• মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

সিন্ডিকেটের রাহুগ্রাসে চামড়া

  • মহিউদ্দিন খান মোহন
  • প্রকাশিত ২৫ আগস্ট ২০১৯

ইংরেজি সিন্ডিকেট শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি ব্যাপক। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে সিন্ডিকেট তৈরি হতে দেখা যায়। সংঘবদ্ধ কিছু মানুষ তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য যখন তৎপর হয়, তখনই সামনে চলে আসে সিন্ডিকেট শব্দটি। বাংলাদেশে সিন্ডিকেটের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বিস্তৃতির কথা কারো অজানা নয়। নিত্যপণ্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ, সরকারি টেন্ডার ভাগাভাগি, পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদির পেছনে রয়েছে সিন্ডিকেট। মোটকথা আমাদের জনজীবনে সিন্ডিকেটের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। বলা যায় সিন্ডিকেটের রাহুগ্রাসে পড়ে আমরা হাঁসফাঁস করছি। রমজান মাসের কথাই ধরুন। এ পবিত্র মাসটি এলেই ব্যবসায়ীদের একাধিক সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে ওঠে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর জন্য। চাল, ডাল, তেল, লবণ, চিনি, ছোলা, খোরমা-খেজুর, এমনকি মাছ-মাংস-সবজির দামও নিয়ন্ত্রণ করে সিন্ডিকেটগুলো। এর ফলে নাভিশ্বাস ওঠে ভোক্তা সাধারণের।

এই সিন্ডিকেট কতটা শক্তিশালী তা আবারো বোঝা গেল এবারের ঈদুল আজহায়। সারা দেশের লাখ লাখ কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে এবার যা ঘটে গেল তা এক কথায় ন্যক্কারজনক। ছেলেবেলায় আমরা বইয়ে পড়েছি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্য হলো পাট, চা ও চামড়া। যদিও প্রায় তিন দশক ধরে প্রধান রপ্তানিপণ্যের জায়গাটি দখল করে আছে তৈরি পোশাক। জীবন রক্ষাকারী ওষুধও এখন রপ্তানিপণ্যের মধ্যে অন্যতম। তবে বাংলাদেশি চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার রয়েছে এবং এ পণ্যটি রপ্তানির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আসে। সে মূল্যবান পণ্যটি নিয়ে এবার ভানুমতীর খেলা খেলেছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী; যারা অলিখিত একটি সিন্ডিকেটের সদস্য। পত্র-পত্রিকায় এ-সংক্রান্ত যেসব খবর বেরিয়েছে তা হতাশাজনক তো বটেই, দেশের চামড়াশিল্পের জন্য উদ্বেগের বিষয়ও। একটি বড় সাইজের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে আশি থেকে একশ টাকা। অথচ গত বছরও তা বিক্রি হয়েছে সাত থেকে আটশ টাকায়। তারও আগে একটি গরুর চামড়া বিক্রি হতো দেড় থেকে দুই হাজার টাকায়। কিন্তু এবার সে চামড়ার দামে ধস নেমেছে। অনেক জায়গায় চামড়া বিক্রি করতে না পেরে ক্ষুব্ধ কোরবানিদাতারা হয় তা নদীতে ফেলে দিয়েছে, না হয় মাটির নিচে পুঁতে ফেলেছে।

আমাদের দেশের উৎপাদিত মোট চামড়ার অর্ধেকই আসে কোরবানির সময়। ফলে এ ঈদকে চামড়া ব্যবসায়ের মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এ সময় প্রান্তিক ব্যবসায়ীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে চামড়া সংগ্রহ করে আড়তে সরবরাহ করেন। একসময় চামড়া কেনার জন্য প্রতিযোগিতা লেগে যেত। পশু জবাইয়ের আগেই চামড়া বিক্রি হওয়ার নজিরও আছে। কিন্তু এবার কোনো ক্রেতা কোরবানিদাতাদের বাড়িতে ধরনা দেয়নি। আমি সাধারণত কোরবানির ঈদ আমার গ্রামের বাড়িতে (মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর) উদযাপন করি। এবার ঈদের আগেরদিন গরু কিনে বাজারে আসতেই দেখা হয়ে গেল রাখালের সঙ্গে। সে একজন চর্মকার এবং মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী। বললাম— রাখাল, গরু কিনেছি। সকালে আসিস। অন্যান্য বছর সে বলত, দাদা চামড়াটা আমারে দিয়েন। কিন্তু সেদিন বলল, দাদা, এবার চামড়া কিনব না। কেন কিনবে না জানতে চাইলে সে বলল— চামড়া কিনে এবার কেউ লাভ করতে পারবে না। আড়তদাররা সব একজোট হয়েছে। চামড়ার দাম এবার একেবারে নিচে নেমে যাবে। এবার কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া কিনবে বলে মনে হয় না। রাখালের কথার সত্যতা মিলল ঈদের দিন। দুপুর পার হয়ে গেলেও একজন চামড়া ক্রেতারও দেখা মেলেনি। উপায়ান্তর না দেখে সে চামড়া আমাদের গ্রামের মাদরাসায় দান করে দিয়েছি। ওরাও তা অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে।

এ চামড়া বিপর্যয় কেন ঘটল তা নিয়ে রীতিমতো বাগ্যুদ্ধ চলছে। চামড়াশিল্প ও ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত সংগঠনগুলো একে অপরকে দায়ী করছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ একটি পত্রিকাকে বলেছেন, এই পরিস্থিতির জন্য আড়তদাররাই দায়ী। অপরদিকে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দায়ী করেছেন ট্যানারি মালিকদের। তবে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, চামড়ামূল্যে এই ধসের দায় ব্যবসায়ী মহলকেই নিতে হবে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, চামড়া পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয়নি। তার মতে, এ জন্য সরকার ও নীতিনির্ধারকরাই দায়ী। তবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন বিষয়টিকে দেখছেন অত্যন্ত হালকাভাবে। গত ১৮ আগস্ট তিনি বলেছেন, ‘এটা একটা নগণ্য ব্যাপার। এক কোটি চামড়ার মধ্যে দশ হাজার চামড়া নষ্ট হয়েছে। এটা তেমন কোনো ব্যাপার নয়।’ তার ভাষ্যমতে, প্রতিবছরই নাকি হাজার পাঁচেক চামড়া নষ্ট হয়। একই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, ‘বিএনপি আন্দোলনের নামে চামড়া কিনে ফেলে দিয়েছে।’ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে তার এ বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক। যেখানে চামড়ামূল্য বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধান এবং দায়ীদের চিহ্নিত করতে তার উদ্যোগ নেওয়ার কথা, সেখানে তিনি একটি রাজনৈতিক দলের ওপর দায় চাপানোর প্রয়াস পাচ্ছেন। মন্ত্রীর এ বক্তব্য মানুষের মধ্যে যুগপৎ বিস্ময় ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। নিজেদের ব্যর্থতার দায় অপরের কাঁধে চাপানোর এ চেষ্টা কারো কাছেই সমর্থনযোগ্য নয়। শিল্পমন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাবে বিএনপি মহাসচিব ১৯ আগস্ট মন্তব্য করেছেন, ‘সরকারের মন্ত্রীরা অর্বাচীনের মতো কথা বলছেন।’ বস্তুত সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য বিএনপি নগদ টাকায় চামড়া কিনে ফেলে দিয়েছে, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনো ব্যক্তি তা বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। তার এ মন্তব্য যে দায় এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল সেটা বিলক্ষণ বোঝা যাচ্ছে। দুঃখজনক হলো, আমাদের ‘দায়িত্বশীল’রা কখনোই দায় নিতে চান না। চামড়ামূল্যে ধস কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটা মানুষের সৃষ্টি। কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এর পেছনে যে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কারসাজি আছে তা বুঝতে বেশি বিদ্যার দরকার পড়ে না। মন্ত্রীর উচিত সে সংঘবদ্ধ চক্রকে চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। তা না করে যদি এটা নিয়েও রাজনৈতিক ‘ব্লেম গেম’ খেলা শুরু হয়, তাহলে পেছনের দুষ্টচক্র অক্ষতই থেকে যাবে।

বিষয়টি নিয়ে এ পর্যন্ত সংবাদপত্রে যেসব প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, চামড়াশিল্প ও ব্যবসায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত একাধিক মহল এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে। আড়তদার, ট্যানারি মালিকরা একে অপরকে দোষারোপ করলেও তারা কেউই এর দায় এড়াতে পারবে না। মূলত চামড়াশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো তাদের কমন ইন্টারেস্টে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আড়তদাররা বলছেন, ট্যানারি মালিকরা বকেয়া পরিশোধ না করায় অর্থাভাবে তারা চামড়া কিনতে পারেননি। আর ট্যানারি মালিকরা বলছেন, কাঁচা চামড়ার বাজারদরের দায় তাদের নয়। তবে অনেকের ধারণা, চামড়া কেনা হবে না বলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা নামমাত্র মূল্যে তা কিনে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রীও এ জন্য ব্যবসায়ীদের কারসাজিকে দায়ী করেছেন। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার কথাটি অমূলক নয়। তা না হলে ঈদের আগের দিন গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাখাল কী করে জানল যে চামড়ার দাম পাওয়া যাবে না; যেজন্য সে চামড়া কেনা থেকে বিরত থেকেছে। সুতরাং এটা ধরে নেওয়া যায় যে, এর পেছনের ক্রীড়নকরা তাদের লক্ষ্য হাসিলে সফল হয়েছে। লক্ষণীয় হলো, চামড়ামূল্যের এ বিপর্যয়ের জন্য আড়তদার ও ট্যানারি মালিকরা পরস্পরকে দায়ী করে বক্তব্য দিলেও শেষ পর্যন্ত তারা ঐকমত্যে এসেছেন। শুরুতে আড়তদাররা ট্যানারির কাছে চামড়া বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেও গত ১৮ আগস্ট সরকার, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে চামড়া কেনাবেচার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। ১৯ আগস্ট থেকে ট্যানারি মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাও শুরু করেছে। আর আড়তদার-ট্যানারি মালিক সমঝোতার প্রেক্ষিতে কাঁচা চামড়া রপ্তানির সিদ্ধান্ত থেকে সরকারও কিছুটা সরে এসেছে। মন্ত্রী বলেছেন, কাঁচা চামড়া রপ্তানি এখনই নয়, কিছুদিন পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয় যে, সরকার ট্যানারি মালিকদের সুবিধা করে দিতেই কাঁচা চামড়া রপ্তানি কার্যক্রম আপাতত স্থগিত  করেছে।

নিবন্ধের শুরুতে সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে কিছু কথা বলেছি। এবারের কোরবানির পশুর চামড়ার নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা হলো, তার জন্য যে এ সেক্টরের অতি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দায়ী তা এখন আর কারো কাছে অস্পষ্ট নেই। এ ধরনের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। চালকল মালিকরা সিন্ডিকেট করে ধানের দামে ধস নামায়, পাট ব্যবসায়ীরা পাটের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করে উৎপাদক কৃষকদের, শেয়ার মার্কেটের সিন্ডিকেট দরপতন ঘটিয়ে লুটে নেয় হাজার হাজার কোটি টাকা। বলা নিষ্প্রয়োজন, এটা একটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক চিত্র নয়। অসাধু ব্যবসায়ী বা শিল্প মালিকরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অবৈধ পথে মুনাফার চেষ্টা করতেই পারে। তবে সেটা প্রতিহত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কথা ও কাজে সে দায়িত্ব পালনের কোনো আভাস-ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা সাধারণত দরিদ্র-দুস্থ বা মাদরাসা-এতিমখানায় দান করে মানুষ। আড়তদার-ট্যানারি মালিকদের কারসাজিতে এবার তারা সে প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হলো। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, চামড়া কারসাজিতে প্রায় পাঁচশ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এতে মূলত গরিব-এতিমরাই তাদের প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হলো। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতার শেষ দু’লাইনে লিখেছেন— ‘প্রার্থনা করো, যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস/যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।’ জাতীয় কবি দরিদ্র মানুষের মুখের গ্রাস হরণকারীদের সর্বনাশ কামনা করেছেন। কিন্তু এবার যারা লাখো দরিদ্রের মুখের গ্রাস কেড়ে নিল, তাদের কোনো সর্বনাশ তো দূরের কথা, কেশাগ্রও কেউ স্পর্শ করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের রক্ষার জন্য পৃষ্ঠপোষকরা আছেন। আলামত অন্তত সেটাই বলে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads