• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
কুষ্ঠরোগ : অবহেলাই ভোগান্তির কারণ

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

কুষ্ঠরোগ : অবহেলাই ভোগান্তির কারণ

  • মো. সাজেদুল ইসলাম
  • প্রকাশিত ৩১ মে ২০১৯

কুষ্ঠ বিষয়টির প্রতি অব্যাহত অবহেলা ও অবজ্ঞার কারণে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অন্যতম একটি জাতীয় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। কুষ্ঠ মূলত স্বাস্থ্যসম্পর্কিত একটি সমস্যা হলেও এর কারণে সামাজিক ও অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা কুসংস্কারের সম্মুখীন হয়েছেন। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি ও এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যরা এখনো বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন; যেমন কর্মের, শিক্ষার সুযোগ ও সামাজিক জীবন থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। যে কোনো সমস্যা দূরীকরণের জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। কুষ্ঠও এর ব্যতিক্রম নয়। বিগত বছরগুলোতে এই খাতে প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম অর্থ বরাদ্দের কারণে কুষ্ঠ নির্মূল কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবেই বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

নতুন কুষ্ঠরোগী শনাক্তকরণ হচ্ছে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের একটি অন্যতম প্রধান বিষয়। প্রাথমিক পর্যায়ে কুষ্ঠ চিহ্নিতকরণ এবং চিকিৎসাই হচ্ছে কুষ্ঠ নির্মূলের মূল চাবিকাঠি। এর ফলে সমাজে কুষ্ঠরোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব। কিন্তু পর্যাপ্ত বাজেট না থাকায় সারা দেশে এই কার্যক্রমটি ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ যেমন সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ, ফলোআপ, মনিটরিং, সচেতনতামূলক প্রচারণা, তথ্য সংবলিত প্রচারপত্র ও সরঞ্জামাদি এবং নতুন রোগী চিহ্নিত করার জন্য জরিপ। এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

কুষ্ঠ নিয়ে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়নকর্মীরা মনে করেন, এ বিষয়টি সরকারের কাছে তেমন গুরুত্ব না পাওয়ায় এই খাতে বাজেট কম। এই অপ্রতুল বাজেটের কারণে কুষ্ঠ নির্মূল কমসূচি সঠিকভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা যেমন সিএইচসিপি, স্বাস্থ্য সহকারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন। সারা দেশে ৬৪টি জেলায় এই কর্মসূচিগুলো সম্পাদন করার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, তা না থাকায় স্তিমিত হয়ে পড়েছে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম।

২০১৩ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে অনুষ্ঠিত কুষ্ঠ বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে এই রোগ দূরীকরণে আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কৌশলপত্র (২০১৬-২০২০) অর্জন করতে চাইলে এ খাতে ব্যাপক বরাদ্দ দেওয়া দরকার। এই কৌশলপত্রের লক্ষ্য হচ্ছে বৈশ্বিক ও স্থানীয়ভাবে কুষ্ঠমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা। এই কৌশলপত্রে সময়মতো রোগী শনাক্তকরণের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।

বিশ স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী প্রণীত বাংলাদেশের কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্রেও (২০১৬-২০) কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠন করার কথা বলা হয়েছে। এই কৌশলপত্রে কুষ্ঠ ও এর জটিলতা রোধ, দ্রুত রোগী শনাক্তকরণ এবং এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করার ওপর জোর দিয়েছে। ওই কৌশলপত্র অনুযায়ী বাংলাদেশ কুষ্ঠমুক্ত দেশ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারে না। আগামী বাজেটে এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা জরুরি, যাতে উক্ত কৌশলপত্রের লক্ষ্য সহজেই অর্জন করা যায়। গণমাধ্যমের উচিত এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরা।

কুষ্ঠ নিয়ে কর্মরত জাতীয় প্রতিষ্ঠান দি লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি) এর মতে, কুষ্ঠ একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বল্প সংক্রামক রোগ যা সাধারণত প্রান্তিক স্নায়ু, নাকের শৈশ্লিক ঝিল্লি এবং অন্যান্য কোষকলা আক্রান্ত হয়। কুষ্ঠ একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। সময়মতো চিকিৎসা নিলে কুষ্ঠরোগ সম্পূর্ণ ভালো হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসায় প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ সম্ভব। সারা দেশে এর পরীক্ষা ও চিকিৎসা বিনামূল্যে পাওয়া যায়।

কুষ্ঠরোগের ওপর যথেষ্ট সচেতনতামূলক কার্যক্রম না থাকার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারে না যে, তিনি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত। সেইসঙ্গে দৈনন্দিন কার্যক্রম ব্যাহত হয় না। কুষ্ঠরোগের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি অন্যান্য রোগ থেকে ভিন্ন। প্রাথমিক পর্যায়ে আক্রান্ত ব্যক্তির কোনো বিকলাঙ্গতা বা প্রতিবন্ধিতা আসে না। যার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী চিকিৎসায় আসতে অনীহা প্রকাশ করে।  এ ছাড়া কুষ্ঠ রোগ ও রোগী নিয়ে সমাজে অনেক কুসংস্কার ও ভুল ধারণা এখনো আছে। যে কারণে অনেকে এ রোগে আক্রান্ত জানার পরও চিকিৎসা নিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন ও অনেক সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। 

জাতীয় কুষ্ঠ উচ্ছেদ কর্মসূচির তথ্যমতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪ হাজার নতুন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ রোগী সময়মতো সঠিক চিকিৎসায় না আসার কারণে প্রতিবন্ধিতার শিকার হচ্ছে। একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৩৪ হাজার থেকে ৩৫ হাজার কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তি প্রতিবন্ধিতার শিকার হয়েছেন।

যখন কোনো এলাকায় কোনো নতুন কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হয়, তখন ওই এলাকায় আর কোনো নতুন রোগী আছে কি না, সেটা জানার জন্য একটি জরিপ পরিচালনা করা উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, সম্পদের স্বল্পতা হেতু এটি সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। জাতীয় কুষ্ঠ উচ্ছেদ কর্মসূচি হচ্ছে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমগুলোর বাস্তবায়ন, সমন্বয় সাধন ও মনিটরিং করার জন্য প্রধান সরকারি কর্তৃপক্ষ। এই কর্মসূচির অধীনে রয়েছে পিও, টিএলসিএ, এইচএ এবং সিএইচসিপি। কিন্তু তহবিল স্বল্পতার কারণে যাদের কুষ্ঠ বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।

আর্থিক অপর্যাপ্ততার কারণে কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরির ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কুষ্ঠবিষয়ক দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে আমাদের দেশে। আমাদের দেশে বিশেষায়িত কুষ্ঠসেবাগুলোর অপ্রতুলতা রয়েছে। মাঝে মধ্যে ওষুধ সেবনের পর কোনো কোনো রোগীর রিঅ্যাকশন দেখা দেয়। আমাদের সেবাকেন্দ্রগুলোর এরকম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো সামর্থ্যের অভাব রয়েছে।

অর্থ স্বল্পতার কারণে মাঠ পর্যায়ে টিএলসিএ এবং পিও-দের সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম পরিচালনা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা প্রয়োজনীয় অর্থাভাবে দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। টিএলসিএ এবং পিও-দের কুষ্ঠ সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও রোগীদের সার্বিক সেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নতুন রোগী শনাক্ত করার জন্য স্কিন ক্যাম্প পরিচালনা করা অতীব প্রয়োজন। কুষ্ঠরোগী শনাক্তকরণ কার্যক্রম আরো বেশি ফলপ্রসূ হবে যদি সরকারি কর্মচারী, স্বাস্থ্যকর্মী ও সিএইচসিপিদের এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করা হয়। নতুন রোগী শনাক্তকরণে তারা আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারে যদি তাদের কুষ্ঠবিষয়ক আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।

মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে বিশেষায়িত কুষ্ঠসেবাসমূহ যেমন- রিকন্সট্রাকটিভ সার্জারি চালু করা প্রয়োজন। এই সার্জারির মাধ্যমে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ আবার তার কর্মক্ষমতা ফিরে পেতে পারে। এ কাজেও যথেষ্ট বাজেটের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় ভূমিকা গ্রহণ করা, অন্যথায় কুষ্ঠ নির্মূল কর্মসূচি কখনোই সাফল্যের মুখ দেখবে না।

কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জন্য যেসব বিষয় আলোকপাত করা হলো, সেগুলো প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেজন্য অর্থসংক্রান্ত সমস্যা দূর করা জরুরি। কারণ কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এটা একটা ধর্তব্যের বিষয় যে, অপর্যাপ্ত তহবিল এবং প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে মাঠপর্যায়ে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমগুলো স্তিমিত হয়ে পড়ছে। কিছু কিছু বেসরকারি সংস্থা তাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় কুষ্ঠ উচ্ছেদ কর্মসূচিকে সহায়তা করছে, যদিও বর্তমানে তা পরিচালনা করা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং সেই সঙ্গে এ খাতে জাতীয় বাজেটে আরো বেশি বরাদ্দ রাখা। সরকারের উচিত আরো বেশি মনোযোগী হওয়া, যেহেতু কুষ্ঠ এখনো আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে কুষ্ঠ সংক্রমণের হারের দিকে তাকালে দেখা যায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রয়োজনীয় বরাদ্দ করা অর্থে আমরা শুধু যে কুষ্ঠজনিত স্বাস্থ্য সমস্যাই প্রতিরোধ করতে পারব তা নয়, সেই সঙ্গে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতাও প্রতিরোধ করা সম্ভবপর হবে এবং আক্রান্ত ব্যক্তিদের আমরা দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করতে পারব। যদি সরকারিভাবে যথেষ্ট মনোযোগ না দেওয়া হয়, তা হলে কুষ্ঠরোগজনিত ভোগান্তি আমাদের চলতেই থাকবে এবং এর কারণে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। আমরা আশা করব, সরকার উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আসন্ন বাজেটে এই খাতে আরো বেশি অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করবেন। কুষ্ঠ নির্মূল কর্মসূচিতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ পাওয়া গেলে আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে এটা একটা মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।

 

লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads