• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮
ডেঙ্গু থেকে আমরা মুক্তি চাই

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু থেকে আমরা মুক্তি চাই

  • মো. মাঈন উদ্দিন
  • প্রকাশিত ০৫ আগস্ট ২০১৯

দেশে এখন অনেক সমস্যা। হত্যা, ধর্ষণ, দেশবিরোধী অপপ্রচার ছাড়াও রয়েছে ছেলেধরা গুজব। এ সমস্যাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মরণব্যাধি ডেঙ্গুজ্বর। প্রতিনিয়ত মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। ডেঙ্গুজ্বরের পরিমাণ বাড়ছে গুণিতক হারে। ইদানীং ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। ধারণ করেছে ভয়াবহ আকার। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীতে ভরে গেছে হাসপাতালগুলো। প্রতিদিনই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, যা আগের রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে। চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। জ্বর হলেই ডেঙ্গু আতঙ্ক নিয়ে হাসপাতালে ছুটছেন রোগীরা। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না অনেকের।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রতি ৩ মিনিটে কোনো না কোনো হাসপাতালে নতুন করে একজন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এ নিয়ে চলতি জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬ হাজার ৪২১ জনে দাঁড়াল। বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা ৩-৪ গুণ বেশি। বর্তমান সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে, সিটি করপোরেশনের মশা মারার ওষুধ কার্যকর নয়। তাই ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এডিস মশা প্রতিরোধে আরো কার্যকর ওষুধ ব্যবহার করা উচিত। এখন ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। তাই ডেঙ্গু মুক্ত থাকতে আরো কার্যকর ওষুধের প্রয়োজন।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৪৫ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৫৭, ঢাকা শিশু হাসপাতালে ১১, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৪৮, হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৭৯, বারডেম হাসপাতালে ৪, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ১৬, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৫, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৬ জন এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে ১৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এদিকে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো ১৪ জন ভর্তি আছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ১৬ জন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪, যশোরে আড়াই শ বেডের জেনারেল হাসপাতালে ৫ জন, বরিশালের শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে দুজন চিকিৎসকসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও মৃত্যুর খবর আমরা জেনেছি। জানা গেছে, রাজধানীর হাসপাতালগুলোর কোনো ওয়ার্ড বা কেবিন ফাঁকা নেই। সিটও খালি নেই। বাধ্য হয়ে করিডরে আলাদা সিট বসিয়ে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা দিনরাত সেবা দিচ্ছেন। ডেঙ্গু রোগী সামলাতে অন্য রোগীদের চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। যেহেতু ডেঙ্গুজ্বরের প্রধান বাহক এডিস মশা, তাই এ মশা মারতে আগে থেকেই কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, এমন প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকরাও।

এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, এ বছর ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। আগে যেমন তীব্র জ্বরের সঙ্গে গায়ে র্যাশ ওঠা, ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যেত, এবার সেসব লক্ষণ ছাড়াও অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। দেখা যায়, রোগীর রক্তের প্লাটিলেট খুব দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে জ্বর হলে ঘরে বসে চিকিৎসা না নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। জ্বর না কমা বা অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকা, বমি হওয়া, পেটে তীব্র ব্যথা, রক্তক্ষরণ, মাথা ধরা, চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ৪ থেকে ৬ ঘণ্টা প্রস্রাব না হওয়া বা কম হওয়া, খুব বেশি দুর্বল হয়ে পড়া, নিদ্রাহীনতা ও আচরণের আকস্মিক পরিবর্তন ডেঙ্গুজ্বরের অন্যতম লক্ষণ।

দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মশা নিধনে বরাদ্দ ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামান্য কমে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ ছিল ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, উত্তর সিটিতে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। পরের বছর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে দক্ষিণ সিটিতে বরাদ্দ হয় ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, উত্তর সিটিতে ২০ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মশক নিধন খাতে ২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন করেছে ২১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটি টাকার মশার ওষুধ কিনেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর চলতি অর্থবছরে ২৮ কোটি টাকার ওষুধ কেনার কথা ভাবছে। অন্যদিকে ডিএনসিসিতে গত অর্থবছরে ১৮ কোটি টাকার ওষুধ কিনেছে। চলতি বছরের ডেঙ্গুর প্রকোপের কারণে এ খাতে আরো কয়েক কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হবে বলে জানা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের হিসাবমতে, ২০১৫ সালে দেশে ৩ হাজার ১৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৪৮ জন। এ বছর আক্রান্তের সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্বয়ং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য টিমই মাঠপর্যায়ে গত এক সপ্তাহে সংস্থাটির পাঁচটি অঞ্চলে ৩ হাজার ৫২৬ রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যে ১ হাজার ৫৩১ জনই ছিল জ্বরের রোগী। ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাজেট বাড়ানো হলেও নাগরিকরা সেবা পাচ্ছেন না। উদ্বেগের বিষয় হলো সরকারি সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, রাজধানীতে যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে তাতে মশা মরছে না। অকার্যকর মশার ওষুধের কারণে যতই বাজেট বাড়ানো হোক কোনো কাজে আসবে না। এর মধ্যে দুর্নীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বাংলাদেশের আবহাওয়ায় জুন-জুলাই ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশার প্রজনন মৌসুম। এ সময় থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টির পানি জমে যায়। জমে থাকা পরিষ্কার পানিতে এডিস মশার জন্ম হয়। রাজধানীর মশা নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মশক নিবারণী দপ্তরের ৯ শতাধিক কর্মী প্রতিদিন কাজ করছেন। এতে প্রতিটি ওয়ার্ডে অন্তত আটজন করে শ্রমিক কাজ করার কথা। কিন্তু এলাকায় এসব লোকের দেখা পান না নগরবাসী। নগরবাসীর দাবি, ওই দুই মাসেই নয়, এবার বছরজুড়েই মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ তারা। এমন অবস্থা যে, দিনের বেলায়ও বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট, অফিস সব জায়গায় মশার উৎপাত রয়েছে। অথচ বর্ষা শুরুর আগে মশা নিধনে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি সিটি করপোরেশন। মশক নিধনের কাজে নিয়োজিত কর্মীদের দেখা যায় কালেভদ্রে। কোনো বড় প্রোগ্রাম না থাকলে মশক নিধনের কার্যক্রম চোখে পড়ে না। মাঠপর্যায়ে মশক নিধনের সঙ্গে যুক্ত সিটি করপোরেশনের সদস্যরাও স্বীকার করেছেন, ওষুধে মশা মরে না, কথা সত্য। সত্য যদি তাই হয় তাহলে আমাদের রাজধানী শতধাবিভক্ত করে একাধিক নগরপিতা করে কী লাভ হলো! তাই নগরবাসীর দাবি ডেঙ্গুতে যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তাদের সঠিক চিকিৎসার দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সেই সঙ্গে ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি। তদুপরি, এই ডেঙ্গু এ বছরই তার রোগ ছড়াবে আগামী বছর আর ছড়াবে না—এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই; সুতরাং ডেঙ্গু প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য দেশবাসী আশা করে।

 

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

moin412902@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads