• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সংকট

একদিকে জাতিনিধন, অন্যদিকে জননিরাপত্তার প্রশ্ন

  • মামুন মুস্তাফা
  • প্রকাশিত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

একুশ শতকের বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল সামরিক পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোকে বাণিজ্যিক ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা বেশ ভালোভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। আর তাই তো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল সৃষ্টির মাধ্যমে জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখায় পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কসুর নেই। এরই বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেশে দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে শরণার্থীর সংখ্যা। দুই বছর ধরে বাংলাদেশও ভরণপোষণ দিয়ে আশ্রয় দিয়ে আসছে মিয়ানমারের প্রায় দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু দু’বছরের মাথায় এসে আমরা দেখছি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই রোহিঙ্গারা এখন হুমকিস্বরূপ।

আমরা যদি অতীতের দিকে আলোকপাত করি, তবে দেখব যে, বৌদ্ধপ্রধান মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং দীর্ঘ সামরিক শাসনের কারণে আরাকান তথা রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানরা বরাবরই উপেক্ষিত। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন তাদের নির্যাতনের শিকলে বন্দি করেন। ১৯৮২ সালের সরকারি আইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উদ্বাস্তু ঘোষণা করে তাদের ভোটাধিকার, ভ্রমণ, বিয়ে, সন্তান প্রতিপালনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। পুলিশ ও সেনাবাহিনীতেও তাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এমনকি মুসলমানদের ঐতিহ্য মুছে ফেলার জন্য আরাকানের নতুন নাম দেওয়া হয় রাখাইন। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো, আরাকান (রাখাইন) একসময় স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজ্য ছিল, যেখানে শাসন ও বিচার ব্যবস্থায় মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। মহাকবি আলাওলসহ অনেক কবি-সাহিত্যিক আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের মানবিক ধারার সূচনা করেন। সুতরাং আরাকান তথা রাখাইন অঞ্চলে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানরা ঐতিহাসিকভাবেই সেখানকার নাগরিক। তারা অভিবাসী নয়। অথচ এই সত্যকে অস্বীকারের মাধ্যমে তাদের কথিত ‘বাঙালি’র আখ্যা দিয়ে বাস্তুচ্যুত করার পরিকল্পনা আঁটে গণতন্ত্রের লেবাসে বর্তমান সামরিক জান্তা। প্রাণভয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানরা নাফ নদী পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। এখন ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী বাংলাদেশের জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অথচ গত দুই দফা এসব রোহিঙ্গাকে নিজ ভূখণ্ডে ফেরত পাঠানোর দিনতারিখ নির্ধারণ করেও তা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ গত ২২ আগস্ট নাগরিকত্ব প্রদান ও নিরাপত্তার শর্তারোপের মাধ্যমে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রোহিঙ্গারা। উপরন্তু শরণার্থী হিসেবে এদেশে তাদের দুই বছর পূর্তিতে সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের শক্ত অবস্থানের কথা জানান দিয়েছে, যা আমাদের সরকার অবগত ছিল না। সুতরাং এখন ভাবার সময় এসেছে এর ভেতরের দুরভিসন্ধির উৎস কোথায়? আমাদের জননিরাপত্তার স্বার্থে তা জরুরি। ইতোমধ্যে আশ্রিত রোহিঙ্গারা দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও যুক্ত।

এ ধরনের কঠিন সময়ের আবর্তে যেন না পড়তে হয়, সে লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ২০১৭ সালে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত করতে বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তার বাস্তবায়ন কতটুকু হয়েছে সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কিছুই জানে না। অথচ তা করা গেলে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সংকট নিরসন আজ অনেক সহজ হতো। পাশাপাশি নিজস্ব অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে বৈশ্বিকভাবে সামনে আনা জরুরি। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

আমরা জানি, বিশ্বব্যাপী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা ব্যাপকভাবে সমালোচিত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট, জাতিসংঘ মহাসচিব এবং বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশের শীর্ষ নেতারা বর্তমান সময়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের  প্রতি সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মালদ্বীপ এরই মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করেছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সংকট সমাধানে অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। বিশ্বের অনেক দেশেই সাধারণ মানুষ এই বর্বরতার  প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমও বিষয়টিতে যথেষ্ট সোচ্চার হয়েছে। সুতরাং বর্তমান বিশ্ব জনমতকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের শুধু জাতিসংঘ কিংবা নিরাপত্তা পরিষদের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না। কেননা এটা আজ স্পষ্ট যে, নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী পাঁচ সদস্যের ভেটো ক্ষমতা কার্যত জাতিসংঘকে ব্যর্থ সংস্থায় পরিণত করেছে। আর তাই অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সংঘটিত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিণাম আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর সীমান্তে উদ্বাস্তু শরণার্থীদের ভিড়। দিন দিন বেড়ে চলেছে শরণার্থীর সংখ্যা। আর সে কারণেই আমরা দেখতে পাই, গত বছরের শেষ নাগাদ জাতিসংঘে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি উত্থাপিত হলেও নির্যাতিতের কান্না শুনতে পায়নি নিরাপত্তা পরিষদ। অথচ বিশ্ববাসীর সামনে এই মানবিকতার দুঃস্বপ্ন মুছে ফেলতে নিরাপত্তা পরিষদের সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তা অর্জনে সময়সীমা ঠিক করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের ভেটো প্রদান মিয়ানমার সরকারের পোড়ামাটি নীতিকেই কার্যত সমর্থন করল। এর ফলে আবারো প্রমাণিত হলো বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর কাছে তৃতীয় বিশ্বের নির্যাতিত সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আজ ভূলুণ্ঠিত। আর জাতিসংঘ দন্তনখহীন প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়। এক্ষেত্রে এশিয়ার পরাশক্তি চীনের ভূমিকা যে প্রত্যক্ষ তা নিরাপত্তা পরিষদে দেশটির ভেটো প্রদান এবং বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত মিয়ানমারের পক্ষে মতপ্রকাশই যথেষ্ট। এমনকি অতীতে চীনের বিশেষ দূত সান গোসিয়াংও বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছিলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মধ্যস্থতা করতে পারে।

ইতোমধ্যে এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীর কারণে যে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার পাশাপাশি সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তাকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কমেছে বলেও জানা যায়। তবে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে ইন্ধন দেওয়াসহ সহায়তাকারী দালালচক্রকে চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই অনুপ্রবেশ আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থাকেও সংকটাপন্ন করে তুলেছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গারা শরণার্থী ক্যাম্পের বাইরে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বসতি স্থাপন, স্থানীয় শ্রমবাজার নষ্ট করা, বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন এবং সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানব পাচারের মতো অনৈতিক কাজেও জড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে একটি দালালচক্র যে টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিথ্যে স্বপ্নসুখ দেখাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অপরাধীদের আইনের আওতায় না আনতে পারলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই সামাজিক অস্থিতিশীলতাসহ জঙ্গিবাদ নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এমতাবস্থায় জননিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের রোহিঙ্গাদের সার্বক্ষণিক মনিটর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দেশ জঙ্গিবাদের ঝুঁকিতে রয়েছে। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোও এদের ব্যবহার করতে উৎসাহিত হবে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা পাহাড়ের গাছ কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি ও পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে নিরাপত্তার সংকট। আবার মাদক ব্যবসার মতো বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক কার্যক্রমেও জড়িয়ে পড়েছে। ফলে পাহাড় আবারো অশান্ত হতে শুরু করেছে। খুন, রাহাজানি, সন্ত্রাস বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি তারই বলি হতে হয়েছে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে, যিনি কিনা এই রোহিঙ্গাদেরই আশ্রয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন। আবার পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে তিন রোহিঙ্গা। সুতরাং যে বিপর্যস্ত মানবিকতাকে ঠাঁই দিয়েছিল বাংলাদেশ, এখন সেই মানবিকতাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে এদেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে।

সুতরাং নিজ দেশ ও বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে চীনের মধ্যস্থতার আগ্রহকে আমাদের কাজে লাগানো উচিত বলে মনে করছি। ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে অনুষ্ঠিত এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর জোট আসেমের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের দেওয়া তিন ফর্মুলা ছিল— রাখাইনে অস্ত্রবিরতি কার্যকর করে সেখানে স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে মানুষকে তার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে না হয়; অস্ত্রবিরতি কার্যকর হলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পথ তৈরি হয়; এবং চূড়ান্ত ধাপে রোহিঙ্গা সংকটের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে মনোযোগী হওয়া, যেখানে দারিদ্র্য বিমোচন গুরুত্ব পাবে। এখন সময় এসেছে ওই ফর্মুলাকে সময়োপযোগী করে চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে একযোগে কাজ করা। মিয়ানমারের ওপর দীর্ঘদিনের প্রভাব কাজে লাগিয়ে চীন যদি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে অনুঘটক হিসেবে দৃঢ় ভূমিকা রাখে, তাহলে এই সমস্যার সমাধান সহজ বলেই মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে এই বিষয়টি গুরুত্ব পাবে বলে আশা রাখি। আর এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা নামক একটি জাতি সম্পূর্ণ নিধনের হাত থেকে রক্ষা পাবে, অন্যদিকে বাংলাদেশও নিজ রাষ্ট্রের তথা জননিরাপত্তা নিরাপত্তা বিধানে সফলকাম হবে।

এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দ্রুত ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশকে আরো কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর মাধ্যমে ১৯৭৮ ও ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়টি জোরালোভাবে আলোচনায় তুলে ধরতে হবে। আমরা আশা করছি, এই সংকট থেকে উত্তরণে বর্তমানে যে উদ্যোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না।

 

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads