• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
‘জেনোসাইড ওয়াচে’র গণহত্যার আশঙ্কা

ছবি : সংগৃহীত

সম্পাদকীয়

‘জেনোসাইড ওয়াচে’র গণহত্যার আশঙ্কা

  • মোহাম্মদ আবু নোমান
  • প্রকাশিত ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৯

কাশ্মীর ও আসাম প্রদেশে গণহত্যা হতে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘জেনোসাইড ওয়াচ’। সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে এ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে বলছে, ‘কাশ্মীরে গণহত্যাসংক্রান্ত ১০টি লক্ষণ এখন স্পষ্ট।’ গত ৫ আগস্ট ভারতের রাষ্ট্রপতি এক ডিক্রির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের ৭০ বছরের পুরনো ‘বিশেষ মর্যাদা’ সংবলিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার মাধ্যমে একসময়ের পৃথিবীর ভূস্বর্গখ্যাত কাশ্মীরের পরিস্থিতি নতুন এক ভয়ংকর গন্তব্যের অভিমুখী হচ্ছে বলে মনে হয়। এই ডিক্রির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বিতর্কিত এই ভূখণ্ডের রাজ্যের মর্যাদা পুরোপুরি কেড়ে নেওয়া হলো। পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোসহ জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাইলেও ভারত বলছে, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। তারা চায় না এতে তৃতীয় কোনো পক্ষ যুক্ত হোক। কিন্তু ভারতকে বুঝতে হবে জম্মু-কাশ্মীরের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে, বিশ্বব্যাপী এর আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক প্রভাব কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিজেপির উগ্র জাতীয়তাবাদীদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে তাদের সর্বাত্মক বৈরিতার যে সূচনা ঘটছে, তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অশান্তি তৈরিসহ সংঘাত ছড়িয়ে দিতে পারে।

জাতিসত্তা বা ধর্মের ভিত্তিতে কার্যকর একটি স্বশাসিত অঞ্চলকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিবর্তন করার মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় উগ্র ফ্যাসিবাদী মানসিকতার চরম বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। কাশ্মীর এমন একটি বিতর্কিত অঞ্চল, যেখানে বিংশ শতাব্দীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও এখানকার বর্তমান সরকার হিন্দুত্ববাদ মতাদর্শের উত্থানে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে। ফলে তারা কখনো ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মুসলমানদের সমর্থন কামনা করেনি।

কাশ্মীরের আগের মর্যাদা ছিল মূলত দেশীয় রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের মতো। আর পরিবর্তিত যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ বা রাজ্যের যে মর্যাদা রয়েছে তা থেকে আরো নিচে নামিয়ে কার্যকরভাবে কাশ্মীরকে একপ্রকার অধিকৃত ভূখণ্ডের পর্যায়ে আনা হয়েছে। ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে যেভাবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে খোদ ফিলিস্তিনিদেরই সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে, ঠিক একই কৌশল কাশ্মীরে নিয়েছে ভারত। ইসরাইলে ফিলিস্তিনি আরবদের বসবাস রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ইহুদি নাগরিকরা যে অধিকার ভোগ করে, সেই অধিকার পায় না আরবরা। সেখানে অ-ইহুদিদের কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে।

কাশ্মীরে আগে থেকে মোতায়েন ভারতের সৈন্যসংখ্যা ৭ লাখের মতো। এরপর গত কয়েকদিনে সেখানে আরো লক্ষাধিক সেনা পাঠানো হয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্র অনুমান করছে। বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা, নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের সভা-সমাবেশ। রাজ্যজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে বলে আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর থেকেও জানা যায়। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ভারতেরই অন্যান্য রাজ্যে যেখানে বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের আনুপাতিক হার প্রতি ৮০০ জনের বিপরীতে একজন সৈন্য, সেখানে কাশ্মীরে প্রতি ৮-১০ জনের জন্য একজন করে সৈন্য থাকার অর্থ হলো, পুরো রাজ্যের প্রতিটি মানুষের ওপর সেনা নজরদারি রাখা। কাশ্মীরের দেড় কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, সেটা অনুমানের জন্য এ তথ্যই যথেষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ মূলত গণহত্যা রোধে কাজ করে থাকে। তারা সামগ্রিক অনুঘটন বিশ্লেষণ করে গণহত্যা হতে পারে কি-না, তার অনুমান ও তা বন্ধসহ দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে তৎপরতা চালায়। গণহত্যা প্রতিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটি আশঙ্কা করছে, কাশ্মীর ও আসামে গণহত্যা হতে পারে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই সতর্কবার্তায় গণহত্যার লক্ষণ হিসেবে দশটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্থাটির গণহত্যা সংক্রান্ত লক্ষণগুলো  হলো— এক. ‘শ্রেণিকরণ’ বা অপরায়নের রাজনীতি। হিন্দু ও শিখ নিয়ে গঠিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘আমরা’ বনাম কাশ্মীরের সাধারণ মুসলিমকে ‘তারা’ বলে চিহ্নিত করা; দুই. গণহত্যার জন্য দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে ভিন্ন পরিচয় নির্মাণ। কাশ্মীরের মুসলিমদের নামগুলো মুসলিম (পরিচয়পত্রে), তাদের আলাদা ভাষা এবং পোশাক রয়েছে; তিন. নানা বৈষম্য বিরাজমান থাকা; চার. অমানবিকতা। অর্থাৎ কাশ্মীরের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দেশটির সরকার থেকে শুরু করে গণমাধ্যমগুলো ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। তাদের আরো কিছু পরিচয় হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী, অপরাধী এবং সবচেয়ে বড় নেতিবাচক যে পরিচয় তা হলো ‘জঙ্গি’; পাঁচ. সামরিক উপস্থিতি। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ দেশটির প্রায় ৭ লাখ সেনাসদস্য মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া তাদের মধ্যে সশস্ত্র পুলিশ রয়েছে; ছয়. মেরূকরণ। ভারতের বর্তমান সরকার দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে প্রকাশ্যে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণা তৈরির কাজটি সুকৌশলে করে যাচ্ছে; সাত. গোটা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। যেকোনো মূল্যে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ হিসেবে দেখছে শাসকগোষ্ঠী; আট. নিপীড়ন। কাশ্মীরের মুসলিমদের খাঁচাবন্দি তথা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে গুম, খুন চলছে। এছাড়া গ্রেপ্তার, ধর্ষণ এবং নির্যাতন তো অহরহই ঘটছে সেখানে; নয়. বিধ্বংসী কার্যকলাপ। ১৯৯০ সাল থেকে সেখানে ২৫টি বড় বড় সংঘবদ্ধ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী; এবং দশ. অস্বীকারের রাজনীতি। কাশ্মীরের ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল’ করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য বলে দাবি বর্তমান সরকার ও কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর। তারা কোনো হত্যার কথা স্বীকার করে না। তাদের দাবি, সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশ কেউই নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা হত্যার চেষ্টাও করেনি।

কাশ্মীর ও আসামে গণহত্যা হতে পারে- জেনোসাইড ওয়াচের উপরের ১০টি লক্ষণ ও গণহত্যাবিষয়ক বিশ্লেষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই ভাবা জরুরি। ৩৭০ ধারার সুরক্ষা তুলে দেওয়ায় এখন ভারতের অন্য অঞ্চলের মানুষেরা কাশ্মীরে জায়গা কিনে বসতি স্থাপন করতে পারবে এবং নির্বিঘ্নে সেখানকার ভোটারও হতে পারবে। ভারতের সঙ্ঘ পরিবারের যে মহাপরিকল্পনা, তার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কাশ্মীর। এ মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২৮ সাল নাগাদ ভারতকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। ইতোমধ্যে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, ভারতীয়দের প্রধান পরিচয় হবে ‘হিন্দুত্ব’। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের হিন্দুত্বের ভাবাদর্শ ও পরিচয়কে মেনে নিয়ে এখানে থাকতে হবে।

কংগ্রেস সংসদ সদস্য গোলাম নবি আজাদ বলেছেন, ‘সীমান্তের একটা রাজ্য যা ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন; সেটাকেই বেঁধে রেখেছিল ৩৭০ ধারা। ক্ষমতায় মত্ত হয়ে এবং শুধু ভোট পেতে বিজেপি সরকার সেগুলো ছেঁটে ফেলল। তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মীর ভারতীয় সংবিধানের মস্তক ছিল। বিজেপি সরকার আজ শিরশ্ছেদ করল।’ ভারতকে একটি কথা মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাকামী কোনো জাতিকে কেউ চিরদিন পদানত করে রাখতে পারে না। বেনিয়া ইংরেজরাও ভারতকে পদানত করে রেখেছিল ১৯০ বছর। এরপর আর পারেনি।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads