• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮
বড় পরিবর্তন আসছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়

ছবি : সংগ‍ৃহীত

সম্পাদকীয়

বড় পরিবর্তন আসছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায়

  • অলোক আচার্য
  • প্রকাশিত ০২ জুন ২০১৯

প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষাস্তরের প্রাথমিক ধাপ। সব ধরনের যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার পরও আজ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি লাভ করতে পারেনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য করার উদ্যোগ নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো সবার সাধুবাদ পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থীকে বছরের শুরুতেই তার স্কুল ড্রেস বা পোশাক, খাতা-কলম বিনামূল্যে দেওয়া, তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা বাতিল এবং তার বদলে কয়েকটি মানদণ্ডে মূল্যায়ন এবং স্কুল ফিডিংয়ের কার্যক্রম হাতে নেওয়া। দেশের লাখ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জন্য এগুলো নিশ্চিত করা যে একটি চ্যালেঞ্জ, সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু এর সবগুলোই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে এবং এর গুণগত মানকে আরো বেশি কার্যকর করে তুলবে। এত দিন বছরের শুরুতে নতুন বই নিয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরত শিক্ষার্থীরা। এখন তার সঙ্গে যদি স্কুলের পোশাকও হাতে পায় তাহলে আনন্দের মাত্রা যে আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় একটি বড় পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটির বেশি। এর মধ্যে দারিদ্র্যপ্রবণ ১০৪টি উপজেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুপুরে রান্না করা খাবার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় ৩২ লাখ শিক্ষার্থীকে এর আওতায় আনা হবে। এতে অবশ্যই একটি বড় ধরনের দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে। যার মধ্যে অন্যতম হবে প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আসা। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের অনেকেরই স্কুলে আসার পর তার স্কুল নির্ধারিত পোশাকের জন্য দুশ্চিন্তা থাকে। অভিভাবকের কাছেও বিষয়টি কষ্টসাধ্য হয়। এছাড়া দুবেলা খাবারের নিশ্চয়তায় অনেক শিশুই বইয়ের বদলে হাতে কোনো কাজ তুলে নেয়। ফলে ঝরে পড়া থেকে তাদের বিরত করা যায় না।

পরিবর্তন তখনই কার্যকরী সুফল বয়ে আনবে যখন এর সঙ্গে লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করা যাবে। দেশে অলিগলিতে, বিল্ডিংয়ের কোনায় ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এসব হাজারো কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোনো নজরদারি নেই। যেখানে যেমন ইচ্ছা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি বহু আইন এসব কিন্ডারগার্টেনে উপেক্ষিত। উপেক্ষিত হওয়ার কারণ তাদের দিকে নজরদারি করার কেউ নেই। এত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। কারণ ফলাফলে কিন্ডারগার্টেনগুলোই এগিয়ে থাকে। ফলে অভিভাবকদের আগ্রহটাও থাকে এসব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে।

সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিয়েছে। শিক্ষকদের আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠদান করার জন্য পর্যায়ক্রমে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনছে। ফলে ক্লাস আর আগের মতো একঘেয়েমি হয়ে ওঠার সুযোগ নেই। শিক্ষকের দক্ষতার কথা বললে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছেন তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। মেয়েদের প্রাথমিকে শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক করা হয়েছে। ফলে সবাই শিক্ষিত ও প্রাথমিক শিক্ষার জন্য যথেষ্ট দক্ষ, তা ধরে নেওয়া যায়। যেটুকু ঘাটতি থাকে তা হলো পাঠদানের কৌশল ও উপকরণ ব্যবহার। এটি নিশ্চিত করা হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। প্রাথমিক শিক্ষায় বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও প্রতিটি শিক্ষার্থীকে বৃত্তিও দেওয়া হয়। মোবাইলের মাধ্যমে শিশুর অভিভাবকের কাছে এ বৃত্তির অর্থ পৌঁছে যাচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে সহায়তা করছে। প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরো সুযোগ-সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয় যারা চাকরি করেন তাদের সন্তানরা সবাই কি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে? এমনটা দেখা যায় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সন্তানরা প্রায়ই এলাকার নামিদামি কোনো কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে। সবাই না, তবে এ হারটাই বেশি হবে। তাহলে নিজের সন্তানকে যদি নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে দিতে আস্থা না থাকে তাহলে অন্য অভিভাবকদের দোষ দিয়ে লাভ কী? এটা একটা কারণ মাত্র কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হবে। সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে এটা করতে হবে।

অন্যদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি অনেকটা দীর্ঘ বলে মনে হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি। অন্যদিকে দেশের কিন্ডারগার্টেনের সময়সূচি সকালে। প্রাথমিক শিক্ষার সময়সূচি কমানোর ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। এত দীর্ঘ সময় এই কচিকাঁচাদের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। সে ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সময় যদি আরেকটু কমিয়ে আনে তাহলে ক্রমাগত ক্লাসের ভীতি কেটে যাবে। আবার মিড ডে মিল বিস্কুট দেওয়া থেকে অনেক বেশি কার্যকর হবে, এ কথা নিশ্চিত। তবে এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালু করা বড় একটি বিষয়। সেই দিনটা সত্যি অনেক আনন্দের হবে যেদিন দেশের প্রতিটি বিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী মিড ডে মিলের সুযোগ পাবে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দক্ষ আরো একটি কারণে যে তাদের নিয়মিতভাবে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য শিক্ষকদের শিশুদের শিক্ষাদানের পদ্ধতির উন্নয়ন করা। তাহলে এত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক যে স্কুলগুলোতে শিক্ষা দেন সেসব স্কুলের ওপর এখনো মানুষের শতভাগ আস্থা হবে না কেন? কিন্তু এসব প্রশিক্ষণের কতটা তিনি শ্রেণিতে প্রয়োগ করেন, সেটার ওপর নির্ভর করে প্রশিক্ষণের সাফল্য।

বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের পদক্ষেপে বেসরকারি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা হয়েছে। আর পে-স্কেল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের বেতনও বেড়েছে। এখন সহকারী শিক্ষকদের দাবি প্রধান শিক্ষকের বেতন গ্রেডের সঙ্গে তাদের বেতন গ্রেড সমন্বয় করা। ইতোমধ্যে কর্তৃপক্ষ আশ্বাসও দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সহকারী শিক্ষকরা এই গ্রেডে বেতনের দাবি রাখেন। ফলে শিগগিরই তাদের দাবি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। সে সঙ্গে শিক্ষকদের আন্তরিকতাও আরো একটু বাড়াতে হবে। মূলত সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আন্তরিকতার ঘাটতি আজো রয়েই গেছে। আগে যে শিক্ষকদের শিক্ষকতার পাশাপাশি অন্য কাজ করতে হয়েছে সংসার চালানোর চিন্তায়, এখন তো আর তা করতে হচ্ছে না। তাই এখন শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার মান বৃদ্ধির বিষয়ে মনোযোগী হওয়া দরকার।

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads