• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

একেই কি বলে জলসা ঘর

  • প্রকাশিত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি বলেছেন, সরকারি দপ্তরের প্রধান ব্যক্তিদের কখনো কোনো কর্মঘণ্টা ছাড়াই কাজ করতে হয়। ডিসি, এসপির অনেক সময় দিনরাত একটানা কাজ করতে হতে পারে। ফলে তাদের বিশ্রামের জন্য এ রকম একটি কক্ষ দরকার হয়। কিন্তু চাকরির বিধিমালা বলে অন্য কথা। চাকরির বিধিমালা বলে, সরকারি অফিসে বিশ্রাম বা সময় কাটানোর জন্য আলাদা খাস কামরা থাকতে পারে; তবে সেখানে খাট থাকতে পারবে না। উপরন্তু খাওয়া-দাওয়ার জন্য চেয়ার-টেবিল থাকতে পারে। অন্যদিকে এ ব্যাপারে সরকারি কোনো বিধান নেই বা সরকারিভাবে কিছু বলা নেই। তবে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে এই প্রথা চলে আসছে বলে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ইংরেজিতে যাকে বলে কাস্টম। বহুদিনের নিজস্ব চর্চায় যা একসময় নিয়মে পরিণত হয়। তাহলে এ রকম কক্ষ বলতে সাবেক এই আমলা কী বুঝিয়েছেন? এ রকম কক্ষ বলতে কি জামালপুরের ডিসি মহোদয়ের জলসা ঘরকে বুঝিয়েছেন? যেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের নারীকর্মীদের নিয়ে অপরিমেয় নিষিদ্ধ আমোদ-প্রমোদে ডুবে থেকে বিশ্রামের নামে ফুলসজ্জা কাটানো হয়! অধস্তন নারীর শরীর নিদারুণ আন্দোলিত করে তোলে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাকে। অতঃপর ভোগ-বাসনার অন্তরঙ্গ ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আর সেই খবর জানতে পেরে অফিসেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে ডিসি অফিসের সহায়ক নারীকর্মী।

ঔপনিবেশিক আমলের যেসব দেশের সংস্কৃতি থেকে এই খাস কামরা নামে অতিরিক্ত আরাম প্রথার প্রচলন এসেছে, সেসব দেশে এখন এটা আর নেই। কিন্তু তথাকথিত বাঙালি শিক্ষিত সমাজ এই প্রথা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে যুগের পর যুগ। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এ রকম কক্ষ কোচিং সেন্টার, এনজিও, প্রশাসন, পরিষেবা, বড় বড় শপিং মল, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, প্রাইভেট ফার্ম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো না কোনো বিভাগে ও শিক্ষকদের গবেষণাগারে আছে। গবেষণাগারে কোনো কাজ হয় না। যদি হতো তবে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ রকম বেহাল দশা হতো না। লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ পরিচালিত জরিপে ৪১৭টি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। চীন, ভারত, তাইওয়ান এবং ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের কথা বাদ দিলাম; এ তালিকায় স্থান পেয়েছে নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বলতে গেলে প্রতিটি শিক্ষকের নিজস্ব গবেষণাগার আছে। তারা সেখানে সারাদিন খাটে, কাজ করে। ছাত্রী পড়ায়। ছাত্রী গবেষণা পেপার নিয়ে সময়-অসময়ে ছুটি বা অছুটির দিনে হাজির হয় ওই গবেষণাগারে। গবেষণাগারে নারী সহকারী থাকে। কী জানি সেখানে জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীর যা করেছেন, তা হয় কি না? আমরা জানি না, কারণ আমাদের জানানো হয় না। যতটুকু প্রকাশ করা হয় ঠিক ততটুকুই মানুষ জানতে পারে। সম্প্রতি পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের অফিস কক্ষের পাশে গোপন কামরায় খাট পাওয়ায় বিক্ষুব্ধ হয়েছে শিক্ষার্থীরা। সেখানে ছাত্রীদের বিভিন্ন প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করা হতো। সুতরাং এগুলো যে প্রায়ই হয় তা আমরা জানি, দেখি এবং শুনি। কোচিং সেন্টারগুলোতে এ রকম কক্ষের জানা-অজানা রসদ গল্প আমরা হরহামেশাই শুনতে পাই। টিভি চ্যানেলে দেখতে পাই।

জামালপুরের ডিসি এবং নারী কর্মকর্তা যা করেছেন, তা আমি দোষের কিছু দেখি না। যৌনতা বা শারীরিক চাহিদা মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রবৃত্তি। যে এই প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে সে মানুষ, যে পারে না সে মানুষরূপী পশু। তাই প্রাকৃতিকভাবে যৌনতাকে অস্বীকার করা মানে নিজের অক্ষমতা বা দুশ্চরিত্রটাকে লুকিয়ে রাখা। ফলে চাহিদা মেটানোর জন্য স্বীয় ইচ্ছায় যে কেউ যখন খুশি যে কারো সঙ্গে মিউচুয়ালি শারীরিক সম্পর্ক করতেই পারে। আইন তো বলেই দিয়েছে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করলে তা অন্যায়। আইন অনুযায়ী স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা অন্যায় নয়। কিন্তু তাই বলে সেই সম্পর্ক পোশাকের বাঁধন খুলে শরীরের চাওয়া-পাওয়া মেটানোর জায়গা হতে পারে না সরকারি অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, গবেষণাগার, কোচিং সেন্টার এবং স্কুল ও মাদরাসার পকেট রুম কিংবা বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এটা অবশ্যই দোষের এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। একে প্রশ্রয় দেওয়া মানে সরকারের আস্থার জায়গাগুলো অনাস্থা ও অনিরাপদ করে তোলা। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি যা বলেছেন সে হিসেবে কোচিং মালিক, গবেষণাগারের শিক্ষক, স্কুলের মাস্টারও দাবি করবেন যে, আমাদের খাস কামরাও বৈধ। আমরা সারা দিন পড়াই, রাত জেগে পরীক্ষার খাতা দেখি, দিনরাত গবেষণা করতে হয়— তাই আমাদের বিশ্রামের জন্য এই রকম একটি কক্ষ অতীব দরকার।

দুঃখের বিষয় হলো, এ দেশের সরকারি কর্মকর্তা এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকদের জন্য ঘর আছে, অফিস কক্ষ আছে, শিক্ষক লাউঞ্জ আছে। এমনকি খোঁজ নিলে জানা যাবে, অফিস কক্ষের পেছনে আবার খাস কামরাও আছে! কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত হল নেই, হলগুলোতে পর্যাপ্ত কক্ষ নেই। স্বয়ংসম্পূর্ণ লাইব্রেরি নেই। বিভাগে সেমিনার কক্ষ নেই। আবাসন সংকটে ব্যাহত শিক্ষার্থীদের সোনালি স্বপ্ন। একান্ত একটি কক্ষে বসে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী পড়াশোনা করবে, ভালো ফলাফলের জন্য নিজেকে গুছিয়ে নেবে এবং নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যাবে নতুন দিনের সূর্যকে বরণ করে নেওয়ার জন্য, সেই রকম কোনো সুযোগ নেই। একজন স্নাতক শিক্ষার্থীকে একটি কক্ষের আশায় তীর্থের কাকের মতো অপেক্ষায় কাটিয়ে দিতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক জীবন। তাকে থাকতে হয় ঢালাওভাবে মেঝেতে চাদর বিছিয়ে, তারপর দুজনের রুমে বারোজনের সঙ্গে। গণরুম কাটিয়ে মিনি গণরুম। মিনি গণরুম কাটিয়ে চারজনের কক্ষ শেয়ার করতে হয় আটজনের সঙ্গে। যখন সে একটি কক্ষ পায় তখন তার বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর সম্মান শেষ। কোনো কোনো শিক্ষার্থী তো রুমই পায় না, মিনি গণরুমেই অতিবাহিত হয় তার লোকদেখানো বর্ণিল বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।

এ মুহূর্তে একজন ডিসির চেয়ে একজন শিক্ষার্থীর জন্য একটি পাঠযোগ্য কক্ষ অনিবার্য। শিক্ষার্থীদের কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো আমলা, মোসাহেব মন্ত্রীদের কথা বলতে শুনি না। কথা বলতে শুনি সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত সরকারি বাসভবনের পাশে ডিসি অফিসে ডিসির বিশ্রামের জন্য কক্ষের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির, স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও খুঁজে পেল না একজন দেশপ্রেমিক নেতা!

 

অরিত্র দাস

লেখক : শিক্ষার্থী, আইন ও বিচার বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads