• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

শিক্ষায় এনজিওগুলোর কাজের ক্ষেত্র কি কমে যাচ্ছে

  • মাছুম বিল্লাহ
  • প্রকাশিত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

গত দশ বছরে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে প্রাথমিক শিক্ষার বেশিরভাগই সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির পাশাপাশি মিড-ডে মিল চালু করা হয়েছে। সরকারি বিদ্যালয়ের বাইরে রিস্কসহ বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায়ও বিদ্যালয় চালু করা হয়েছে। সরকারের এসব উন্নয়নের ফলে এনজিও পরিচালিত স্কুলগুলোর প্রয়োজনীয়তা কমে এসেছে বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে। পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষার্থী না পাওয়ায় অনেক সরকারি বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রাথমিক শিক্ষার সাবেক ডিজি। ২০১৩ সালে দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ১ লাখ ৬ হাজার ৮৫৯টি এবং শিক্ষার্থী ছিল ১ কোটি ৯৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭২ জন। আর ডেইলি স্টারের তথ্যমতে, ১৭ নভেম্বর ২০১৮-এর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি মিলে সারা দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯০১টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার ৩৫০ জন। গড়ে একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১২৯ জন। প্রতি ১ হাজার ১৯৫ জন লোকের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে ছাত্রসংখ্যা ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৩৮ এবং ছাত্রীসংখ্যা ৮৭ লাখ ৪৩ হাজার ৩১২।  এ শিক্ষার্থীদের পাঠদানে নিয়োজিত ৬ লাখ ২৩ হাজার ৯৬৪ জন শিক্ষক। মোট শিক্ষকের ৬২ শতাংশই নারী। অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ২৮। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থীও আছে আবার তিন হাজারও আছে। বোঝাই যাচ্ছে কত অপরিকল্পিতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এসব বিদ্যালয়।

দেশে সাক্ষরতার হার যখন ২০-৩০ শতাংশ ছিল, সরকার যখন শিক্ষার আলো সর্বত্র পৌঁছাতে পারছিল না, বিশেষ করে চর, হাওর, বাঁওড়, পার্বত্য অঞ্চলে তখন নন-ফরমাল প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতে এবং বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিতে এনজিওগুলো প্রত্যক্ষ ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। সরকারের নানামাত্রিক প্রচেষ্টা, এনজিওগুলোর তৎপরতা, গ্লোবালাইজেশনের ঢেউ মানুষের সচেতনতার স্তরকে এক ভিন্নমাত্রায় উন্নীত করে  শিক্ষাক্ষেত্রে  পরিবর্তন  নিয়ে এসেছে। এখন বিদ্যালয়মুখী শিক্ষার্থীর হার ৯৮ শতাংশে পৌঁছে গেছে। এই পজিটিভ অর্জন সম্ভব হয়েছে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর নানামাত্রিক প্রচেষ্টার ফলে। তবে মানসম্মত শিক্ষা থেকে আমরা এখনো বহু দূরে। প্রাথমিক স্তরে যে শ্রেণি পাস করে যে দক্ষতা অর্জন করার কথা ছিল তা থেকে শিক্ষার্থীরা বহু দূরে অবস্থান করছে যা বিভিন্ন গবেষণা ও আমাদের সাধারণ পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞাতার দ্বারা প্রত্যক্ষ করছি। একইভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের যে শিখনফল অর্জন করার কথা ছিল, তারাও তা থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।

এর প্রধান একটি কারণ হচ্ছে সব স্তরের শিক্ষার্থীদের অ্যাসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন করা হয় এক গৎবাঁধা ও পাতানো খেলার মাধ্যমে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও কোচিং সেন্টার সবাই ওই গৎবাঁধা এবং পাতানো কৌশল ধরে ফেলায় শিক্ষার্থীদের পাসের হার ও উচ্চ গ্রেড প্রাপ্তির হার হু হু করে বেড়ে শতভাগের কাছাকাছি এসে গেছে। বোঝানো হচ্ছে সংশোধনের বা আরো ভালো করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু অবস্থা যে এর পুরো উল্টো অর্থাৎ হাইব্রিড পাসের ও গ্রেড প্রাপ্তির ফলে শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা বা শিখনফল অর্জন করছে না এবং করার চেষ্টাও করছে না, সেই দিকটি অবহেলিত বা উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে। কারণ গ্রেডপ্রাপ্তি শতাংশের চূড়ায় পৌঁছে গেছে আর তাতেই সবাই কৃত্রিম হাসি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করছে। তবে এখানেই এনজিওগুলোর কাজের সুযোগ রয়েছে প্রচুর। সরকার ও এনজিওগুলো মিলে যে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ও সাক্ষরতার হার প্রায় কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, একইভাবে উভয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে অর্থাৎ প্রকৃত মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের এনজিওগুলোর কয়েকটি সবল দিক রয়েছে, যেমন— নিষ্ঠাবান কর্মী, কোনো বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, দ্রুত কোনো কিছু করার সক্ষমতা, বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের ভালোবাসা ও বিশ্বাস। এনজিওগুলোর সক্ষমতা, যোগ্যতা ও সব ধরনের স্ট্রেংথকে প্রকৃতঅর্থে কাজে লাগাতে পারলে দেশ উপকৃত হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি সরকারি বিধায় তাদের আর্থিক সঙ্গতি অর্জিত হয়েছে; তবে বিদ্যালয় ভবন আছে কিন্তু নেই প্রকৃত পড়াশোনা। টার্মিনাল কম্পিটেন্সি থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে শিক্ষার্থীরা। সঠিকভাবে বিভাজন করে নিলে কোনো এলাকায় এনজিও, কোনো এলাকায় সরকার, কোথাও যৌথভাবে আবার কোথাও পুরোপুরি বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। একই কথা মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৭ শতাংশই বেসরকারি পর্যায়ে পরিচালিত হয়, যদিও বেসরকারি বিশাল এক অংশ এমপিওভুক্ত হওয়ায় সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। এই বিশাল অংশে মানসম্পন্ন ও সৃজনশীল শিক্ষা কার্যক্রম সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যৌথভাবে কিংবা পারস্পরিক আলোচনা ও চুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হতে পারে।

তবে এনজিওগুলোর কিছু সমস্যা আছে, যেমন— বিদেশ থেকে পড়ে আসা কম বয়সি কোনো প্রার্থীকে ভীষণ অগ্রাধিকার দেওয়া। তাকে যে কাজের জন্য নেওয়া হয়েছে, সে তার কিছু বুঝুক আর না-ই বুঝুক, তাকে উচ্চতর বেতন দিয়ে চাকরিতে ঢোকানো হয়। আর চাকরিতে ঢোকার পরেই সে অন্যান্য চাকরি খোঁজার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খুঁজতে থাকে চাকরি, পেয়েও যায়। সে যে প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছে, যেখানে কিছু দেওয়া বা ওন করার মতো সময় সে পায় না। এনজিওগুলোকে সে এমন কোনো মডেলও দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না, ফলে এনজিওগুলো লোকসানের মুখে পড়ে। বেশি বেতনে এসব অনভিজ্ঞ লোক নিয়ে কাজও হয় না, হয় শুধু অর্থব্যয়। এনজিওগুলোর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে নতুনত্বের নামে, ইনোভেশনের নামে জগাখিচুড়ি পাকানো। ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে সার্জনের কাজ করানো, ডাক্তারদের দিয়ে বিল্ডিং তৈরি করানো আর ব্যবসায়ীদের দিয়ে শিক্ষাদান করার মতো অতি ইনোভেটিভ আইডিয়া চালু করা। একজন সার্জন অপারেশন করে করে যখন একজন দক্ষ সার্জনে পরিণত হয়, তখন তার দ্বারা সার্জারি না করিয়ে অন্য কিছু করায় কিংবা তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। অভিজ্ঞতার যেন কোনো মূল্যই নেই। ইঞ্জিনিয়ারদের দ্বারা নতুন উপায়ে সার্জারি করানো শুরু করে, কারণ ইঞ্জিনিয়াররা হচ্ছেন বুদ্ধিমান। তাদের বুদ্ধি দিয়ে এনজিওগুলো নতুনভাবে সার্জারি করিয়ে নতুনত্ব নিয়ে আসতে চায়। ব্যবসায়ীদের দ্বারা শিক্ষা আর শিক্ষার লোকদের দিয়ে ব্যবসা করানোর এক ধরনের কালচার এনজিওগুলো সৃষ্টি করতে চাচ্ছে ইদানীং। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। তাই এনজিওগুলো তাদের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলে এবং সরকারের আমলাতন্ত্রিক জটিলতায় কিছুট হ্রাস টানতে পারলে দেশের শিক্ষা সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে। এই ফলপ্রসূ যৌথ প্রচেষ্টা শিক্ষা জগতে নিয়ে আসতে পারে এক নতুন সকাল।

সরকার শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বহু আবদার মেটাচ্ছে, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করছে, অর্থ ব্যয় করছে; কিন্তু শিক্ষার মান যেন কোনোভাবেই বাড়ানো যাচ্ছে না, কোনোভাবেই শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল করা যাচ্ছে না। যদিও সৃজনশীলতা তাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে, তা প্রকাশ করার মতো পড়াশোনা বা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা আমরা করতে পারছি না। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন ‘ছায়া শিক্ষা’র দিকে, আর এর যৌক্তিক কারণও আছে। এখানে এনজিওগুলোর সহযোগিতা নিলে শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে, বঞ্চিতরা সুবিধা পাবে, মানসম্পন্ন শিক্ষা উপহার দেওয়া যাবে দেশকে, দেশ হবে উপকৃত।

 

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads