• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
নেতা ও জনতা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

নেতা ও জনতা

  • প্রকাশিত ০৪ আগস্ট ২০১৯

প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির চরিত্রে ফুটে ওঠে সংশ্লিষ্ট এলাকার সংখ্যাধিক্য জনচরিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। কথাটি এমনিতেই বলিনি। চিন্তা-ভাবনা করে ভেবে-চিন্তে বলেছি। বর্ষা যত ঘনীভূত হচ্ছে, দেশের বন্যা পরিস্থিতি তত অবনতির দিকে যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিভৃত পল্লিতে নগরায়ণের ছোঁয়া লাগছে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গাঁওগঞ্জের মতো শহরেও প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা ছড়িয়ে পড়ছে। বন্যাকবলিত এলাকায় জনগণের বন্ধু দাবিদার বেশিরভাগ নেতাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো কোনো নির্বাচন সন্নিকটে না থাকায় নেতা ও জনতার সম্পর্কে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য কিছু কিছু নেতা আর্তমানবতার সেবায় সর্বস্ব দিয়ে প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যেতেও দেখা যায়।

 

পঙ্কিল মানসিকতার লোকজন রাজনীতিতে বেশি ঝুঁকে পড়ায় সৎ ও মেধাবীরা এখানে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। মেধাবীরা এখন চাকর হওয়ার দৌড় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। ছাত্রজীবনে যারা মেধার স্বাক্ষর রাখে, তারা কর্মজীবনে রাজনীতিকে এড়িয়ে চলে। প্রজাতন্ত্রের বিভিন্ন পদে বা বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরির জন্য চাতক পাখির মতো অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বসে থাকে। তারা আন্ডার ম্যাট্রিক নেতা আর অক্ষরজ্ঞানহীন মালিকের অধীনে গোটা জীবন কলমপেষা মজুর হিসেবে পার করে দেয়। আর এ কারণেই জাতীয় জীবনে নেমে আসে দুর্যোগের খড়গ। তবে এখনো কোনো কোনো মেধাবী ও দেশপ্রেমিক মানুষ রাজনীতির অঙ্গনে আছে বলেই বাংলাদেশ টিকে আছে। যাদের ইস্পাতকঠিন নেতৃত্ব অন্যায়-অনাচারের বিপ্রতীপ পাহাড়প্রকীর্ণ বিদীর্ণ করে জাতীয় জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি নিয়ে আসে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পচা মস্তিষ্কের প্রভাবের মূল কারণ কিন্তু জনগণের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। প্রথমেই বলেছি, প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির চরিত্রে ফুটে ওঠে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনগণের বৃহৎ অংশের চরিত্রের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। যারা যেমন তেমন প্রতিনিধিই তারা পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার অনেকেই বিচার-বিবেচনা না করে সিদ্ধান্ত নেয়। এটিও আমাদের জনগণের সচেতনতার দীনতাই বটে।

 

অপ্রতুল বোধসম্পন্ন মননের জনতা তখনই নেতার গুরুত্ব বোঝে, যখন নিজেদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। দেশব্যাপী প্রবল বর্ষণের কারণে সারা দেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। লাখ লাখ পরিবারে চুলায় আগুন জ্বলে না। গ্রাম ছাড়িয়ে জলস্রোত এখন শহরেও হানা দিয়েছে। অভুক্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধদের কান্নায় বাংলার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। অথচ নির্বাচনের আগে বাপের জমি বিক্রি করে জনসেবা করা নেতাদের কোথাও কোনো খোঁজ নেই। বাংলার জনতার মনে এখন একটাই সিদ্ধান্ত, নির্বাচনের সময় বুঝিয়ে দেব! দেখা যাবে এই সিদ্ধান্ত কয়দিন পরেই পাল্টে যাবে। বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলে আসছে আমাদের আত্মভোলা চেতনার চর্চা।

জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক থাকে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বার, পৌর করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলর জনগণের কাছাকাছি পাশাপাশি থাকেন। জনগণের বাস্তব দুর্দশায় এরাই জনগণের পরম বন্ধু বা চরম শত্রু। অতীত এবং সাম্প্রতিক বন্যায় স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরাই জনগণের সঙ্গে থেকে জনগণের জন্য কাজ করে গেছেন। জনতার বিপদ দেখে পলায়নপর নেতাদের চিত্র যেমন নিকট অতীতে ভেসে ওঠে, তদ্রূপ নিজের সর্বস্ব নিয়ে জনগণের বিপদে ছুটে যাওয়ারও অসংখ্য নজির আমাদের দেশে আছে। জাতির সূর্যসন্তান এসব জনপ্রতিনিধি বুক সমান পানিতে নেমে, কখনো সাঁতার কেটে জনতার দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিয়েছেন বা দিচ্ছেন তাদের ন্যায্য অধিকার। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জনপ্রতিনিধি চকরিয়ার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কায়ছারের নাম।

 

ঢাকায় বসে যখন এলাকার বন্যা পরিস্থিতির খোঁজখবর নিচ্ছি তখন লক্ষ্যারচর ছাড়া চকরিয়ার অন্যান্য এলাকার জনপ্রতিনিধিদের কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। একমাত্র লক্ষ্যারচরেই সবার আগে জনতার প্রয়োজনে তাদের নেতা ছুটে গেছেন জনতার ঘরে ঘরে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বৃহত্তর চট্টগ্রামে দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয় না। এখানকার বন্যা মানেই বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা বা পাহাড়ি ঢল। উজানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে তীব্র জলধারা ছুটে আসে ভাটির দিকে। সংকীর্ণ নদী একসঙ্গে এত পানি ধারণ করতে পারে না বিধায়, নদীর দু’কূল উপচে পানি ছড়িয়ে যায় আশপাশের অঞ্চলে। এসব এলাকায় কোথাও গলা সমান পানি, কোথাও অথৈ পানিতে সপ্তাহ খানেক নিমজ্জিত থাকে। পানিতে মিশ্রিত থাকে প্রচুর পলিমাটি। কবলিত এলাকায় তীব্র জলস্রোতও বেশ লক্ষণীয়। পাঁচ-সাতদিন পরই কবলিত এলাকার পানি জোয়ারের পর ভাটার মতো কমে যায়। বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করত সরকারি সহায়তা আসতে আসতে জনগণের ত্রাহি অবস্থারও অবসান হতে থাকে। সঙ্গত কারণেই এসব এলাকায় জরুরি বরাদ্দ বেশি থাকা উচিত। এটিও একটি কারণ যে, অপ্রতুল জরুরি বরাদ্দের কারণে জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে যেতে সাহস পান না। আবার এটাও তো ঠিক, জনপ্রতিনিধিকে বরাদ্দের আমায় বসে থাকলে চলবে না। জনগণের দুঃখ-দুর্দশায় তাকেই ছুটে যেতে হবে সবার আগে। তাই জিএম কায়ছারের মতো সাহসী জনপ্রতিনিধি এখন আমাদের প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক বন্যায় পুরো লক্ষ্যারচর ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নগুলো একই ওয়াটার লেভেলে ভাসছিল। মনে হচ্ছিল কোনো সাগর বা মহাসাগরের বুকে ভাসমান একটি জনপদ, যেখানে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রায় ৯০ শতাংশ বাড়িতে রান্নাবান্না বন্ধ। বাজার-ঘাটও প্লাবিত হওয়ায় হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা কায়ছার একান্ত তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন পরিবারের সবার জন্য পর্যাপ্ত খিচুড়ি। জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার আগেও বন্যাকালীন তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছিল। দেশের সব জনপ্রতিনিধি তার মতো নেতা-জনতা বন্ধুত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারলে সন্দেহাতীতভাবে আমাদের এই দেশ সোনার বাংলাদেশে পরিণত হতো।

আমাদের দেশে রাজনীতির মাঠে নিজ দলেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। নেতৃত্বের আসনে বসার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কিন্তু জনসেবার ক্ষেত্রে নেতাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোটেও দেখা যায় না। নেতা হওয়ার জন্য, ভোটের বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যে প্রতিযোগিতার মিছিল শুরু হয়, সেটি যদি জনতার কাছে আসার প্রতিযোগিতা হতো, তবে নেতা আর জনতা পরম বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতো।

 

মুহাম্মদ ইয়াকুব

লেখক : নিবন্ধকার

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads