• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা

  • পুষ্প মোহন চাকমা, বিলাইছড়ি
  • প্রকাশিত ১৮ আগস্ট ২০১৯

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘সৎগুণই জ্ঞান।’ আর এটি না থাকলে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হতে পারে না। চেহারা, আকৃতি ও বর্ণে মানুষ হলেও অসৎ মানুষ পশুর চেয়েও অধম। সততা শুধু নিজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনে না, অপরের জন্যও কল্যাণ সাধন করে। তাই পৃথিবীর সকল মানব কল্যাণে আমাদের প্রত্যেককে সৎ চরিত্রবান হওয়া উচিত। কিন্তু সততা কি আপনিই আসে? হ্যাঁ আপনি না আসলেও আমাদের প্রত্যেকের চরিত্রে কিন্তু সততার ভিত্তি আছে। আমাদের দরকার শুধু এটাকে জাগ্রত করে অন্তরে লালন করা, ব্যবহারিক প্রয়োগ সাধন করা।

তারপরও চেতনা ছাড়া সততা রক্ষা করা সহজ নয়। সততা একটি মহান সাধনা। সাধনা ছাড়া সততাকে আবিষ্কার করা কঠিন। কারণ, সততা মানুষের শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপনের অনন্য হাতিয়ার। পক্ষান্তরে মানুষ শৃঙ্খল আবদ্ধ থাকতে পারে না। মানুষ চায় সহজ, স্বেচ্ছাচার ও উন্মুক্ত জীবনাচরণ। কিন্ত এ স্বেচ্ছাচারী ও উন্মুক্ত জীবনাচরণে সততা একটি প্রধান অন্তরায়। ফলে মানুষ তার আপেক্ষিক চেতনায় সততার অপেক্ষা স্বেচ্ছারিতাকে মনের অবচেতনায় প্রাত্যহিক জীবনাচরণে স্থান করে দেয়। তবে সততা থাকলে যে উন্মুক্ত জীবনাচরণ সম্ভব নয় তা কিন্তু নয়। কথা হলো স্বেচ্ছাচারিতায় মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অপরদিকে সততার ভিতসমূহ অতীব সূক্ষ্ম এবং গভীর। যার কারণে জ্ঞানের সূক্ষ্ম চেতনা তথা সাধনা ছাড়া এটি মনের ছোট্ট পরিসর হতে আবিষ্কার করে ব্যবহারিক রূপ দেওয়া সুকঠিন।

তারপরও মানুুষ চায় না নিজেকে স্বেচ্ছাচারী ও অসৎ পথে এগিয়ে নিয়ে যাক। সেটা নিতান্তই জ্ঞানের, মনের অবচেতনায় হয় এবং দীর্ঘ সময় এ পথে চলতে চলতে স্বেচ্ছাচারী চেতনা একদিন মানুষের অন্তরে স্বাভাবিক জীবনাচরণ হিসেবে শক্তিশালী ভিত ও দালান গড়ে তোলে। ফলে পরবর্তীতে স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি নিজের ত্রুটি বা স্বেচ্ছাচারী প্রকৃতিকে খুঁজে পায় না। পুরোই অন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তবু সে নিজেকে স্বাভাবিক মনে করে।

জং বা স্টেইন যেমনি লোহাকে ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলে, তেমনি স্বেচ্ছাচারী চেতনা মানুষের মনুষ্যত্বকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। যার কাছে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আপন-পরের পরিচিতি থাকে না। ভালো-মন্দ বোধ ও বিচারের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তো আমাদের ইহজগৎ ও পরজগতের (আমরা যে যাই মানি না কেন) কল্যাণে মনের অবচেতনাকে চেতনায় জাগরিত করে সর্বদা সততার পথে, সততার সঙ্গে চলা বা জীবন-যাপন করা দরকার। যার সুফল নিজ এবং অপরের কল্যাণেও প্রতিফলিত হবে। যদি আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থানে সততার সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারি তাহলে প্রকৃতই একদিন আমরা সমাজ, দেশ তথা বিশ্বজগৎকে স্বর্গ ভূমিতে পরিণত করতে পারব। সকল মানব সমাজ শান্তি-সমৃদ্ধির সঙ্গে জীবনযাপন করতে পারবে। প্রয়োজন পড়বে না একে অপরকে শাসন-নিয়ন্ত্রণ করার।

আমার দ্বারা কেন অন্যজনকে শাসন করতে হবে? আমিই বা কেন অন্যের দ্বারা শাসিত হব! এটুকু হুঁশ রাখলেই সততার বিষয়গুলো আমাদের মাথায় আনা সম্ভব। এজন্য আমাদের সবার সততার সাধনা করা দরকার।

সৎ কর্মকাণ্ড নিয়ে আপনাকে সর্বদা চেতনা রাখতে হবে বা ভাবতে হবে। সততা বলতে শুধু অন্যায় কিছু না করা বা প্রশ্রয় না দেওয়াকে বোঝায় না। সমাজ তথা মানব জাতির হিতার্থে কাজ করা বা অপরের কল্যাণে কাজ এবং চিন্তা-চেতনা রাখাকেও বোঝানো যেতে পারে। যেহেতু মানুষ মানুষের জন্য। পৃথিবীতে অন্য কোনো মানুষজন না থাকলে একাকী তো কারো পক্ষে বাস করা বা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং নিজের বেঁচে থাকার স্বার্থে অন্যদেরও বেঁচে থাকা জরুরি এবং থাকতেই হবে। তাই একে অপরের কল্যাণ চেতনা তথা সততা যদি আমরা মনে-অন্তরে লালন  করতে না পারি, তাহলে আমরা নিজের স্বার্থে যা কিছু করে চলছি তা সম্পূর্ণই বৃথা এবং অহেতুক। যে লোক ভালো কাজ বা অপরের কল্যাণ চিন্তা করতে পারে না সে কোনোদিন সৎ হতে পারবে না। সৎ হতে হলে নিজের মঙ্গল চিন্তার পাশাপাশি অপরের কল্যাণ চেতনাও থাকতে হবে। অপরের ওপর অন্যায়ের ব্যথায় ব্যথা অনুভব করতে হবে। এই হলো সততার পূর্বশর্ত। তাই যদি আপনি একজন সৎ ব্যক্তি হতে চান, পৃথিবীর সুখ উপলব্ধি করতে চান তাহলে সততার চিন্তা-চেতনাকে মনের মন্দিরে সযত্নে লালন করতে হবে, পূজা করতে হবে। কারণ সততার চেয়ে সুখ পৃথিবীতে আর কিছু নেই। যারা সৎ তারাই কেবল অনুভব করতে সক্ষম যে, সততায় কী সুখ!

আপনি একজন শিক্ষিত বা জ্ঞানী লোক, আপনার আনাচে-কানাচে দৈনন্দিন অন্যায়-অনিয়ম ঘটেই চলছে। আপনি কি তার প্রতিবাদ করবেন? নাকি প্রতিনিয়ত প্রশ্রয় দিয়ে যাবেন? না উদাসীন হয়ে থাকবেন কোনো খেয়াল-গুরুত্ব ছাড়া! আপনাকে প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদী হতে হবে। আপনি যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ  করেন তাহলে আপনার পাশের দশজনের কল্যাণ হবে। এছাড়া আপনি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে থাকলে ন্যায়ের চিন্তা-চেতনাগুলো আপনার মনে আরো শক্ত করে ভিত গড়ে তুলবে। তবে হ্যাঁ আপনার প্রতিবাদে কেউ কষ্ট পেতে পারেন, আপনাকে শত্রু ভেবে নিতে পারেন। কিন্তু একদিন যদি তার সৎ জ্ঞানের চেতনা উদয় হয় তখন সে বুঝতে পারবে যে, আপনি কারো বিরুদ্ধে শত্রু হিসেবে কাজ করছেন না। এছাড়া যেহেতু আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ, আপনার শিক্ষার পাশাপাশি সততার প্রয়োজন। সততা না থাকলে আপনার শিক্ষার কোনো মূল্য নেই। আপনি যদি অসৎ হন, মন্দ কিছু করেন তাহলেও আপনার সামনে বসে কেউ আপনাাকে গালমন্দ বা সমালোচনা না করলেও আপনার অগোচরে কিন্তু অনেকে সমালোচনা করবে, হেয় প্রতিপন্ন করবে।

মানুষ যখন সততা আর জ্ঞানের দ্বারা সভ্যতায় এগিয়ে চলল, তখন তারা শিক্ষা তথা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার চিন্তা করল এবং করেছে কেন? শুধু চাকরি-বাকরি করে জীবিকার জন্য, একটি কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। মানুষ যদি সবাই সৎ হয় তাহলে একজন মানুষের জীবিকা তথা কর্মসংস্থানের অভাব হয় না। আমরা আজ সততা থেকে পৃথিবী আর মহাকাশের মধ্যে যতটুকু দূরত্ব, তার চেয়েও অধিক দূরত্বে অবস্থান করছি। আজ আমার আপনার মতো শিক্ষিত, দক্ষ লক্ষ-কোটি জনসম্পদকে বেকার থাকতে হচ্ছে। হতে হচ্ছে অকর্মণ্য ও দিিবদিকহারা!

আমাদের শৈশবের সময় মা-বাবা ও দাদা-দাদিরা রাতে এবং যে কোনো সময় সুযোগ পেলে রূপকথার গল্প শোনাতেন সততার শিক্ষা দেওয়ার জন্য। গল্পগুলো আমাদের শুনতে বড়ই মধুর লাগত। তাই আমরা খুবই আগ্রহ প্রকাশ করতাম সেই গল্প বার বার শুনতে! রূপকথার গল্পগুলো কাল্পনিক হলেও কিন্তু সততা নিয়ে লেখা। সে সময় বা তার পূর্বেকার সময়ে মানুষ অভাব ও সুবিধাহীন জীবনযাপন তথা প্রশাসনবিহীন থাকলেও অন্যায়, অনিয়ম অপরাধ তেমন ঘটেনি। অথচ বর্তমান সভ্যতায় প্রশাসনের সম্মুখেই প্রতিদিন অগণিত অন্যায়-অনিয়ম, অবিচার-অত্যাচার ঘটেই চলেছে। এই রূপকথার গল্পগুলো তাদের আইন ও শৃঙ্খল ছিল। তাদের মধ্যে একটা সততা ছিল, পারস্পরিক বন্ধন-সৌহার্দ্য ছিল। আজ নেই সেই রূপকথা, নেই সেই বন্ধন, ভ্রাতৃত্ব আর সততা। তবে গ্রামে-গঞ্জে এখনো সেই রূপকথার গল্প আছে, আছে সততা আর মানবতাও! যদি ঐ মধুর গল্প শোনানোর মধ্য দিয়ে আপনি সৎ শিক্ষা দেন তাহলে তারা আরো জানতে চাইবে। কারণ রূপকথার গল্পগুলো এমনভাবে সাজানো যে, কিছু অংশ শুনলে মন চায় আরো শুনতে। তাই তারা আরো শোনার এবং শেখার জন্য শুনতে চাইবে, জানতে চাইবে। সুতরাং প্রজন্মকে প্রকৃত মানুষ করার স্বার্থে আপনাকেও পড়তে হতে পারে রূপকথার গল্প। সে হোক কাল্পনিক। মনকে অন্যায়-অনিয়মের মোহজাল হতে রক্ষার্থে শৈশব থেকেই মনকে পাহারা দিতে হবে।

আমরা বর্তমানে অধিকাংশই কমবেশি মানবতাবিধ্বংসী মানসিক রোগে আক্রান্ত। মনের এ রোগ সারাতে না পারলে সততার কোনোটা চর্চা বা সাধনা করা সম্ভব নয়। তাই এ রোগকে আগে মন থেকে সারাতে হবে। মানবতাবিধ্বংসী এ রোগ হলো- উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পত্তি লোভ। এ যুগে আমরা প্রায়ই এ মানবতাবিধ্বংসী মানসিক রোগে আক্রান্ত বলে প্রতীয়মান হয়। প্রতীয়মান হয় এভাবে যে, আজকাল আমরা শিক্ষিতজন, অভিভাবকজনরা কর্মসংস্থান বা চাকরির জন্য চিন্তা করি, কোন দপ্তরে চাকরি হলে অতিরিক্ত টাকা আয় করা যায়! অর্থাৎ কোন দপ্তরে বেশি ঘুষ বাণিজ্য করা যায় সেখানে চাকরি নেওয়া বা চেষ্টা করা।  প্রয়োজনে মোটা অঙ্কের অর্থ ঘুষ দিয়ে হলেও সেখানে চাকরি নেওয়া। আমাদের সমাজে এমন আলোচনাই হতে শোনা যায়। বলুন তো আমাদের চিন্তা-চেতনা কি এমন হওয়া উচিত? মানুষ এবং মানবতা থাকতে পারে একমাত্র মানুষের। তাই সমগ্র মানব সভ্যতার কল্যাণে সততা নিয়ে জীবনযাপন করা দরকার আমাদের। সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হওয়া উচিত।

 

লেখক : সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads