• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
ভালো খবরের আশায় প্রতিদিন

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ভালো খবরের আশায় প্রতিদিন

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ১৭ আগস্ট ২০১৯

আমার বন্ধু মাহবুবুর রহমান। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। জয়পুরহাটের সন্তান হলেও বর্তমানে বসবাস সিলেটে। অবসর জীবনে সে ফেসবুকে ঝুঁকেছে বেশ ভালোভাবেই। প্রতিদিনের নানা রকম পোস্টের পাশাপাশি সবার শুভকামনা করা যেন ওর রুটিন ওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকালে একগুচ্ছ ফুলের ছবি দিয়ে বন্ধুদের ‘শুভ সকাল’ জানায়। আর রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে সপুষ্পক আরেকটি পোস্ট দেয় ‘সুন্দর সকালের প্রত্যাশায়’ লিখে। কয়েক মাস ধরে এটা ওর দৈনন্দিন কাজ। একদিন ওকে লিখলাম, ‘বন্ধু, তুমি তো প্রতি রাতেই সুন্দর সকালের প্রত্যাশায় ফুল পাঠাও। কিন্তু সুন্দর সকাল তো আসে না। ঘুম থেকে উঠে আমরা যে সকালের মুখ দেখি, তা সুন্দর তো নয়, বরং নানা রকম খারাপ খবর নিয়ে আসা সকালকে ভীতিসঞ্চারক মনে হয়। একেকটি সকাল বয়ে আনে হত্যা, গুম, ধর্ষণ, মারামারি, দুর্নীতি, লুটপাট ইত্যাদি নেতিবাচক খবর। পূর্বাকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যে দৈনিক পত্রিকাগুলো আমাদের সামনে উপস্থিত হয়, সেগুলোতে আশাজাগানিয়া কোনো খবর থাকে না। থাকে মন-খারাপ করে দেওয়া, পিলে চমকানো রোমহর্ষক সব খবর। মনকে উৎফুল্ল করে দিতে পারে, সুন্দর দিনের আগমনী বার্তা দিয়ে প্রত্যাশার বেলুনটিকে স্ফীত করতে পারে-এমন খবরের প্রচণ্ড অভাব।

এ সমাজকে নিয়ে কেউ যেন আর আশাবাদী হতে পারছে না। সর্বত্র অবক্ষয়ের ধারা নিম্নমুখী। সন্ত্রাসী-দুষ্কৃতকারীদের দোর্দণ্ড প্রতাপে জনগণের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। প্রায় প্রতিদিন এখানে-ওখানে সন্ত্রাসীদের জিঘাংসার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ওদের হাতে জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে অনেকের। সবচেয়ে শঙ্কা জাগানো খবর হলো, কিশোর বয়সিদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া। এদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে অনেক নৃশংস ঘটনা। বরগুনার রিফাত শরীফকে যারা হত্যা করেছিল তারা কেউই পরিণত বয়সের ছিল না। সবাই তরুণ-কিশোর। কিন্তু এ বয়সেই ওরা হয়ে উঠেছিল ভয়ংকর। নয়ন হয়ে উঠেছিল ‘নয়ন বন্ড’। সে গড়ে তুলেছিল একটি সন্ত্রাসী বাহিনী। শুধু বরগুনা নয়, সারা দেশেই ওই ধরনের বাহিনী গড়ে ওঠার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি দৈনিক সমকাল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং গজিয়ে ওঠার ভয়ংকর সংবাদ দিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত ধারাবাহিক ওই রিপোর্টের শিরোনামগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় কত ভয়ংকর গোখরো বেড়ে উঠছে আমাদের অজান্তে! ‘ঢাকায় বখাটেদের ৩২ গ্রুপ’, ‘ওরা উত্তরা দক্ষিণখান মিরপুরের আতঙ্ক’, ‘চট্টগ্রামের গ্রুপগুলো বড় ভাইদের হাতের পুতুল’, ‘সব অপরাধেই জড়িত খুলনার তিন গ্রুপ’, ‘বখাটেদের দৌরাত্ম্যে সিলেটে আতঙ্ক’, ‘সুনামগঞ্জের বখাটেদের যন্ত্রণায় বাল্যবিয়ে’, ‘বরিশালে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ’, ‘বগুড়ায় বাড়ছে ভয়ংকর কিশোর অপরাধী’, ‘রাজশাহীতে নেপথ্যে রাজনৈতিক নেতারা’, ‘কিশোরগঞ্জের অলিতে গলিতে ৩০ স্পষ্ট’, ইত্যাদি শিরোনাম থেকেই আন্দাজ করা যায় কী বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে ওরা জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে! ঢাকাসহ সারা দেশের বখাটে গ্রুপগুলো কী ধরনের অপরাধে লিপ্ত, তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে। এসব গ্রুপের আবার বিচিত্র ধরনের নামও আছে। ‘লাড়া দে’, ‘দেখ লে, চিন লে’, ‘বাংলা’, ‘কোপাইয়া দে’, ‘ব্যাড বয়েজ’ ইত্যাদি নামে পরিচিত বখাটে গ্রুপগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাড়া-মহল্লায়। নিজেদের গ্রুপের অস্তিত্ব ও ক্ষমতার জানান দিতে এরা দেয়ালে লিখে রাখে নানা ধরনের স্লোগান। এসব গ্রুপ আবার পরস্পরবিরোধী। এক গ্রুপের সঙ্গে আরেক গ্রুপের দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। পারস্পরিক এ দ্বন্দ্বের ফলে কখনো কখনো ঘটে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। খুনোখুনিও হয় মাঝেমধ্যে। এরা দিনদুপুরে রাস্তার পাশে বা নির্জন জায়গাায় বসে গাঁজাসহ নানা রকম মাদক সেবন করে থাকে। ওইসব বখাটের হাতে এলাকাবাসী হয়ে আছে জিম্মি। ইজ্জত, সম্মান আর জীবনের ভয়ে সবাই থাকেন তটস্থ। মেয়েরা প্রতিনিয়ত শিকার হয় ইভটিজিংয়ের। লাঞ্ছনার শিকার মানুষ প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। কারণ বেপরোয়া এসব গ্রুপের বখাটেরা এতটাই দুর্ধর্ষ যে, কারো জীবন হরণে দ্বিধা করে না। পত্রিকাটির অনুসন্ধানী ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বখাটে কিশোর-তরুণদের ওই গ্রুপগুলো সমাজের সব অপরাধের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। কখনো কখনো এরা গ্রেপ্তার হলেও অদৃশ্য শক্তির ইশারায় মুক্ত হয়ে যায়। এরা নিয়ন্ত্রিত হয় বড় ভাইদের দ্বারা। এই বড় ভাই কারা, তা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। সমাজ ও প্রশাসনে এসব বড় ভাইয়ের রয়েছে প্রচণ্ড প্রভাব। ফলে এরা হয়ে উঠছে বেপরোয়া। অবশ্য সিরিজ রিপোর্টের প্রথম কিস্তি প্রকাশের পরদিনই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২২ বখাটেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে মোহাম্মদপুরের ‘লাড়া দে’ গ্রুপের লিডার তামিমুর রহমান মীম রয়েছে।

বখে যাওয়া কিশোররা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তার দৃষ্টান্ত তো স্থাপিত হয়েছে বরগুনাতেই। যে নয়ন বন্ড এখন আলোচিত চরিত্র, সেও ছিল এমনি একটি গ্রুপের নেতা। মিন্নি নামের মেয়েটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় প্রতিহিংসায় উন্মত্ত নয়ন খুন করতে দ্বিধা করেনি রিফাত শরীফকে। যেমন হাত কাঁপেনি রাজধানী ঢাকার মগবাজারের বখাটে রকির তুলা মিয়ার বুকে ছুরি বসিয়ে দিতে। বরগুনার রিফাত হত্যার ঘটনারই নতুন সংস্করণ যেন। খবরে বলা হয়েছে, বখাটে সজীব আহমেদ রকি (১৮) উত্ত্যক্ত করত তার চেয়ে দুই বছরের বড় প্রতিবেশী স্বপ্নাকে। সজীবের ভয়ে স্বপ্না ঘর থেকে খুব একটা বেরও হতো না। এ কারণে স্বপ্নার মা কয়েক মাস আগে সজীবের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেন। পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। মাস খানেক জেল খেটে সম্প্রতি বের হয়ে আসে সজীব। এসে স্বপ্নাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু স্বপ্নার বাবা-মা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১ আগস্ট ছিল স্বপ্নার বিয়ে। দুপুরে বরযাত্রী আসার পর রান্নাঘরে স্বপ্নার বাবা তুলা মিয়া ও মা ফিরোজা বেগম যখন মেহমানদের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত, বাড়ির দেয়াল টপকে প্রবেশ করে রকি। কেন স্বপ্নাকে তার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হলো না—এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে সে তুলা মিয়া ও ফিরোজা বেগমকে ছুরিকাঘাত করে। উপস্থিত লোকজন ঘাতক সজীবকে হাতেনাতে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তুলা মিয়াকে মৃত ঘোষণ করেন। ফিরোজা বেগম চিকিৎসাধীন। এ ঘটনা সচেতন ব্যক্তিদের নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। কারণ এটা অবক্ষয়জনিত ব্যাধিতে ভয়ংকরভাবে আক্রান্ত একজন কিশোরের উন্মত্ততার নজির। এ প্রবণতা রোধ করা না গেলে এ সমাজ বসবাসের যোগ্য থাকবে কি না-এ প্রশ্নও উঠেছে।

বখাটে হয়ে কেউ জন্মায় না। কিশোর-তরুণরা কেন বখে যায়—এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কেন তারা আলোকিত পথে না গিয়ে অন্ধকারের দিকে পা বাড়াচ্ছে? এজন্য কারা দায়ী? ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্র কেউ এ দায় এড়াতে পারে না। বহু অভিভাবক আছেন, যারা ছেলেসন্তানের বেড়ে ওঠার দিকে প্রয়োজনীয় নজর দেন না। ছেলে কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে সে সম্পর্কে থাকেন উদাসীন। তাদের এ উদাসীনতা, অবজ্ঞা একটি ছেলেকে সহজেই বিপথে চলার সুযোগ অবারিত করে দেয়। আর রাষ্ট্র যখন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়, তখন অপরাধীর অঙ্কুরোদ্গম হয় নানা স্থানে, নানাভাবে। কিশোর-তরুণদের বখে যাওয়া বা অপরাধে জড়িয়ে পড়া সমাজের সুস্থতার সাক্ষ্য দেয় না। সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, যখন একটি সমাজে অনৈতিকতার চর্চা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়, তখনই সে সমাজে এমন অস্থিরতা দেখা দেয়। আজ আমাদের যুবসমাজ নানা অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এত কথা বলা হচ্ছে, এত সভা-সেমিনার হচ্ছে, রাষ্ট্রের উঁচু পর্যায় থেকে এসবের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হচ্ছে, কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত অবনতি ঘটছে। তাহলে কি কোথাও কোনো ফাঁক রয়ে গেছে?

মুম্বাইয়ের একটি বিখ্যাত ছবি ‘হাম পাঁচ এক টিম’। সেখানে বখাটেদের গ্রুপগুলো কীভাবে গড়ে ওঠে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। বাবার হত্যাকারীকে খুন করে জেলে যায় এক কিশোর। সেখানে পরিচয় হয় আরেক কিশোর কয়েদির সঙ্গে। একসময় ওরা জেলমুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে। আরো তিনজনকে জোগাড় করে গড়ে তোলে একটি গ্যাং। করতে থাকে খুনসহ নানা অপরাধ। তারপর একে একে ওরা সবাই পুলিশের এনকাউন্টারে মারা যায়। ছবিটি মূলত কিশোর অপরাধের কারণ ও তার প্রতিকারের চিন্তার ওপর নির্মিত। আমাদের দেশে যেভাবে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যে কিশোর-তরুণরা আগামীদিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে, তাদের একটি অংশ যদি অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে জাতির সামনে অমানিশার ঘোর অন্ধকার ছাড়া তো আর কিছুই দৃশ্যমান থাকে না!

সমাজে বখাটেদের উৎপাত সব সময়ই ছিল। তবে এখনকার মতো হিংস্র হয়ে উঠত না। বরং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের শাসন তাদেরকে বেশির ভাগ সময় নিরস্ত করত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এরা ভয় পেত। কিন্তু এখন উল্টো ওদের ভয়ে সবাই কম্পমান। যে থানা-পুলিশের কথা শুনলে একসময় এ ধরনের ছিঁচকে মাস্তানরা শেয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে পালাত, এখন তারা উল্টো পুলিশকে ব্যাঘ্র হুংকার দেয়। কখনো কখনো পুলিশ এদেরকে সমীহও করে। কারণ এই খুদে রংবাজদের মাথার ওপর ছাতা হয়ে থাকেন ‘বড় ভাইয়েরা’। বরগুনার নয়ন বন্ড বাহিনীর বাড়-বাড়ন্ত যে বড় ভাইদের কারণেই হয়েছিল, সে কথা তো আর গোপন নেই।

বন্ধু মাহবুবের সুন্দর দিনের প্রত্যাশা কবে পূরণ হবে, জানি না। এ শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের অবসান হোক, স্বস্তির সঙ্গে শান্তির বাতাসে সবাই প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিক-এটা আমরা সবাই চাই। কিন্তু কবে আসবে সে সকাল, যে সকালে ভালো খবর নিয়ে পত্রিকাগুলো চোখ মেলে হাসবে আমাদের দিকে চেয়ে? এ প্রত্যাশা কি অপূর্ণই থেকে যাবে?

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads