• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
হুমকির সম্মুখীন রাজধানীর পরিবেশ

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

হুমকির সম্মুখীন রাজধানীর পরিবেশ

  • প্রকাশিত ২৮ মে ২০১৯

মু. হামিদুর রশিদ জামিল

 

ঢাকা অধিক জনসংখ্যার নগরী। ঢাকায় এমন একটি স্থান নেই, যেখানে পরিবেশ দূষণ হয় না। শুধু দূষণ নয়, দূষণের সঙ্গে বিষক্রিয়াও বিদ্যমান। ঢাকার পরিবেশ এতই দূষিত যে, কোথাও নাকে রুমাল/মাস্ক পরা ছাড়া হাঁটা-ই যায় না। বিশ্বে সবচেয়ে বায়ুদূষণের কবলে থাকা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা শীর্ষ কয়েকটি দেশের একটি। আর রাজধানী শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। ‘বিশ্ব বাতাসের মান প্রতিবেদন ২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে থাকা শহরগুলোর তালিকাটি এয়ার ভিজ্যুয়ালের ওয়েবসাইটে ৫ মার্চ প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের ৭৩টি দেশের বায়ুর মানের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ঢাকার বাতাসে এই কণিকার মাত্রা ২০১৮ সালে ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৭ সালে এই মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৯ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৯ সালের ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর গত বছর সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাব অনুযায়ী, ১৯ ও ২০ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় রাত ১১টার দিকে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় ঢাকা ছিল এক নম্বরে। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নয়াদিল্লি। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয় তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে। কিন্তু সারা বিশ্বে এ ধরনের মৃত্যুর গড় মাত্র ১৬ শতাংশ।

 

ঢাকা শহরে মলমূত্র নিষ্কাশনের জন্য নেই কোনো ব্যবস্থা। পৃথিবীর যে কোনো শহরে নানা অসুখের উৎস এসব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নগর কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবমতে, ঢাকার মলমূত্রের মাত্র দুই শতাংশ নিরাপদ নিষ্কাশন হয়। বাদবাকি পুরোটাই আবারো মিশে যায় প্রকৃতিতে। তারপর পানির উৎসে। ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস ও ইউনিসেফের তথ্যমতে, ঢাকায় সরবরাহ করা পানির দুই-তৃতীয়াংশে মলবাহিত জীবাণু পাওয়া যায়। আর এটি ঢাকায় জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকির একটি। যার ফল হলো, ঢাকা শহরে বছরে দুবার ডায়রিয়ার উপদ্রব দেখা দেয়।

 

প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি অন্যতম উপাদান হচ্ছে পানি, পয়ঃনিষ্কাশন এবং পরিচ্ছন্নতা। পানি সরবরাহের দিক থেকে আমরা অনেকটা এগোলেও ভোক্তা পর্যায়ে যে পানি পৌঁছায় তার মান খুবই খারাপ। তার একটা বড় কারণ হচ্ছে, আমরা স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো করতে পারিনি। তাই একটু বৃষ্টি হলেই সুয়ারেজ, ড্রেন আর পাইপের পানি সব একাকার হয়ে যায়। নিয়মিত খোঁড়াখুঁড়িও এই মিশ্রণের জন্য দায়ী।

 

ঢাকার যেখানেই যাবেন, সেখানে দেখতে পাবেন আবর্জনার স্তূপ। আবর্জনা রাখার কনটেইনারগুলোর অবস্থাও করুণ। অনেক ক্ষেত্রে ব্যস্ততম রাস্তার মাঝখানেই বসানো হয়েছে। কিন্তু আবর্জনা রাখা হয় কনটেইনারের ভেতরের চেয়ে বাইরেই বেশি। সেগুলো সরানো হয় না সহসা। ফলে আবর্জনাগুলো রাস্তাজুড়েই পড়ে থাকে। এসব পচে-গলে রস নিংড়ে পড়ে সমগ্র রাস্তায়। ফলে সৃষ্টি হয় মহাদুর্গন্ধ। কয়েকদিন পরপর কনটেইনারগুলোর ময়লা নিয়ে ফেলা হয় শহরের যেখানে ফাঁকা পাওয়া যায় সেখানেই। তাই সৌন্দর্য ও পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তা থেকে নির্গত গন্ধে মানুষের বিভিন্ন জটিল ও স্থায়ী ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। মশা-মাছির বিস্তার ঘটছে। উপরন্তু এই ময়লার অনেক অংশ ড্রেনের মধ্যে ঢুকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নিষ্কাশন। ফলে দূষিত পানি নিষ্কাশন হতে না পেরে রাস্তার ওপরই উপচে পড়ছে। সর্বোপরি বৃষ্টি হলেই পানি দ্রুত যেতে না পেরে গোটা শহর অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়। তবু ময়লা ও ড্রেন পরিষ্কার করার কাজটি নিয়মিতভাবে হচ্ছে না। অথচ এসব কাজ নিয়মিত করার বিধান আছে।

 

বহু বছর পর এবার সুয়ারেজ লাইন বা ড্রেন পরিষ্কার করতে দেখা গেছে। কিন্তু তার সুফল তেমন পাওয়া যায়নি। কারণ ড্রেনের ভেতরের ময়লা তুলে পাশেই স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। ফলে ময়লাগুলো মানুষের পায়ে পায়ে আর যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে পুনরায় ড্রেনের ভেতরে ঢুকেছে। ড্রেন বন্ধ হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ, যত্রতত্র গড়ে ওঠা তরকারির দোকানের বর্জ্য ও নির্মাণসামগ্রী তথা বালি, সিমেন্ট ও ইটের ভগ্নাংশ। এগুলো ড্রেনের মধ্যে ঢুকে পড়ায় বন্ধ হয়ে যায়। অথচ এগুলো রাস্তার ধারে রাখা নিষিদ্ধ। কিন্তু নিয়ম পালন করেন না কেউই। অপরদিকে প্রতিটি বাসার ময়লা নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসরকারি খাতকে। এ জন্য তারা প্রতি মাসে টাকাও নেয়। শর্ত প্রতিদিনই ময়লা নিতে হবে। কিন্তু তারা এই শর্ত পালন করে না।

 

যদিও ঢাকা ওয়াসার আওতাভুক্ত এলাকা ৪০০ বর্গকিলোমিটার। সব এলাকায় ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলতে পারেনি। অন্যদিকে রাজধানীতে ঢাকা জেলা প্রশাসনের মালিকানাধীন ২৬টি খাল রয়েছে। এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে ঢাকা ওয়াসা। দখল-ভরাটে এসব খালের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে মাণ্ডা, হাজারীবাগ, কসাইবাড়ী, সাংবাদিক কলোনি ও বাইশটেকি খাল ব্যক্তিমালিকানায় রেকর্ড হয়ে রয়েছে। অভিযোগ মিলেছে, জাল-জালিয়াত চক্র এটা করেছে। ওইসব খাল দখলমুক্ত করা জেলা প্রশাসন, ঢাকা ওয়াসা ও দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

 

ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাওয়া খালগুলো টিকিয়ে রাখতে ঢাকা ওয়াসা খালের জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও প্রকল্প অনুমোদন না পাওয়ায় সেসব উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসন মালিকানাধীন খালগুলোও দখল ও ভরাটের কবলে হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন খালগুলো উদ্ধারের চেষ্টা চালালেও রহস্যজনক কারণে সেসব থমকে আছে।

 

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতিদিন পাঁচ হাজার টনের বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। শহরটিতে জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, মানুষজনের তৈরি ময়লা আবর্জনাও বাড়ছে। আমরা ন্যাচারাল ড্রেনেজ সিস্টেম ধ্বংস করে ফেলেছি। এখন আমরা যেটা করছি, সেটা আর্টিফিসিয়াল ড্রেনেজ সিস্টেম। ঢাকা শহরের পরিবেশের অবস্থা বর্তমানে মৃতপ্রায়। ঢাকা শহরে বাস করার পরিবেশ এখন আর নেই। তবু মানুষ বসবাস করছে কর্মের সুবাদে। অতএব, রাজধানীতে যারা বসবাস করেন, তারা প্রায়ই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। দেশটি আমার মনে করে যদি আমি কাজ করি, তাহলে এই দেশ, এই শহর অনেক এগিয়ে যাবে।

 

লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads