• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
শস্য সংগ্রহের সময়োপযোগী নীতিমালা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

শস্য সংগ্রহের সময়োপযোগী নীতিমালা

  • নিতাই চন্দ্র রায়
  • প্রকাশিত ০২ জুন ২০১৯

এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তারপরও বিপদে পড়েছেন দুর্ভাগা কৃষক। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ পড়েছে ৩৬ টাকা। আর সেই ধান সারা দেশের হাটবাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ টাকা কেজি দরে। কারো কারো মতে, প্রতি মণ ধানে কৃষকের লোকসান হচ্ছে প্রায় ২০০ টাকা। সরকার চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ১ লাখ ৫০ হাজার টন ধান সংগ্রহ করবে প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে। আর চুক্তিবদ্ধ মিল মালিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল। এর মধ্যে ১০ লাখ টন সিদ্ধ চাল প্রতি কেজি ৩৬ টাকা দরে এবং ১ লাখ ৫০ হাজার টন আতপ চাল প্রতি কেজি ৩৫ টাকা দরে। এতে লাভবান হবে চাল ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা।

দেশে এবার বোরো মৌসুমে ১ কোটি ৯৬ লাখ টন চাল উৎপাদিত হতে পারে। ২৮ কেজি চাল তৈরির জন্য ৪০ কেজি ধানের প্রয়োজন হয়। সে হিসাবে চলতি বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭৮ লাখ টন ধান উৎপাদিত হতে পারে। এর মধ্য থেকে সরকার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনবে মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টন এবং মিল মালিকদের কাছ থেকে চাল কিনবে ১১ লাখ ৫০ হাজার টন, যা ধানে রূপান্তর করলে পরিমাণ দাঁড়ায় ১৬ লাখ ৫০ হাজার টন। এক কথায় বোরো মৌসুমে উৎপাদিত ১৮ লাখ টন ধান সরকারিভাবে কেনা হবে। সেই হিসাবে এবারের বোরো মৌসুমে সরকার উৎপাদিত ধানের মাত্র ৬ দশমিক ৪৭ ভাগ সংগ্রহ করবে। আর কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হবে উৎপাদিত ধানের মাত্র দশমিক ৫৩ ভাগ, যা ধানের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে কৃষকের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। কৃষকের কাছ থেকে এত কম পরিমাণ ধান সংগ্রহের অন্যতম কারণ হলো দেশে যেসব সরকারি শস্যগুদাম আছে, সেগুলো তৈরি করা হয়েছে চাল ও গম সংগ্রহের জন্য, ধান সংগ্রহের জন্য নয়।

কোনো কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পাদনের জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। নীতিমালা যত ভালো হবে, বস্তুনিষ্ঠ হবে, কাজটি তত সুন্দরভাবে সম্পাদিত হবে, যদি তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। নীতিমালা হলো সিদ্ধান্ত এবং ফলাফল লাভের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সম্প্রতি দেশের কৃষির টেকসই উন্নয়নে প্রণয়ন করা হয়েছে জাতীয় কৃষি নীতি ২০১৮। তাতে কৃষকের কাছ থেকে সরকারি গুদামে সরাসরি শস্য কেনার সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয় উল্লেখ নেই। দেখা যাচ্ছে সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহের বিদ্যমান নীতিমালাও কৃষকের স্বার্থের অনুকূলে নয়।

সরকার ইতোমধ্যে কৃষকের স্বার্থে বিদেশ থেকে চাল আমদানি শুল্ক ২৮ থেকে ৫৫ শতাংশে বৃদ্ধি করেছে। বিদেশে ৫ থেকে ১০ লাখ টন চাল রপ্তানির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী সবুজ সংকেত দিয়েছেন। উৎপাদিত বোরো ধানের হিসাব-নিকাশপূর্বক চুলচেরা বিশ্লেষণ করে এ ব্যাপারে শিগগির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। কৃষিমন্ত্রীর কথা, উদ্বৃত্ত চাল থাকলে বিদেশে মোটা চাল রপ্তানি করা হবে। এতে কৃষক উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্য মূল্য পাবেন। অন্যদিকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার কৃষকের এই দুর্দিনে শুনিয়েছেন নতুন আশার বাণী। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০০টি স্টিলের মিনি পেডি সাইলো নির্মাণ করা হবে। একটি মিনি পেডি সাইলোর ধারণক্ষমতা হবে ৫ হাজার টন পর্যন্ত। এসব সাইলোতে কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ধান ২ থেকে ৩ বছর সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। আগামী বোরো মৌসুমের আগেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি এ ধরনের সাইলো নির্মাণ সম্ভব হবে বলে খাদ্যমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন এবং ওই ১০০টি মিনি পেডি সাইলোর মাধ্যমে আগামী বোরো মৌসুমে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ৫ লাখ টন ধান সরকার নির্ধারিত মূল্যে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। পরবর্তী বছরে আরো ৫ লাখ টন ধান কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কেনা যাবে।

এখন দেশের কিছু কিছু স্থানে সরকারিভাবে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ শুরু করা হয়েছে। এই সংগ্রহ অভিযান চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। সরকারিভাবে ধান সংগ্রহ নিয়ে নানা রকম দুর্নীতি ও দলবাজির খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের বিভিন্ন চিনিকলে কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি আখ সংগ্রহ ও মূল্য প্রদানের নীতিমালাটি আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের ১৫টি চিনিকলে প্রতিবছর ১৫ থেকে ১৬ লাখ টন আখ সংগ্রহ করা হয় এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আখ বিক্রির সঙ্গে সঙ্গে দাম দেওয়া হয়। সংস্থাটির কৃষকের কাছ থেকে আখ সংগ্রহের একটি নীতিমালা রয়েছে। চিনিকলের কৃষি বিভাগের যিনি মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তার পদবি হলো আখ উন্নয়ন সহকারী। সংক্ষেপে বলা হয় সিডিএ। আর কেন্দ্র ও মিল গেটে যিনি আখ কেনেন তার পদবি হলো সিআইসি বা সেন্টার ইনচার্জ। একজন সিডিএ তার ইউনিটের ১৫০ একর জমির আখ রোপণ ও আখ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থাকেন। প্রতিটি মিলে এপ্রিল-মে মাসে আখ রোপণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আখ উন্নয়ন সহকারী তার ইউনিটের সব কৃষকের রোপণ করা আখের জমি ফিতা দিয়ে মেপে প্লটভিত্তিক ইক্ষু জমি জরিপ করে রেজিস্টারভুক্ত করেন। তারপর আবার আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে আখ বড় হলে সিডিএ চাষিভিত্তিক ফলন জরিপ করেন। ফলন জরিপে চাষির মোট আখ উৎপাদন, গুড় ও বীজে ব্যবহারের পর মিলে সরবরাহযোগ্য সম্ভাব্য আখের পরিমাণ উল্লেখ থাকে। এসব তথ্য চাষিকার্ডে ও কেইন লেজারেও লিপিবদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মিলে আখ সরবরাহের জন্য প্রতি ইউনিটের আখচাষিদের নিয়ে ৭ থেকে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। একে বলা হয় পুর্জি কমিটি। পুর্জি হলো চিনিকলে আখ সরবরাহের অনুমতিপত্র। এই অনুমতিপত্রের মেয়াদ থাকে তিন দিন। একটি পুর্জি দিয়ে ১.৫ থেকে ২.০ মেট্রিক টন আখ মিলে সরবরাহ করা যায়। মিল চালুর ৭ দিন আগে সিডিএ পুর্জি কমিটির সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে একটি পুর্জি গ্যাজেট প্রণয়ন করে মিলের কৃষি বিভাগের আখ সংগ্রহ শাখায় জমা দেন। মিল বা কেন্দ্রে আখ সরবরাহে তিন দিন আগে মোবাইল ফোনের ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে আখচাষিকে ই-পুর্জি (আখ সরবরাহের অনুমতিপত্র) দেওয়া হয়। এতে শ্রমিক ও পরিবহনের গাড়ি জোগাড় করে কৃষক আখ কেটে ও পরিষ্কার করে সময়মতো মিলে সরবরাহ করতে পারেন। ই-পুর্জি ব্যবস্থাপনা মিলে আখ সরবরাহের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। কমে যায় কৃষক হয়রানি। মিলে বা কেন্দ্রে আখ সরবরাহ কালে কৃষকে বাধ্যতামূলকভাবে চাষিকার্ড দেখাতে হয়। চাষিকার্ডে আখচাষির রোপণ করা আখের জমি, মিলে সরবরাহযোগ্য আখ এবং ঋণের পরিমাণ উল্লেখ থাকে। যদি কৃষক ঋণী হন, তাহলে মিলে আখ সরবরাহের সময় সরবরাহ করা আখের মূল্যের শতকরা ৭৫ ভাগ ঋণ কেটে বাকি টাকা রূপালী ব্যাংকের শিওর ক্যাশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চাষিকে দেওয়া হয়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আখের মূল্য পরিশোধের কারণে আখচাষিকে আখের মূল্য পেতে মিলে আর ঘোরাঘুরি করতে হয় না। আখ বিক্রির ক্ষেত্রে এই সময়োপযোগী ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা সারা দেশের মানুষের কাছে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। পেয়েছে ভারতের মন্থন অ্যাডওয়ার্ড-২০১০।

কৃষকের কাছ থেকে ধান ও গম সংগ্রহের ক্ষেত্রে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং খাদ্য বিভাগ মিলে একটি যুগোপযোগী কৃষকবান্ধব শস্য সংগ্রহ নীতিমালা প্রণয়ন ও কৃষিকার্ড প্রবর্তনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। কৃষিকার্ডে কৃষকের মৌসুম ভত্তিক ধান ও গম উৎপাদনের জমি, মোট উৎপাদিত শস্য এবং সরকারি গুদামে সরবরাহযোগ্য ধান ও গমের পরিমাণ এবং মোবাইর ব্যাংকের হিসাব নম্বর উল্লেখ থাকবে। এই কার্ডের মাধ্যমেই কৃষক সরাসরি সরকারি গুদামে ধান ও গম সরবরাহ করতে পারবেন এবং মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসে সরবরাহ করা শস্যের মূল্য পাবেন। এতে সরকারি গুদামে শস্য সংগ্রহে দুর্নীতি বহুলাংশে কমবে। কৃষক হয়রানি দূর হবে। দূর হবে দলবাজি ও রাজনৈতিক প্রভাব। নিশ্চিত হবে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি। ব্রিটিশ টোব্যাকো কোম্পানিও কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি তাদের উৎপাদিত তামাক সংগ্রহ করে। ওই কোম্পানিরও একটি তামাক সংগ্রহ নীতিমালা আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন সংযোগ চাষিদের কাছ থেকে শস্যবীজ সংগ্রহ করে। সেখানেও একটি নীতিমালা রয়েছে। এসব নীতিমালার আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও খাদ্য বিভাগের উদ্যোগে সরকারি গুদামে সরাসরি কৃষকের কাছে থেকে ধান ও গম সংগ্রহের একটি সময়োপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। এ দাবিকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই।

লেখক : সাবেক মহাব্যস্থাপক (কৃষি), নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস লিঃ, গোপালপুর, নাটোর

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads