• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

  • প্রকাশিত ২৬ আগস্ট ২০১৯

জন্মিলে মৃত্যু অনিবার্য-এটাই চিরন্তন সত্য। তবে এমন কিছু মৃত্যু, যা সহজে মেনে নেওয়া যায় না। পরিণত বয়সে মৃত্যু আর কিশোর বয়সে মৃত্যুর মধ্যে অনেক তফাত। মাত্র ১১ বছর বয়সী ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তিতাস ঘোষ। বাড়ি নড়াইলের কালিয়া পৌর এলাকায়। ২৪ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত তিতাসকে ভর্তি করা হয় খুলনা মেডিকেল কলেজে। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য ২৫ জুলাই তিতাসকে ঢাকায় রেফার্ড করা হয়।

আশঙ্কাজনক অবস্থায় ২৫ জুলাই একটি অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নিতে রাত ৮টায় কাঁঠালবাড়ী ১নং ফেরিঘাটে পৌঁছে। তিতাসের ভাগ্য খারাপ, ওই সময়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের ফরমায়েশ পালন করতে ফেরি ছাড়তে তিন ঘণ্টা বিলম্ব করে। তিতাসের মা ও বোনের শত কাকুতি-মিনতির পরও ফেরিসংশ্লিষ্টদের ন্যূনতম সহানুভূতি পাওয়া যায়নি। ভিআইপির ফরমায়েশ বলে কথা! লঙ্ঘন করলে হয়তো চাকরি চলে যাবে। এমন শঙ্কা থেকে ফেরি ছাড়া হয়নি। টানা তিন ঘণ্টা পর যুগ্ম সচিবের আত্মীয়রা ফেরিতে ওঠার পর ফেরি চলতে শুরু করে। দুর্ভাগ্য, এরই মধ্যে তিতাসের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিতাস মারা যায়। কী নিমর্মতা! শুধু যুগ্ম সচিবের আত্মীয়দের ফেরিতে নিতে তিন ঘণ্টা বিলম্ব। মনে হয়, এটা নজিরবিহীন ঘটনা। এ ঘটনার জন্য অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে স্থানীয় মানুষ ও তিতাসের স্কুলের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করেছে।

উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হলে ক্ষমতার অপব্যবহার করার ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। কারণ আমাদের দেশে ক্ষমতাধর আমলাদের বিচার দ্রুত হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জবাবদিহি করতে হয় না। আর একজন রাজনীতিককে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। নির্বাচন এলেই ভোটের জন্য জনগণের দুয়ারে যেতে হয়। ফলে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও একজন রাজনীতিকের জবাবদিহির আওতায় থাকতে হয়। কিন্তু আমলাদের বেলায় আর পুলিশের ক্ষেত্রে তো যা ইচ্ছে তাই হচ্ছে। সম্প্রতি খুলনায় এক গৃহবধূকে রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ করে থানার ওসিসহ পাঁচজন। গৃহবধূ তিন সন্তানের জননী, নিজের সম্ভ্রম রক্ষায় শত কাকুতি-মিনতি করলেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি। গৃহবধূর কাকুতি-মিনতির জবাবে সিনেমার ভিলেনের মতো অট্টহাসি দিয়ে বিবস্ত্র করে তার রুমেই ধর্ষণ করে। ওসি চলে যাওয়ার পর গৌতম দারোগাসহ চারজন রাতভর ধর্ষণ করে। পরে সকালে ফেনসিডেলের বোতল গুঁজে দিয়ে কোর্টে চালান করে।

আদালতে বিচারকের সামনে নেওয়ার পর ওই নারী জিআরপি থানায় তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা তুলে ধরেন। এরপর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট খুলনার আদালতে ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা করার নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় জিআরপি থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্লোজড করা হয়েছে। অবশ্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি তদন্ত করার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে হয়তো বিভাগীয় শাস্তি নিশ্চিত হতে পারে। আমাদের কথা হলো, একজন নারীকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠার পর ক্লোজড কেন, চাকরি থেকে বরখাস্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের দেশে বদলি, প্রত্যাহার এগুলোই যেন শাস্তি! আমরা চাই, ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষায় ধর্ষণ প্রমাণিত হলে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ অপরাধীদের প্রকৃত শাস্তি না হলে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা রোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে। ভাবতে অবাক লাগে জনগণের অর্থে জনসেবায় নিয়োজিত পুলিশের কাছ থেকে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা কি আশা করা যায়? একদিকে গণধর্ষণ করে আবার ফেনসিডিলের বোতল ব্যাগে ভরে দিয়ে কী ধরনের মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছে। নিজেরাই অপরাধ করে নিরপরাধীকে অপরাধী সাজায়, এই হচ্ছে আমাদের দেশে রক্ষকদের চরিত্র!

ভিআইপি বলেই কথা! এ দেশে তো ভিআইপির অভাব নেই। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, বিত্তশালী, শিল্পপতি সবাই নিজেকে ভিআইপি মনে করে আচরণ করেন। যদিও তিতাস হত্যার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল সাপোর্ট অ্যান্ড পিপলস রাইটসের চেয়ারম্যানের পক্ষে জনস্বার্থে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র আইনজীবী জহির উদ্দিন মিলন একটি রিট করেন। রিটে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, কথিত ভিআইপি যুগ্ম সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলসহ কয়েকজনকে বিবাদী করা হয়েছে। ওই রিটে স্কুলছাত্র তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট যুগ্ম সচিব ও ফেরির ম্যানেজারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রিটে তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় স্বতন্ত্র তদন্ত কমিটি গঠন, তিতাসের পরিবারকে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।

অবশ্য ঘটনার পরপরই দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে নৌ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও রয়েছেন। এ ধরনের ন্যক্কারজনক অপরাধে জড়িত ক্ষমতার অপব্যবহারকারীর উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হলে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও প্রকৃত অর্থে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হয় না। এমনকি ঘটনার শেষ অবস্থাও জনগণের জানার বাইরেই থেকে যায়। তিতাসের মতো একজন আহত স্কুলছাত্রকে বহনকারী জরুরি পরিবহনে নিয়োজিত অ্যাম্বুলেন্সকে তিন ঘণ্টা ফেরি আটকে রেখে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী যুগ্ম সচিবের নির্দেশে জনগণের জন্য নিয়োজিত ফেরি আটকিয়ে যে অপরাধ করেছেন, তার উপযুক্ত শাস্তি না হলে আগামী দিনে এ ধরনের ধিক্কারমূলক জঘন্য ঘটনা আরো ঘটার সম্ভাবনা থাকবে।

যদিও রিটের জবাবে হাইকোর্ট মন্তব্য করেছেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া দেশে আর কেউ ভিআইপি নয়। বাকিরা সবাই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মর্মেও আদালতে মন্তব্য করা হয়। নৌ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব অবদুস সবুর মণ্ডলের ফোনের কারণে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ফেরিঘাট থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে ফেরি ছাড়ায় এসব মন্তব্য করেন হাইকোর্টের বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। আমরা আশাবাদী তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যুক্তিযুক্তভাবেই উপস্থাপন হবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তার উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

শুধু এটুকু বলতে চাই, ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন কিংবা জনসেবার নামে ঘুষ দুর্নীতির ঘটনা আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে নিজ বাসায় রাখা ৮০ লাখ নগদ টাকাসহ আটক হন সিলেটের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) পার্থ গোপাল বনিক। যদিও আদালতে তার আইনজীবী রহমান হাওলাদার, মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার, খোরশেদ আলম, গাজী শাহ আলম ও ফারুক আহমেদ দাবি করেন যে, ৮০ লাখ টাকা তার বৈধ আয় থেকে অর্জিত। এর মধ্যে ৩০ লাখ টাকা শাশুড়ি দিয়েছেন এবং বাকি ৫০ লাখ টাকা তার স্ত্রী ডা. রুনার আয়ের ও তার সারা জীবনের জমানো অর্থ। আদালতে দুদকের আইনজীবী জামিনের বিরোধিতা করে বলেন, যেহেতু তিনি সরকারি চাকরিজীবী, তার বাসায় এত টাকা কোথা থেকে এসেছে তা জানার প্রয়োজন রয়েছে। বিজ্ঞ আদলত কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) পার্থ গোপাল বনিককে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এমনি ছোটবড় ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ করা প্রয়োজন। তাহলে স্বপ্নের সমৃদ্ধ রাষ্ট্র বিনির্মাণ করা কঠিন হবে না। প্রকৃত অর্থে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে সবাইকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর তা করতে না পারলে জনস্বার্থের কথা বলতে বলতে হয়তো মুখে ফেনা তোলা সম্ভব হবে কিন্তু প্রকৃত অর্থে জনস্বার্থ রক্ষা আদৌ হবে না। স্বাধীনতার মূলমন্ত্র সাধারণ জনগণের মুক্তি কখনো ঘটবে না।

 

আব্দুল হাই রঞ্জু

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads