সারা মাস রোজা রাখার পর ঈদ আসে খুশির বারতা নিয়ে। আনন্দের উৎস হয়ে। আমরা যারা পরিবার থেকে দূরে থাকি জীবন-জীবিকার অন্বেষণে, তারা ঈদ উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে নিজ বাড়িতে ছুটে আসি আত্মীয়-স্বজন, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। কিন্তু এই আনন্দের মুহূর্ত অনেকের কাছে নিরানন্দ হয়ে যায়। কারণ, প্রতি বছর ঈদে ঘরে ফিরতে ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। সবটুকু ঝামেলা যাতায়াতের পথেই। রাজধানী থেকে দূরের জেলাগুলোতে পৌঁছতে হয়রানি হতে হয় পদে পদে। যানবাহন সংকট, আকাশচুম্বী ভাড়া, যানজট, লাখ লাখ মানুষ; সব মিলিয়ে ঈদে ঘরে ফেরা যেন এক ধরনের যুদ্ধ। এ সময় বাস-ট্রেন-লঞ্চ এমনকি আকাশপথেও জট সৃষ্টি হয়। আবার এমনও দেখা যায় আসার বা যাওয়ার পথে অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হন, যার ফলে তার ও তার পরিবারে নেমে আসে কালবৈশাখী ঝড়। যে ঝড়ে তছনছ করে দেয় জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহ। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান সরকারের উদ্যোগে দেশের দক্ষিণাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের মানুষের নির্বিঘ্ন যাতায়াতে বেশকিছু উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এতেই এই ঈদের যাতায়াতে কিছুটা হলেও দুর্ভোগ লাঘব হবে। কমবে প্রাণ ও জানহানি।
এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীতে বাস করা প্রায় দুই কোটির মধ্যে অন্তত ৮০ লাখ মানুষ ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরেন। যাদের নিজস্ব পরিবহন আছে তারা স্বস্তিতে ফিরলেও যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয়। আর অনেকটা জীবন-মৃত্যু বাজি ধরেই ঘরে ফেরে নিম্নবিত্তসহ আমজনতা। প্রতি বছর গাড়ির দীর্ঘ লাইনের কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে চান্দনা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার রাস্তা র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় সেখানেও ভোগান্তি। সবচেয়ে আশংকাজনক অবস্থায় রয়েছে ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের রুট। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরি পারাপারের কারণে এই এলাকার ভোগান্তি একরকম নিশ্চিত হয়ে আছে।
আসন্ন ঈদযাত্রাকে সামনে রেখে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, ঈদ ও ঈদ-পরবর্তী সময়ে সড়কপথে দুর্ঘটনা এড়াতে গাড়ির চালককে দায়িত্বশীল হয়ে গাড়ি চালাতে হবে। বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও ফিটনেস ছাড়া কোনো গাড়ি রাস্তায় চলতে পারবে না। গাড়ির মালিকপক্ষ কোনো মাদকাসক্ত ড্রাইভারের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং দেবেন না। সেইসঙ্গে চালক, হেলপার বা পরিবহন সেক্টরের কাউকে মাদকাসক্ত বলে সন্দেহ হলে পুলিশের সহায়তায় ডোপ টেস্ট করানোর আহ্বান জানিয়েছেন। কমিশনার বলেন, ঈদে যানজট ও জনজট সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পুলিশ, পরিবহন মালিক-শ্রমিক, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, জনসাধারণ ও যাত্রীসহ প্রত্যেকের নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব রয়েছে। ঈদে সড়কে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় ঢাকার বাহির পথের মুখ যানজটমুক্ত রাখতে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
তিনি বলেন, টার্মিনালে গাড়িতে যাত্রী ওঠানোর পর নির্ধারিত হলুদ দাগ ক্রস করলে গাড়ি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। টার্মিনাল থেকে গাড়ি ছাড়ার আগে বাস মালিক-শ্রমিক ও পুলিশের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ড্রাইভারের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস চেক করে গাড়ি রাস্তায় নামতে দেবেন। কোনো অবস্থায় বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ও গাড়ির ফিটনেস ছাড়া গাড়ি রাস্তায় চলতে দেওয়া হবে না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় সম্পর্কে কমিশনার বলেন, ঈদ এলে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। বিআরটিএ কর্তৃক প্রদত্ত ভাড়ার তালিকার অতিরিক্ত ভাড়া নিলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনা হবে। যাত্রীদের ব্যাগ টানাটানি করে কোনো রকম হয়রানি করা যাবে না।
চালকদের উদ্দেশে কমিশনার বলেন, গাড়ির চালকরা সুযোগ পেলে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান, মোবাইলে কথা বলতে বলতে গাড়ি চালান। গাড়ি চালানো অবস্থায় এমনটি করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মাদক আমাদের বড় সমস্যা। আপনার মাদক সেবন করবেন না। মাদক আপনার সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করছে। পরিবহন মালিক পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়ে কমিশনার বলেন, কোনো মাদকাসক্তকে গাড়িতে চাকরি দেবেন না। ড্রাইভার না থাকলে হেলপারকে গাড়ি চালাতে দেবেন না। ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করুন।
এখন কথা হলো, প্রতি বছরই ঈদের আগে আগে এমন সভা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় সড়ক মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা, হয়রানি এবং দুর্ঘটনা ঘটছেই। সতেরো কোটি মানুষের এই দেশে ঈদে বাড়ি ফিরতে রাজধানীর বিপুল পরিমাণ মানুষের যে চাপ তা সামাল দেওয়া সত্যি কঠিন। সময় নিয়ে দেশের সবদিকের সড়ক-মহাসড়কগুলো যথাযথভাবে সংস্কার করা হলে সাধারণে ভোগান্তি দূর হবে। এবারের ঈদযাত্রা মাথায় রেখে সাধারণের বাড়ি ফিরতে দেশের উল্লেখযোগ্য রাস্তাগুলো নির্ঝঞ্ঝাট রাখতে হবে। যেহেতু যানজট কিংবা ভাঙাচোরা রাস্তার ভোগান্তি লাঘব করা সরকার সংশ্লিষ্ট মহলের দায়িত্ব। তাই মহাসড়কগুলোর যানজট নিরসনসহ সব ধরনের হয়রানি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ট্রাফিক পুলিশকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। পাশাপাশি ড্রাইভারদের অতিরিক্ত ভাড়া কামানোর লোভ এবং মহাসড়কে তাড়াহুড়ো ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। তবেই ঈদ আনন্দে কোনো নিরানন্দ বলয় সৃষ্টি করবে না- এই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়