীর্ণ ক্লান্ত পুষ্টিহীন শরীর নিয়ে মাস্টারির ঘানি টানতে হবে। তাই তো শেখ সেলিমের মতো অভিজ্ঞ সাংসদ/মন্ত্রীর মুখে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপককে নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে- ‘একজন শিক্ষকের এত গাড়ি-বাড়ি থাকার কথা নয়।’ সাবেক একজন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রীও নাকি শিক্ষকদের ‘মফিজ’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলেন।

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে ইউনেস্কো ও আইএলও’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনে শিক্ষকদের জন্য যে সনদ ঘোষণা করা হয় তাতে বলা হয়েছিল, ‘শিক্ষকেরা সব কর্মকাণ্ডের কারিগর, জাতিগঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তাদেরই। আগামী দিনের মর্যাদা ও উপযুক্ত নাগরিক তারাই তৈরি করেন। এই শিক্ষকদের মর্যাদার ক্ষেত্রে যেন কোনো ত্রুটি না ঘটে, রাষ্ট্রকে তা দেখতে হবে।’ কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আমাদের রাষ্ট্রে সেই দায়বোধ এখনো জাগ্রত হয়নি। ফলে শিক্ষকরা হর্ন-হেডলাইট ছাড়াই শিক্ষকতার ঘানি নীরবে নিভৃতে টেনেই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছে দেশকে!

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার ভারত কলঙ্কে লিখেছেন, ‘হরি নিতান্ত ভালো মানুষ। অর্থ- হরি নিতান্ত অপদার্থ।’ একইভাবে তিনি একজন শিক্ষক মানে তিনি একজন অতিশয় দরিদ্র লোক। সেই চিত্রই ফুটে উঠেছে লুৎফর রহমান রিটন নামের এক স্কুলশিক্ষকের কবিতায় যা ২৮ মে ২০১২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মূলত সেই বছর এপ্রিলের শেষদিকে শিক্ষকরা কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে ঢাকায় জমায়েত হলে নির্মম পুলিশি তাণ্ডবে আজিজুর রহমান নামের একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক নিহত হন। লুৎফর রহমান রিটন স্যারের লেখা ‘শিক্ষকের স্মারকলিপি’ কবিতার খণ্ডিত অংশ পাঠকদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরতে চাই যেখানে শিক্ষকতার ঘানি কিঞ্চিত প্রকাশ পেয়েছে- শিখিয়েছি গুরুজনে চিরকাল দিতে সম্মান/ শিখিয়েছি মানবতা নম্রতা মমতার গান। মানবজন্ম বৃথা যদি তার নাহি থাকে দান/ শিখিয়েছি দেশ-মাটি-মানুষের কিসে কল্যাণ। দারিদ্র্য আমাদের চেহারায় এঁকে দেয় ছাপ/ পেশাটা মহান তবে এ পেশায় আসাটাও পাপ!

 

লেখক : প্রফেসর, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads