• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯
চাই হিরণ্ময় শক্তির পুনর্জাগরণ

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

চাই হিরণ্ময় শক্তির পুনর্জাগরণ

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৫ আগস্ট ২০১৯

আজ ১৫ই আগস্ট। ১৯৭৫ সালের এই দিনে সুবেহ সাদেকের লগ্নে ইতিহাসের চাকা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে। ঘাতকের কালো মেশিনগানের গর্জনের নিচে মুখ থুবড়ে পড়েছিল মানবতা, মানবসভ্যতা। সপরিবারে নিহত হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই মর্মন্তুদ ট্র্যাজেডি কেবল বাংলাদেশ কিংবা বাঙালি জাতিকেই নয়-গোটা দুনিয়াকে স্তব্ধ ও বিমূঢ় করে দিয়েছিল। বীরের জাতি বাঙালিদের বিশ্ববাসী চিহ্নিত করেছিল বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞ হিসেবে। মুষ্টিমেয় কিছু বিপথগামীর যোগসাজশে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় এজেন্ট মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শত্রুরা সমসাময়িক ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তারা চেষ্টা করেছিল আবহমান বাঙালির লালিত আদর্শ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চিরতরে ধ্বংস করে দিতে। ঘাতকচক্র চেয়েছিল গোটা দেশকে আত্মপ্রতারণার গিলাব দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিতে। তারা চেয়েছিল ছলচাতুরীর কফিন দিয়ে দাফন করে দিতে—আমাদের যা কিছু ইতিহাস, ঐতিহ্য, যা কিছু গর্ব ও গৌরবের সবকিছুকে। এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকেও তারা বিকৃত করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় নেতাদের চরিত্র হনন করে চেয়েছিল তাদের ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলতে।

অন্যদিকে নিরন্তর সচেষ্ট ছিল কিছু খলনায়ককে জাতীয় বীর হিসেবে ইতিহাসে অভিষিক্ত করতে। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হয়নি। কারণ মিথ্যা দিয়ে ইতিহাস রচনা করা যায় না। ইতিহাসে মিথ্যার কোনো স্থান নেই। তাই সবার অজান্তে সেসব খলনায়ক নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আজ জাতির পিতাসহ মুক্তিযুদ্ধের বীরসেনানীরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে মানুষের হূদয়ের সিংহাসনে। প্রতিটি বাঙালির হূদয়ে আজ বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন একেকটি স্মৃতিসৌধ হয়ে, একেকটি শহীদ মিনার হয়ে। আর বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা বিশ্বের দরবারে যে ঘৃণার জন্ম দিয়েছিলাম, কিছুটা হলেও আমরা তা মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসির রজ্জুতে ঝোলানোর মধ্য দিয়ে নিষ্কৃতি পেয়েছি দায়বদ্ধতা থেকে। আসছে বছরেই আমরা পালন করব জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। চারদিকে সেই মহোৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। বিশ্ব ইতিহাসে প্রমাণ হবে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু নেই। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী মহামানব।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর অনেকদিন পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ফাঁস হওয়া একটি ডকুমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল। সর্বনাশা ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা যখন নিহত হন তখন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন আমেরিকান অ্যাম্বাসাডর যে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন ওই ডকুমেন্ট ছিল তারই একটি কপি। তাতে লেখা ছিল, ‘The assassination of Sheikh Mujib rendered the new born nation completely leaderless'. বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বাঙালি জাতিকে কী পরিমাণ নেতৃত্বহীন করেছিল, তা বোঝার জন্য আমাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ডকুমেন্ট পড়ার প্রয়োজন হয় না। ১৯৭১ সালে আমরা যখন মহান মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা যখন যুদ্ধে লিপ্ত তখন আমাদের বোমারু বিমান ছিল না, আমাদের ট্যাংক ছিল না, কামান ছিল না, যুদ্ধজাহাজ ছিল না। কিন্তু আমাদের জাতির পিতা বেঁচেছিলেন। তিনি লায়ালপুরের জেলপ্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সঠিক নির্দেশনায় মাত্র ৯ মাসের মধ্যে আমরা পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী ও আধুনিক সেনাবাহিনীর দাবিদার পাকিস্তানিদের পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলাম। এই জন্যই একজন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছিলেন-‘বন্দি মুজিব ছিলেন মুক্ত মুজিবের চেয়ে লক্ষগুণ শক্তিশালী।’ পাশাপাশি ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা কী দেখতে পেয়েছিলাম? ওই সময় আমাদের সবকিছুই ছিল। পুরো আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। আমাদের মন্ত্রীরা ছিলেন, গভর্নররা ছিলেন, এমপিগণ ছিলেন। আওয়ামী লীগ ছিল, ছাত্রলীগ ছিল, শ্রমিক লীগ ছিল, যুবলীগ ছিল। আমাদের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, রক্ষীবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিডিআর সবকিছুই ছিল। শুধু ছিলেন না জাতির পিতা—তাঁর নেতৃত্ব। সেই কারণেই ১৫ আগস্ট আমাদেরকে যুদ্ধ শুরু না হতেই আত্মসমর্পণ করতে হলো—বিনা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হলো।

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের অন্তত ২১ বছর ধরে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি কী নিদারুণ ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে জাতিকে পথ চলতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে ঘাতকচক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছে ইতিহাসের চাকাকে পেছনে ফিরিয়ে দিতে। ইতিহাসকে সাময়িকভাবে থমকে দেওয়া যায় কিন্তু কখনো পেছনে নেওয়া যায় না। তাই যদি হতো তবে পৃথিবীতে বীরের জন্ম হতো না—পৃথিবীতে বিপ্লব হতো না, পৃথিবীতে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ হতো না। আমাদের সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধু মরে যাওয়ার পর এই জাতির হাল ধরেছিলেন জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা শুধু বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাতির পিতার আদর্শের সঠিক ও সার্থক উত্তরসূরিও। সৌভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের তথা জাতির হাল ধরেছিলেন বলেই অন্তত একুশ বছর পর হলেও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে সক্ষম হয়েছিল। শেখ হাসিনার অবর্তমানে গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক ও মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের চিন্তাচেতনা-সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠী কখনো রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেত কি না, তা নিশ্চিত ছিল না।

আজ জাতির পিতার যোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা জাতির সেবায় নিয়োজিত। বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেছেন কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব রেখে গেছেন তাঁর প্রিয় কন্যার জন্য। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই অভীষ্ট মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন রূপকল্প-২১ ও উন্নত বাংলাদেশ-৪১। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণজয়ন্তী পালনের লক্ষ্যে জাতি আজ সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের পথ চলতে হবে কঠিন সতর্কতার সঙ্গে। স্বাধীনতার পরপরই একজন বিদেশি সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুকে যখন জিজ্ঞাসা করেছিলেন—What is your best quality? বঙ্গবন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন—I love my people. আবার যখন বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাওয়া হলো What is your worst quality? বঙ্গবন্ধু সহাস্যে উত্তর দিয়েছিলেন— I love them too much. বঙ্গবন্ধুর এই কথার মর্মার্থ আমাদের চেতনায় ধারণ করতে হবে। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হূদয় দিয়ে বঙ্গবন্ধুর লালিত আদর্শ ধারণ করতে হবে। তাকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে জাতির পিতার মৃত্যুতে যে নেতৃত্বশূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল, আজ তা অনেকটাই পূরণ হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে আমরা আমাদের অভিভাবককেও হারিয়েছি। সফল নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জাতির অভিভাবকত্ব্বের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষকে ভালোবাসতে হবে। একই সঙ্গে সতর্ক থাকতে হবে ভালোবাসার পথ গলিয়ে যাতে কোনো হিংস্র ও অর্থগৃধ্নু মহল প্রবেশ করতে না পারে। জাতির মর্মমূলে হিংস্র ছোবল হানতে না পারে, রক্তক্ষরণ করতে না পারে, যেমনটি তারা করেছিল বঙ্গবন্ধুর বেলায়। আজ বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীতে আমাদের সূর্যশপথ হবে জাতির পিতার স্বপ্ন সোনার বাংলা আমরা গড়ে তুলবই। আজ আমরা বিলাপ করব না। আজ আমাদের হিরণ্মময় শপথ নেওয়ার দিন। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ চেতনা বাস্তবায়ন ও লাখো শহীদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অগ্নিশপথের ক্ষণ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads