• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

স্যানিটারি ন্যাপকিন এবং নারীর স্বাস্থ্য

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ০৭ জুলাই ২০১৯

বাজেট ঘোষণা হয়ে পাসও হয়ে গেল। আর পাস হওয়ার আগে থেকেই বাজারে পড়েছে এর প্রতিক্রিয়া। নিত্যব্যবহার্য অনেক জিনিস চলে গেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত আর দরিদ্রের ধরাছোঁয়ার বাইরে। গ্যাসের দাম বেড়েছে, দাম বেড়েছে চিনি, গুঁড়াদুধ, স্যানিটারি ন্যাপকিনের। সঞ্চয়পত্রের উৎসে কর কর্তন দ্বিগুণ করা হয়েছে। ব্যক্তিপর্যায়ে দ্বিমুখী চুলার মাসিক রেট বাড়িয়ে ৮০০ থেকে ৯৭৫ টাকা আর একমুখী চুলার রেট বাড়িয়ে ৭৫০ থেকে ৯২৫ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সিএনজির দামও বাড়ানো হয়েছে। চিনি, গুঁড়াদুধের দাম বেড়েছে এটার উল্লেখ বাজেটে আছে; কিন্তু বাজেটে নেই এমন অনেক জিনিসের দামও রাতারাতি বেড়ে গেছে। দুদিন আগেও আমরা ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় এক ডজন ডিম কিনতে পেরেছি, এখন তা ১১৬ থেকে ১২০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এমন অনেক অপ্রকাশ্য জিনিসের ওপর পড়েছে বাজেটের প্রভাব। এটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ গ্যাসের দাম বেড়েছে।

দেশে এখন সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পাওয়ার যায়। অনেক মধ্যবিত্ত তাই ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি কিনে ফেলেছে। অফিস বা ব্যবসা আছে, ছেলেমেয়ের স্কুল-কলেজে যাতায়াত একটি গাড়ি থাকলে সহজ হয়ে যায়। নিরাপত্তা ঝুঁকি কিছুটা কমে, অর্থেরও কিছুটা সাশ্রয় হয়। কিন্তু গত কয়েক বছরে একাধিকবার  সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে। একে তো প্রচণ্ড গরম, এসি ছাড়া গাড়ি চালানো যায় না, তাতে অসহনীয় যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকতে হয়। গরমের কারণে গাড়ি বন্ধও করা যায় না। ফলে গ্যাসের খরচও দ্বিগুণ পড়ে। তাতে যদি দাম বাড়ানো হয়, মধ্যবিত্ত বাঁচবে কী করে!  অন্যদিকে দাম বাড়ানোর সরাসরি প্রতিক্রিয়া পড়বে গরিব মানুষের ওপর। যাদের গাড়ি নেই, বাস-টেম্পোতে চলাচল করে, তাদের গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া। দাম বেড়েছে নিত্যব্যবহার্য চিনি আর গুঁড়াদুধের। চিনি, গুঁড়াদুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, শিশুখাদ্যও বটে। যে দেশে শিশুখাদ্যের দাম বাড়ে বা শিশুখাদ্যের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়, সে দেশ সবল শিশু পাবে কী করে! আর আমরা সবাই জানি, খাদ্যই পুষ্টি, খাদ্যই মেধা। শিশু যদি ঠিকমতো পুষ্টিকর খাবার না পায়, কোথা থেকে আসবে তার মেধা।

দাম বেড়েছে স্যানিটারি ন্যাপকিনের। স্যানিটারি ন্যাপকিন নারীস্বাস্থ্যের জন্য একটি অতি আবশ্যকীয় পণ্য। গ্র্রামগঞ্জের অসংখ্য নারী আজো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। কেউ করেন না অজ্ঞতার কারণে, কেউ অর্থাভাবে। বাজারে এক প্যাকেট ন্যাপকিনের বর্তমান দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। তাতে থাকে মাত্র ১৫ পিস ন্যাপকিন। পরিবারে যদি তিন-চারজন নারী থাকেন, তাহলে খরচ ৫০০-তে গিয়ে ঠেকে। দরিদ্র পরিবারের জন্য এটা অনেক টাকা। এই টাকায় ভাত ডাল তেলের মতো কোনো একটা নিত্যব্যবহার্য জিনিসের খরচ চলে যায়। তাই অনেক পরিবার ন্যাপকিন ব্যবহারের উপকারিতার কথা জানলেও অর্থের কারণে ব্যবহার করতে পারে না। তাছাড়া ন্যাপকিন ব্যবহারের জন্য যেভাবে সচেতনতা বাড়ানোর ক্যাম্পেইন করা প্রয়োজন ছিল সেটাও করা হয়নি। ফলে বহু নারী এখনো ন্যাকড়া ব্যবহার করেন। কেউ কেউ এক ন্যাকড়া বার বার ধুয়ে ব্যবহার করেন। কারণ গরিব মানুষের বাড়িতে পর্যাপ্ত ন্যাকড়াও থাকে না। অনেকেরই ন্যাকড়া ঠিকমতো পরিষ্কার করার মতো সাবানও থাকে না। ফলে নোংরা ন্যাকড়াই তারা ব্যবহার করেন। আর এই অপরিচ্ছন্ন অনিরাপদ ন্যাকড়া ব্যবহারে নারীরা চলে যায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাদের ইউরিন ইনফেকশন হয়, ভ্যাজাইনায় ঘা হয়, নানারকম গাইনি সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হন তারা। ফলে নিরাপদ যৌনজীবন এবং সুস্থ সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয়। এই যখন অবস্থা তখন ন্যাপকিনের দাম বাড়ানো হলো কোন বিবেচনায়? পাসের দেশ ভারতে মমতা ব্যানার্জি ‘সাথী’ প্রজেক্টের মাধ্যমে ছয় টাকায় ছয়খানা ন্যাপকিন মেয়েদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তাছাড়া ভারতে ২৫-৩০ টাকায় এক প্যাকেট ন্যাপকিন পাওয়া যায়। সেখানে আমার দেশ কেন ন্যাপকিনের দাম না কমিয়ে বাড়ায়?  কোনো কোনো নারীর তো ঋতুস্রাবকালে দু-তিন প্যাকেট ন্যাপকিনও লাগে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতি ছয় ঘণ্টা পর ন্যাপকিন বদলানো উচিত। তাহলে যেখানে ন্যাপকিনের দাম কমিয়ে গ্রামগঞ্জের অব্যবহারকারীদের হাতে ন্যাপকিন তুলে দেওয়া দরকার, সেখানে সরকার দাম বাড়ালো কোন বিবেচনায়? আর এ বিষয়ে আমাদের নারী সংগঠনগুলো কেন উচ্চকিত নয়? এটাও কি এক ধরনের ট্যাবু? এমনিতেই ঋতুস্রাবের বিষয়টিকে অনেক মেয়ে আজো স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। লজ্জা পায়। এক জরিপে দেখা গেছে, এখনো পিরিয়ডের সময় গড়ে মেয়েরা তিনদিন স্কুল কামাই করে। কামাই করে পেটের ব্যথায়, অস্বস্তিতে, কাপড়ে দাগ লেগে যাওয়ার ভয়ে, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যাপকিন পাল্টানোর পর্যাপ্ত সুবিধা না থাকায়, ন্যাপকিন ফেলার ব্যবস্থা না থাকায়।  নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি না করে এরই মধ্যে ন্যাপকিনের দাম বাড়ানো আদৌ সমীচীন নয়।

এই তো সেদিনের কথা, এদেশের মেয়েরা লজ্জায় পিরিয়ডের কথা বলতে পারত না। অনেক মেয়েরই পিরিয়ড হওয়ার আগে পিরিয়ড সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান ছিল না। গার্হস্থ্য বিজ্ঞান নামে একটা সাবজেক্টের শেষাংশে ঋতুস্রাবের বিষয়ে একটা চ্যাপ্টার ছিল। বিষয়টি স্কুলে এমনভাবে পড়ানো হতো যে মনে হতো এটা একটা নিষিদ্ধ বিষয়। আমাদের একজন দিদিমণি বিষয়টি পড়াতেন। তিনি পড়াতে লজ্জা পেতেন। ছাত্রীরাও লজ্জা পেত। তারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করত আর মুখ টিপে হাসত। মনে আছে এই ক্লাস এলেই দিদিমণি যেন পালিয়ে বাঁচতেন। বলতেন, এই চ্যাপ্টারটা বাড়িতে পড়ে নিও। ওই বইটা আমরা লুকিয়ে রাখতাম। যেন ভাইরা বা পুরুষ কেউ না দেখে। এমনকি মা-বোন দেখুক এটাও আমরা চাইতাম না। বিষয়টা আমাদের কাছে ছিল এতটাই লজ্জার। বিষয়টা এমন ছিল যে, ঋতুস্রাব যে হয় এটাই যেন আমাদের অপরাধ।

সে সময় দেশ স্যানিটারি ন্যাপকিন আসেনি। ন্যাপকিন এলো এই তো সেদিন। কাজেই অবধারিতভাবে সবাই ন্যাকড়া ধুয়ে ধুয়ে ব্যবহার করত। সে ন্যাকড়া প্রকাশ্যে মেলে দেওয়া ছিল রীতিমতো লজ্জার ব্যাপার। কেউ কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে, কেউ আলনার পেছনে মেলে দিয়ে সেই ন্যাকড়া শুকাতেন। তারপর রেখে দেওয়া হতো গোপন কোনো স্থানে পরের মাসের জন্য।

সেই জায়গাটি থেকে আমরা খুব বেশি বেরিয়ে এসেছি বা খুব অগ্রসর হয়েছি বলে মনে করি না। এখনো কিন্তু নারীরা প্রকাশ্যে পিরিয়ডের আলোচনা করতে সমানভাবে লজ্জা পায়। অনেক মেয়েই নিজে দোকানে গিয়ে ন্যাপকিন কেনে না। বাবা-ভাইকে দিয়ে কেনায়। আর সেটা বলে দেয় মা বা ভাবি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, সেই ট্যাবুটা আজো রয়ে গেছে।

রয়ে গেছে কথাটা এজন্য বলছি যে, সিগারেটের দাম বৃদ্ধি, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। দু-একটা মানববন্ধন হয়েছে, আগামীতেও দু-একটার ঘোষণা আছে। টক শোতেও কিছু কথাবার্তা শুনছি। কিন্তু সেই অনুপাতে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো নারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে কোনো হৈচৈ বা উচ্চকিত আওয়াজ শুনছি না। নারী সংগঠনগুলোর কোনো বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা এখনো জানতে পারিনি। ফেসবুকে বিচ্ছিন্নভাবে দু-চারজন লিখছেন। এতটুকুই। কিন্তু কেন? বিষয়টি কি এমন যে পণ্যটি নারীরা ব্যবহার করেন, তাই এটার দাম বাড়াতে কারো কিছু যায় আসে না? পণ্যটি যদি পুরুষ ব্যবহার করতেন বা নারী-পুরুষ উভয়েই ব্যবহার করতেন, তাহলে এটা নিয়ে বেশ জোরেশোরে আওয়াজ উঠত? আমার কাছে ব্যাপারটা তেমনই মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হচ্ছে, নারী সংগঠনগুলোর শীর্ষপদে যারা আছেন, এখন আর এই পণ্যটি তাদের অনেকেরই লাগে না বয়সজনিত কারণে। তাই তারা জোরে আওয়াজ তুলছেন না? তাদের লাগে না বুঝলাম, কিন্তু তাদের পরিবারের মেয়েদেরও কি লাগে না? নাকি এই দু-দশ টাকা দাম বৃদ্ধিতে তাদের কিছু যায় আসে না? আর পুরুষ ভাইদের কথা না-ইবা বললাম।  হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া তারা কে কবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নারীদের বিষয়াদি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন!

আশা করব, সরকার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন আর নারীর ব্যবহার্য এই পণ্যটির দাম যদি কমাতে নাও পারেন, দাম যাতে না বাড়ে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। নারীদের বলব, তোমরা ট্যাবু ভেঙে বেরিয়ে এসো। আওয়াজ তোলো জোরে।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাবেক যুগ্ম-সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads