• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ডেঙ্গু বন্যা গুজব : কোন পথে বাংলাদেশ

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

ডেঙ্গু বন্যা গুজব : কোন পথে বাংলাদেশ

  • হিমেল আহমেদ
  • প্রকাশিত ১৭ আগস্ট ২০১৯

সাম্প্রতিক সময়ে সংকট ও সমস্যার একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। প্রথমত আয়তন অনুযায়ী অধিক জনসংখ্যা এবং দ্বিতীয়ত জলবায়ু পরিবর্তন— এ দুটোই বাংলাদেশের জন্য চরম হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে একবারে সঠিক সমতায় আনা সম্ভব নয়, আবার প্রকৃতির ওপর মানুষের হাত নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রভাবে এক আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের সবাইকে। প্রথমে রাজধানী ঢাকা তারপর বাংলাদেশের সব জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। সবাই ছুটছেন হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে- ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে, না হয় ভর্তি হতে। রেকর্ড  পরিমাণ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবার। তবে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন অধিকাংশই। ডেঙ্গু আরো মহামারী হতে পারে এমনটা ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার চাপে বাংলাদেশ একটি দূষিত ভূখণ্ডে পরিণত হয়েছে। নদনদী, খালবিল, ড্রেন-নর্দমা— সব জায়গায় এডিস মশার বাস। তাই ডেঙ্গু খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। সরকার ডেঙ্গু টেস্টের ন্যূনতম ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিক তা মানছে না। ফলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সবাইকে। ডেঙ্গু বাংলাদেশে মহামারী রূপ নিয়েছে- এমনটা ঘোষণা করা হবে কি-না তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ইতোমধ্যে পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি দেশেও ডেঙ্গু তার প্রভাব দেখিয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কলকাতায় প্রায় ৭০০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ফিলিপাইনে ইতোমধ্যে ডেঙ্গুকে জাতীয় মহামারী রোগে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, এ বছরের শুরু থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত এডিস মশা বাহিত এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ব্যক্তি যা গত বছরের তুলনায় ৯৮ শতাংশ বেশি। তবে বাংলাদেশে এই প্রথম রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলো। আমাদের অসচেতনতার জন্যই ডেঙ্গু আজ এতটা বিস্তার লাভ করতে পেরেছে। এখন সরকারের উচিত হবে প্রতি রাস্তা, পাড়া-মহল্লার মোড়ে মোড়ে ডেঙ্গুর বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার ক্যাম্প স্থাপন করা। এতে করে জনসাধারণের সুবিধা হবে। ডেঙ্গুর এই প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় ফিলিপাইনে পরিণত হবে এতে সন্দেহ নেই।

ডেঙ্গু আতঙ্কের মধ্যেই চলছে বন্যা। এই বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টি ও উজানের পানিতে বন্যা দেখা দিয়েছে সারা দেশে। কোথাও পানি কমছে তো আবার কোথাও বাড়ছে। সীমাহীন দুর্ভোগ আর কষ্টের মধ্যে সময় পার করছে বানভাসিরা। দেশের নদী তীরবর্তী এলাকা ও হাওর অঞ্চলে বন্যার প্রভাব বেশি। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় প্রতিবছর বন্যার মতো দুর্যোগ হানা দেয় এবং এর ক্ষয়ক্ষতিও ব্যাপক। এনডিআরসিসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১৭ জেলায় এ পর্যন্ত মোট ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫০ লাখ। কিন্তু যে ১১ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, সেই জেলাগুলোর ক্ষয়ক্ষতি জরিপ করা হয়নি এখনো। তবে বন্যা-পরবর্তী দুর্ভোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই ১১ জেলা যোগ করলে প্রায় এক কোটি মানুষ বন্যায় কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা হবে কমপক্ষে ২০ লাখ। আর দুই লাখেরও বেশি হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। গবাদিপশু, রাস্তা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কত সময় লাগবে তা কারো জানা নেই। বন্যা প্রতিবছর ব্যাপক ক্ষতি করে এবং এর সঙ্গে কেড়ে নেয় অসংখ্য নিরীহ প্রাণ। বন্যায় এ পর্যন্ত ১১৭ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইমারজেন্সি অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম। এ ছাড়া বন্যায় এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৬৭৬ জন নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এদের সুচিকিৎসা দেওয়া অতীব জরুরি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ত্রাণ সরবরাহ ও পুনর্বাসনে সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী হলেও চাহিদা অনুযায়ী অপ্রতুলতার কড়া বাক্য সরকারকে শুনতে হচ্ছে। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোও এগিয়ে এসেছেন বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য। বন্যার পানি ক্রমশ কমছে, দেশের বিভিন্ন জেলায় নদীর পানি কমছে। আর কিছুদিনের মধ্যে বন্যা চলে গিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে বানিভাসিরা এই প্রত্যাশা সবার।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের প্রধান আরেকটি সমস্যা হলো গুজব! যদি বলা হয় গুজব একটি সামাজিক ব্যাধি, তাহলে অত্যুক্তি হবে না। বর্তমানে সমাজে এক কান থেকে অন্য কানে বাতাসের মতো গুজব ছড়িয়ে পড়ে। অতিসম্প্রতি ছেলেধরা গুজবের বলি হয়েছে অনেক নিরীহ প্রাণ। সাভারে বাসা ভাড়ার খোঁজ করতে গিয়ে এক নির্দোষ নারী ছেলেধরা সন্দেহে জনতার গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন। আরেকটি আলোচিত ঘটনা হলো নিজের চার বছর বয়সী সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর খবর জানতে গিয়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান তাসলিমা বেগম রেণু। যার মৃত্যু সারা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। গুজবকে ব্যবহার করে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছে যারা, তাদের উদ্দেশ্য কী? কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করে জনতা। কোনোমতে পালিয়ে পাশের ফার্মেসিতে আশ্রয় নিলে জানা যায় তিনি ছেলেধরা নন; সঙ্গে যে শিশু রয়েছে, সে তারই সন্তান।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের এক হিসাব অনুযায়ী, এ বছরের জুন পর্যন্ত ছয় মাসেই গণপিটুনিতে মারা গেছেন ৩৬ জন। সারা দেশে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে যে পদ্মা সেতু বানাতে মানুষের মাথা লাগবে! এই আধুনিক যুগে এসেও আমরা অবাস্তব অগ্রহণযোগ্য কথায় বিশ্বাস করে ফেলি যা সত্যিই মর্মান্তিক। শহরের তুলনায় গ্রামের সহজ-সরল মানুষ যা শোনে তা-ই বিশ্বাস করে। সরকারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিনিয়ত সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আমাদের সবাইকে এ বিষয়ে সজাগ ও সচেতন থাকা উচিত। সম্প্রতি ভারতে ছেলেধরা সন্দেহে ৪ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটস অ্যাপ’র মাধ্যমে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে পড়েছে ভারতে। বর্তমানে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো, আমরা ফেসবুকনির্ভর হয়ে গেছি। ফেসবুকে যা দেখি, যা পড়ি, তা-ই বিশ্বাস করি! ফেসবুক বরাবরই ফেইক নিউজের জন্য সমালোচিত হচ্ছে। আর বাংলাদেশে ফেসবুকের কারণেই গুজবের অপপ্রচার বেশি। ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে অনেককে। সরকার তার সাধ্যমতো গুজব ঠেকানোর বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। রাস্তায় গুজববিরোধী পোস্টার, টেলিভিশনে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন এবং মাইকিং করে গুজববিরোধী তথ্য জনসাধারণকে জানানো হচ্ছে। সরকারকে এ জন্য সাধুবাদ জানাই। একই সঙ্গে সচেতন হতে হবে আমাদেরও। মনে রাখতে হবে, আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াও একটি অপরাধ। ডেঙ্গু, বন্যা, গুজব—  সব সমস্যা আর সংকট থেকে বাংলাদেশ উঠে আসুক। আমরা বরাবরই একটি সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads