• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
তামাক চাষ ও ব্যবহার এবং কিছু কথা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

তামাক চাষ ও ব্যবহার এবং কিছু কথা

  • সাধন সরকার
  • প্রকাশিত ০৩ জুন ২০১৯

চিকিৎসকদের মতে, ধূমপান তথা তামাক সেবন করার কারণে হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। তামাক সেবনের কারণে অগ্ন্যাশয়, কিডনি, স্বরনালি ও খাদ্যনালি ব্যাপকভবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া তামাক সেবনে দেহে স্ট্রোক, যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হূদরোগসহ নানা রোগ বাসা বাঁধে। তামাক পরিশোধন করে ও অন্যান্য উপাদান মিলিয়ে তৈরি হয় সিগারেট। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, বড়লোকসহ শিক্ষিত শ্রেণি ধুমছে টানে ক্ষতিকর এই সিগারেট। অনেকে আবার সিগারেট খাওয়াকে স্টাইল বলে মনে করে! এক তথ্যমতে, ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক, যেমন  জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি সেবনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

প্রতি বছর ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ পালন করা হয়। বাংলাদেশেও প্রতি বছর নানা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন হয়ে থাকে। প্রশ্ন হলো, তাহলে তামাকের চাষাবাদ ও ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না কেন? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক তথ্যমতে, দেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তামাক ব্যবহার করে। সার্বিক বিবেচনায় তামাকের উৎপাদন থেকে শুরু করে ব্যবহার পর্যন্ত হিসাব করলে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব বলে শেষ করা যাবে না। তবুও জেনে-শুনে ধনী-গরিব সবাই তামাক সেবন করেই যাচ্ছে। কেউ ছাড়ে, কেউ আবার ধরে। তামাকজাত পণ্যের মোড়কে চিত্রসহ সতর্কবাণী দেওয়া বাধ্যতামূলক থাকলেও অনেক কোম্পানি তা মানছেন না। তবে যাই বলা হোক না কেন, আইন করে তামাকজাত পণ্যের গায়ে সচিত্র সতর্কবাণী দিলেই তামাক সেবন বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। সর্বশেষ ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তাতে কার কি যায় আসে! তামাকের উৎপাদন ও ব্যবহার চলছেই। সত্যি বলতে, আইন ও বিধিমালার কোনো প্রয়োগ নেই। তামাকের তৈরি ক্ষতিকর পণ্যের বিজ্ঞাপন রাস্তার চারপাশে দেখা যায়। দুঃখের বিষয় হলো, তামাক শিল্পে অনেক শিশুশ্রমিকও কাজ করে। শিশুদের তামাকের সাথে জড়িয়ে তাদের জীবনের সাথে রীতিমতো ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। বিধিমালা বা আইন অনুযায়ী, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তামাকজাত পণ্য বা তামাকের ব্যবহার প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে কোনো বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। কিন্তু তামাক ব্যবসার সাথে জড়িত কোম্পানিগুলো কৌশলী হয়ে কাজ করছে।

তামাক চাষ পরিবেশ দূষণ, মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকিসহ সর্বোপরি দেশের উন্নয়নের পথে বাধাস্বরূপ! দেশের পার্বত্য ও উত্তরাঞ্চলের জেলাসহ আরো বেশ কয়েকটি জেলায় দেদার তামাক চাষ করা হচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্য ও তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সবার কমবেশি জানা থাকলেও চাষাবাদকারী কৃষকসহ অধিকাংশ লোকই তা মানে না, নতুবা মানতে চাই না। মূলত দেশের সমতল জমিতে, পাহাড়ের সমতল ভূমি ও নদী তীরবর্তী ফসলি জমিতে তামাকের চাষ করা হচ্ছে। তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। পরবর্তীতে ঐ ফসলি জমিতে অন্য ফসলের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়। এভাবে ধীরে ধীরে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হয়। তামাক চাষে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়াসহ তামাকচাষিদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়। একইভাবে তামাক পাতার ঝাঁজ শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

কৃষকদের অতি মুনাফা আর নানা প্রলোভন দেখাচ্ছে কোম্পানিগুলো। ফলে কৃষকরা শীতকালীন ও মৌসুমি ফসলের চাষ ছেড়ে তামাক চাষে ঝুঁকছেন। এতে সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে ফসলি জমি, সামগ্রিক পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের। এ ছাড়া আরো একটি কারণ থাকতে পারে। আর তা হলো, কৃষকরা ধান চাষ করেও বিক্রির সময় ধানের দাম না পাওয়ার কারণে বেশিরভাগ কৃষক লোকসানে পড়ছেন। কৃষকরা ধান চাষ করে ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না! ফলে বহু কৃষক তামাক চাষে ঝুঁকছেন বলে মনে হচ্ছে। তামাক চাষে প্রচুর রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহার করা হয়। এতে মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জমিতে প্রয়োগকৃত এই সার ও বিষ কোনো না কোনোভাবে খাল-বিল ও নদীতে যাচ্ছে। ফলে মাছের শরীরে প্রবেশ করে তা জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি তৈরি করছে। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের ঋণ, বীজ, সার, কীটনাশকসহ যাবতীয় সব সুবিধা দিচ্ছে। ফলে তামাকের আবাদ লাভজনক হচ্ছে এবং উৎপাদিত তামাক ঐ কোম্পানিগুলো কিনে নেওয়ায় বিপণন প্রক্রিয়াও এক প্রকার ঝামেলাহীন।

একদিকে দেশে তামাকের উৎপাদন হচ্ছে অপরদিকে বিদেশ থেকে তামাক পণ্য আমদানিও করা হচ্ছে। এককথায় বলা যায়, তামাক উৎপাদন ও আমদানিতে রাষ্ট্রের সম্মতি আছে। এভাবে কি তামাকমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব? সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের ধূমপানসহ ক্ষতিকর তামাকজাত পণ্য থেকে দূরে থাকা উচিত। টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নয়নের পথে তামাক অন্যতম বাধা। সুখী, সুন্দর, দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যবান জীবনযাপনের জন্য তামাকজাত পণ্য ত্যাগ করতে হবে। তামাকমুক্ত দেশ গড়তে হলে বিদেশ থেকে তামাকজাত পণ্য আমদানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করতে হবে। দেশের মধ্যে কৃষিজমির ক্ষতি করে তামাক উৎপাদন স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কৃষকদের লোভের ফাঁদে ফেলে যাতে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ফায়দা লুটতে না পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে এবং কৃষকদের তামাক উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে হবে। এ ছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের ওপর উচ্চ হারে করারোপ করতে হবে। সরকারের সদিচ্ছা ও জনসচেতনতাই পারে ক্ষতিকর বস্তু তামাক থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখতে।

 

লেখক : পরিবেশকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads