• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
ভেজালের রকমফের

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ভেজালের রকমফের

  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০১৯

আলম শাইন

 

ছোট্ট একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করছি। আসলে এটিকে উদাহরণ বলা ঠিক হবে না, প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত বলা যায়। চিত্রটি স্বচক্ষে কারো দেখার ইচ্ছে হলে নদীপথে ঢাকার আশপাশ থেকে লঞ্চে সওয়ার হয়ে সদরঘাট আসতে হবে। তখন দেখা যাবে কিছু অসাধু দুধ ব্যবসায়ী দুধের ড্রামে নদীর জল মিশাচ্ছে। নদীর জল সরাসরি; বিষয়টা ভাবতে কেমন লাগছে! দুধে জল মিশানো অসাধুদের পুরনো অভ্যাস। অনেক জোকসও আছে এসব নিয়ে। কিন্তু সেটি যদি হয় টিউবলের জল, তবু তো মানা যায়। না তা নয়; ভেজালের মধ্যেও ভেজাল দিচ্ছে। অর্থাৎ দূষণমুক্ত জল নয়, একেবারে ঘোলাজল খাইয়ে ছাড়ছে।

বিষয়টা কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে? ভেজাল নয়, ভেজাল দ্রব্যের মধ্যেও ভেজাল দিচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, কৃত্রিম দুধ-ঘি-ডিম-চাল বানানোর খবরও জানতে পেরেছি আমরা। ভেজাল চাল নিয়ে ক’দিন আগেও এমন সংবাদ আমরা খবরের কাগজ মারফত জানতে পেরেছি। অপরদিকে প্যাকেটজাত দুধের অবস্থা আরো ভয়ানক। মাস দুই-তিনেক আগে বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে পর্যন্ত। পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে প্যাকেটজাত দুধ-দই নিয়ে। কীটনাশক, সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক এসব নাকি মেশানো হচ্ছে! এটা কী করে সম্ভব তা ভাবতেও আমাদের গা শিউরে ওঠে।

এরকম প্রতিটি জিনিসেই ভেজাল দিচ্ছে অসাধুরা। যার শত-শত দৃষ্টান্ত রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলে আরো অনেক ধরনের খাবারের বিষক্রিয়া ধরা পড়বে। বেরিয়ে আসবে মিশ্রিত বিষাক্ত কেমিক্যালের নামও।

খাদ্যদ্রব্য ছাড়াও প্রসাধনী সামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিতে ভেজাল দিয়ে আসল জিনিসের চেহারাও পাল্টে দিচ্ছে আজকাল। ফলে আসল-নকল চেনাই দুষ্কর হয়ে পড়েছে এখন। আমাদের সংবিধানের ১৮(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলে গণ্য হইবে।’ অথচ দেশে ঠিক উল্টোটি লক্ষ করছি আমরা। খাদ্যের পুষ্টিমান দূরের কথা, আসল খাদ্যই পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে এখন। ভেজালে ভেজালে সয়লাব যেসব খাবার, সেখানে পুষ্টি খোঁজার কী আছে আমাদের? ভেজালের জালে এমনভাবে জড়িয়ে গেছি আমরা যে, ইচ্ছে করলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না সহজেই। বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলে হয়তো না খেয়ে জীবন খোয়াতে হবে, নচেত খেয়ে জীবন খোয়াতে হবে; এমন একটা সংকটাপন্ন অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। সংগত কারণে বলা যেতে পারে, আমরা জিম্মি অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে।

আমরা জানি, উৎকৃষ্ট দ্রব্যের সঙ্গে নিকৃষ্ট দ্রব্যের মিশ্রণই হচ্ছে ভেজাল। ভেজালের রয়েছে নানান রকমফের। ভেজাল দিতে গিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে অসাধুরা বিভিন্ন কৌশলও অবলম্বন করছেন, যে কৌশলের কাছে আমরা বার বার হেরে যাচ্ছি। তার কারণ ভেজালের ধরন স্থায়ী নয়, একেকবার একেক ধরনের ভেজালের মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। অর্থাৎ কৌশল বদলানো হচ্ছে।

ভেজালের বিষয়টি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিনিয়ত ভেজাল খেয়ে খেয়ে এখন আজেবাজে খাবারও অনায়াসে হজম করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। এ অভ্যাস একদিনে হয়নি; রয়েসয়ে হয়েছে। দীর্ঘদিনের অনুশীলনে এমনটি হয়েছে। অবশ্য এটিকে অনুশীলন বলা ঠিক হবে না। বলতে হবে পর্যায়ক্রমে ভেজাল খেয়ে খেয়ে অমন সহনশীল পর্যায়ে পৌঁছেছি আমরা। তবে বেশিরভাগই ঘটেছে অজান্তে। আবার জেনেশুনেও কিছু খাবার খাচ্ছি আমরা। যেমন ফল-ফলাদি কিংবা ফরমালিন দেওয়া মাছ অথবা ডিটিটি মাখানো শুঁটকি। এ খাবারগুলো জানা সত্ত্বেও খাচ্ছি আমরা। ফলের ক্ষেত্রে ব্যপারটা ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মাছ তো খেতেই হবে। সুতরাং জেনেই অথবা উপায়ান্তর না থাকায় আমরা খেতে বাধ্য হচ্ছি

বিষমিশ্রিত খাবার। আমরা আগে খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে ভেজাল খেতাম, এখন সেই ভেজালও নেই। সেই ভেজালের মধ্যেই আবার ভেজাল দিচ্ছেন অসাধুরা। অর্থাৎ এক নম্বর নয়, দুই নম্বর ভেজাল খাচ্ছি আমরা। পরিণামে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে।

আমরা জানি, সমগ্র বিশ্বেই খাদ্যে ভেজালের প্রবণতা কমবেশি দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেন একটু বেশি। আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসারসহ অন্যান্য প্রাণঘাতী অসুখের অন্যতম কারণ হচ্ছে খাদ্যে ভেজাল। এখন কথা হচ্ছে, আমরা যে হারে ভেজাল খাচ্ছি, সে হারে কিন্তু আমাদের রোগ-ব্যারাম সহজে ধরা পড়ছে না। অথবা শনাক্ত করাতে পারছি না। অথবা ধীরলয়ে অসুস্থ হওয়ায় আমরা তা টের পাচ্ছি না। আসলে ভেজালের বিষক্রিয়া খুব দ্রুত ছড়িয়ে না পড়ায় এমনটি ঘটছে। ফলে অনেকেরই ধারণা, ভেজাল মিশ্রিত খাবার খেলে খুব বেশি কিছু ক্ষতি হয় না; বড়জোর পেটের ব্যামো হতে পারে। অধিকাংশ মানুষের ধারণাই এমন। কাজেই ভেজালে আপত্তি নেই; সেই অবুঝ মানুষের কাছে। ওই যে আমরা আগেই বলেছি, সয়ে গেছে; আসলেও অনেকটা সেরকম।

বলতে দ্বিধা নেই, ভেজালে ভেজালে সয়লাব এদেশের পণ্যসামগ্রী কিংবা খাবার-দাবার। কোথায় নেই ভেজাল! ওষুধ থেকে শুরু করে কাফনের কাপড়ে পর্যন্ত ভেজাল দিচ্ছে অসাধুরা। খাদ্যদ্রব্যের কথায় আর বলার কিছু নেই! শতকরা পঁচানব্বই ভাগ মৌসুমি ফল ও শাক-সবজিতে এখন কেমিক্যাল মেশানো হচ্ছে। মাছ, গুঁড়া মসলা, শিশু খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এখন নিত্যদিনের ঘটনা। রোজার মাসে বিষয়টি আরো কঠিন পর্যায়ে পৌঁছে আমাদের দেশে। জিলাপি মচমচে রাখতে মবিল মেশানো হচ্ছে। মুড়ি ধবধবে করতে মেশাচ্ছে হচ্ছে ইউরিয়াসহ নানান কেমিক্যাল। কিছু নামিদামি কোম্পানি তরল শরবতের বোতলের লেবেলে বিভিন্ন ফলের ছবি এঁকে দিলেও ফলের কোনো নির্যাস পায়নি বিএসটিআই। শুধু নামিদামি কোম্পানিই নয়, ফুটপাতের দোকানি মাছে দেওয়ার বরফ গলিয়ে শরবত বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন রোজাদারকে।

ফলমূলে ফরমালিন তো মামুলি; আরো কতসব কেমিক্যাল ব্যবহার করছে অসাধুরা যার ফিরিস্তি দেওয়াও কঠিন। কেমিক্যাল মিশ্রিত সেসব ফলমূল কিংবা খাদ্যসামগ্রী খেয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে মানুষ। তা কিন্তু সহজে টের পাচ্ছে না কেউ। টের পাচ্ছে না কেউই কেন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে, কিডনি-লিভার বিকল হচ্ছে অথবা ডায়াবেটিস, হূদরোগসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কারণ বিষয়টি খুব সহজে বোঝার উপায় নেই। পরিশেষে রোগ-ব্যারাম বাঁধিয়ে হাসপাতালে গিয়েও স্বস্তি পাচ্ছেন না রোগীরা। সেখানেও আরেক দফা ভেজালের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধের খপ্পরে পড়ে রোগ জটিলতর পর্যায়ে পৌঁছানোর ফলে দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

সম্প্রতি আমরা দেখেছি রাজধানীর নামিদামি হাসপাতালগুলোর চিত্র। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল ওষুধে সয়লাব। কয়েক মাস আগেও ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব হাসপাতালকে বিপুল অঙ্কের টাকা জরিমানাও করেছে। তাতেও কাজ হয়নি। বরং তাদের কাজ তারা বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসার নামে রোগীর মুণ্ডুপাত করছেন। সেই অপচিকিৎসা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না শিশু কিংবা গর্ভবতীরাও। ভূরিভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে ওরকম। হিসাব কষে বলা মুশকিল এই মুহূর্তে। শুধু এটুকুই বলব আমরা, ভেজাল খেয়ে জটিলরোগ বাধিয়ে শেষ আশ্রয়স্থলে গিয়েও নিস্তার নেই আমাদের। সেখানকার ভেজাল আবার একটু ভিন্ন ধরনের। রয়েসয়ে অঙ্ক কষে তবেই রোগীর ওপর ফলানো হচ্ছে। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, অহেতুক আইসিইউ-তে ভর্তি করিয়ে রোগীর আপনজনকেও রোগী বানানোর হিড়িক চলছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের আর ভরসাস্থল রইল কোথায়! ভেজালের আগ্রাসন, হাসপাতালে দুর্নীতি; সব মিলিয়ে যেন টিকে থাকাই দায় এখন।

তাই আমরা বলতে পারি, ভেজালের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। শুধু জেল-জরিমানাই নয়, মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন পাস করা উচিত বলে মনে করছি আমরা। না হলে ভেজালের পুনরাবৃত্তি রহিতকরণ সম্ভব নয়।

 

লেখক : বন্যপ্রাণী বিশারদ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads