• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

কোচিং বাণিজ্য ও অভিভাবকদের মানসিক চাপ

  • রহিমা আক্তার মৌ
  • প্রকাশিত ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৯

২০২০ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দেবে কুড়িগ্রামের রাসেল। পরীক্ষার পর কোচিং করতে আসবে রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা শহরের কোচিংয়ের আখড়া হলো ফার্মগেট এলাকা। রাসেলের মা যোগাযোগ করেন আমার সঙ্গে। ফার্মগেটের আশপাশে ভাড়া কেমন, একটা রুম নিতে চায়। রাসেল আর ওর বন্ধু থাকবে। ১৯৯৯ সাল থেকে তেজগাঁও এলাকায় আছি বলে জানাশোনা আছে, সেভাবে রাসেলের মাকে বললাম। একটু খোঁজও নিলাম। অন্য সময় যে রুম ৭-৮ হাজার টাকা মাসে। কোচিংয়ের সেই ৩ মাস একই রুম ১০-১২ হাজার টাকা মাসে। শুধু ভাড়া বেশি তাই নয়, ২-৩ মাস আগেই এসে বুকিং দিতে হবে। এ যেন টাকার কারখানা, অভিভাবকরাও একপ্রকার জিম্মি বাড়ির মালিকদের কাছে। কে না চায় তার সন্তান ভালো কিছু করুক, ভালো কোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করুক। কিন্তু এই উচ্চশিক্ষার নামে আমরা কতটা হতাশ হয়ে পড়ি, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হই তা কেউ বোঝে না।

সাহিদার দুই মেয়ে এক ছেলে। দ্বিতীয় সন্তান মানে বড় মেয়ে এইচএসসি পরীক্ষার পর ওকে উচ্চশিক্ষার জন্যে দুইটা কোচিংয়ে ভর্তি করায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুরসহ সকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি ফরম তোলে। ফরম পূরণ করতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন মূল্য। সাইবার ক্যাপ থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, ৬০০ থেকে শুরু করে এক হাজার ২০০ টাকা দিয়ে ফরম পূরণ করতে হয়। তবে মেডিকেল আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হিসাব আলাদা। যদি ধরে নিই সাহিদা ১৫টা ফরম তুলেছে, তাহলে ফরম জমা দিতে ওর খরচ হবে গড়ে এক হাজার টাকা করে হলেও ১৫ হাজার টাকা। বলে রাখি মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি ১৫ থেকে ১৯ হাজার টাকা। দুটো কোচিংয়ে ভর্তি হতে ৩০ হাজার তো গিয়েছেই। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুর যাবে মেয়ে পরীক্ষা দিতে। সঙ্গে যাবে কে? মেয়ের বাবা যাবে, বাবার সঙ্গে মেয়ে একা যাবে না। সঙ্গে মাকে যেতে হবে। মা যাবে তাহলে তার আরেক কন্যা সন্তান কোথায় থাকবে। তাকেও নিতে হবে। তার মানে দাঁড়াল এক শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষা দিতে যেতে সঙ্গে মোট চারজনের চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুর যাওয়া-আসা, থাকা ও খাওয়া নিয়ে কেমন খরচ হতে পারে? যা হোক, অবশেষে সাহিদার মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইডেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।

যশোর থেকে তিন মা এসেছেন ঢাকায় তিন ছেলেকে নিয়ে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকেন। ফ্ল্যাট ভাড়া ৩০ হাজার টাকা। ছেলেদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে কোচিং করাচ্ছেন। যশোরে আছে কোচিংয়ের শাখা, কিন্তু সেগুলো ভালো নয়। একসঙ্গে তিন মা-ই থাকেন। ছেলেদের খাওয়ার পছন্দ আলাদা। সবার মা সবার জন্য আলাদা পছন্দের রান্না করেন। সব কাজ করেন। কোচিংয়ের সময় ঢাকা শহরের অনেক এলাকার বাসা ও হোস্টেলের ভাড়া দ্বিগুণ, তিনগুণ হয়ে যায়। শুধু কি তাই? কয়েক মাস আগেই এসে বাসা বা হোস্টেল বুকিং দিতে হয়। মালিক পক্ষ যা ধার্য করে তাই দিতে হয়, নইলে রাস্তা মাপো। এই তিন মা তাদের ঘরসংসার, স্বামী আর অন্য সন্তানদের রেখে কয়েক মাসের জন্য রাজধানীতে। উনাদের পাশেই বয়স্ক একজন মহিলা, উনিও একই কাজে এই শহরে। উনি এসেছেন নাতিনের সাথে। মেয়ে চাকরি করে, তাই নাতিনের সঙ্গে আসতে পারেননি। মেয়েজামাই এসে বাসা ভাড়া করে দিয়ে গেছে। এখন উনি অন্যদের সঙ্গে এভাবেই থাকেন।

নোয়াখালী থেকে পাঁচ মেয়ে ডাক্তারি কোচিং করতে আসে। ভাড়া নেয় একটা ফ্ল্যাট। নিয়ম করে ১৫ দিন করে যেকোনো একজন অভিভাবক (মা/খালা/নানি) থাকেন ওদের সঙ্গে। সবার জন্য বাজার করেন, রান্না করেন। অগ্রিম কিছু টাকা দিয়ে ফান্ড তৈরি আছে সেখান থেকে খরচ করা হয় যা সবার সমান হবে। একজন ছোট একটা ফ্রিজও নিয়ে আসে। এতে করে বাজারের অনেক সুবিধে হয়। ওদের ফ্লাটে গেলাম একদিন, ভবনটির কাজ এখনো শেষ হয়নি। ৪ থেকে ৮ তলার ফ্লাটের ভেতরের কাজ সম্পন্ন করে এমন কোচিংয়ের জন্যে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। লিফট তো দূরের কথা, সিঁড়ির কাজ হয়নি কিছুই। সিঁড়িতে প্লাস্টারও করা হয়নি, রেলিং যুক্ত করা হয়নি। সিঁড়িঘরে কোনো লাইটিংয়ের ব্যবস্থা নেই, অনেক রড এলোমেলো ভাবে। ৪-৫-৬ তলায় মেয়েরা থাকে। ৭-৮ তালায় থাকে ছেলেরা। জানি না শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কতটুকু ছিল। আমি ৬ তলায় সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে যেমন ভয় পাই, তেমনি অসুস্থ হয়ে পড়ি। চার মাস পর ওরা ফ্ল্যাট ছেড়ে দেয়। অবাক বিষয়, বাড়ির মালিক চার মাসের ভাড়া আগেই একসঙ্গে অগ্রিম নিয়েছে।

রাজধানী ঢাকা শহরে উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন সেক্টরে ভর্তি বাণিজ্য এখন রমরমা। যার অন্তরালে কোচিং বাণিজ্য কাজ করছে। আর করবেই না কেন? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই তো শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কোচিংনির্ভর করে তুলেছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষকও যে যুক্ত তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সুতরাং এ রকম উদাহরণ ভূরি ভূরি দেওয়া যাবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা জারি করে। তবে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করেনি। সাড়ে ছয় বছর পর গত ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য, কোচিংয়ে শিক্ষকদের বেপরোয়া আচরণের কারণেই ২০১১ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের অভিভাবক মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউল কবির দুলু উচ্চ আদালতে রিট করেন। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে নীতিমালা করেই দায়িত্ব শেষ করে। নীতিমালা জারির পর গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-টিউশন নিতে হচ্ছে। আর ৪ বছরের মাথায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানা আয়-ব্যয় সমীক্ষায় (২০১৬) বলা হয়েছে, শিক্ষার পেছনে একজন অভিভাবকের মোট আয়ের ৫ দশমিক ৪২ ভাগ ব্যয় হয়। শিক্ষার পেছনে অভিভাবকের ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত কোচিং যা ৩০ শতাংশ।

এ তো হলো স্কুল কোচিংয়ের হিসাব। উচ্চশিক্ষার কোচিং ও ভর্তি পরীক্ষার খরচের হিসাব আরো মহামারি আকার ধারণ করেছে তা আমরা ওপরের কয়েকটা ঘটনা থেকেই বুঝতে পারি। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ তো করতেই হবে, কিন্তু এই মহামারি খরচ কমাতে আমাদের করণীয় কী? সন্তান কোন বিভাগে পড়লে ভালো করবে তা আগেই অভিভাবকদের ঠিক করতে হবে, অবশ্যই তার মেধার ওপর নির্ভর করে। সে হিসাবে আপনি কোচিং করাবেন। অতিরিক্ত হলে ৩-৪টা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ফরম তুলবেন। যে জেলায় আছেন তার বাইরের জেলায় পড়াতে অপরাগ হলে সেসব জেলা থেকে ফরম তুলবেন না, পরীক্ষাও দিতে যাবেন না। কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় সব কোচিং সেন্টারগুলোর মান একই রকম হতে হবে। আর বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে আবেদন আপনারা একই দিনে একই বিষয়ের পরীক্ষা বিভিন্ন জেলায় দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। তাহলে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো অতিরিক্ত খরচের হাত থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাবে। মনে রাখতে হবে জাতির মেরুদণ্ড সোজা করতে গিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মেরুদণ্ড বাঁকা করার অধিকার কারোর নেই। আইন জারি নয়, বাস্তবায়ন হবে এটাই কাম্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads