• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

ভেজালপ্রবণতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি

  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৯

হাদিউল হৃদয়

 

 

ভেজালপ্রবণতা একটি গুরুত্বপূর্ণ অপরাধ। ভেজাল বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে আজকাল। আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থেই বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। সারা দেশে প্রায় সব বাজারে বিভিন্ন সেবা ও পণ্যে ভেজালের হিড়িক পড়ে গেছে। বিশেষত খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের কারণে ভোক্তা জনসাধারণের অসুখ-বিসুখ লেগেই আছে। যদিও খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার প্রবণতা নতুন না হলেও ইদানীং এ অপরাধ অত্যন্ত ভয়ংকর ও বহুমাত্রিক রূপলাভ করেছে। মানুষের বেঁচে থাকার প্রাথমিক মৌলিক শর্তের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে খাদ্য। এ খাদ্যে এত বহুমুখী ও বিপজ্জনক ভেজাল মেশানো হয় যে, আমাদের কারোর পক্ষেই এর ভয়াবহ কবল থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব নয়।

ডাল-চাল ইত্যাদি শস্যজাতীয় খাদ্যে নিম্নমানের শস্য মেশানো অনেক পুরনো একটি সমস্যা। শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি কোনো কিছুই আজকাল বিপজ্জনক ভেজাল দ্রব্যের আওতামুক্ত নয়। আলু-পটোলসহ অনেক ধরনের সবজি সংক্ষরণের জন্য ব্যবহূত হয় ক্ষতিকর কীটনাশক। বিশেষ করে শাক-সবজি সবুজ দেখানোর জন্য রাসায়নিক রং স্প্রে করার বিষয়টি সবার জানা আছে। অপরিপক্ব ফল যেমন— আম, জাম, পেঁপে, কলা ইত্যাদি নিমিষেই পাকিয়ে ফেলার জন্য কৃত্রিম হরমোন স্প্রে করা হয়ে থাকে। সুতরাং বাজারে গেলে আমরা যে বাহারি ফলমূল দেখি, তার অনেকগুলোই আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।

সম্প্রতি আমিষ জাতীয় খাদ্য মাছ-মাংস নিয়েও বিপজ্জনক খেলা শুরু হয়েছে। প্রথমে মাংস নিয়ে— গরুর মাংসের সঙ্গে মহিষের মাংস মিশিয়ে বিক্রি করা নতুন কিছু নয়, পুরনো একটি বিষয়। কিন্তু ইদানীং খাসির মাংসের সঙ্গে কুকুরের মাংস মেশানোর মতো জঘন্য ঘটনার খবরও পাওয়া গেছে। বিশেষ করে মাংস টাটকা দেখানোর জন্য মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক রং। ফলে সাধারণ ক্রেতাকে ভেজালমুক্ত খাবার কেনা নিয়ে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।

আবার মাছের বাজার। এখন গ্যাস, ট্যাবলেট ও ইন্ডিয়ান কেরোসিন দেওয়া মাছের আমদানি প্রায়ই দেখা যায়। সাধারণ ক্রেতারা বুঝতে না পেরে বিষ দেওয়া মাছ কিনে রান্না করে খাচ্ছেন। কেউ কেউ খাওয়ার সময় বুঝতে পারেন এটা গ্যাস বা বিষ দিয়ে মারা মাছ; কিন্তু অধিকাংশ মানুষই না বুঝে এই বিষ খাচ্ছেন। ততক্ষণে আর উপায় থাকে না কিছু করার। এ ছাড়া পুকুরে খালে দূষিত দ্রব্য দিয়ে চাষ করা মাছ দেদার বিক্রি চলছে খোলা পানির মাছ বলে। উপরন্তু বিভিন্ন বাজারে দুধের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও তাতে ভেজালের মিশ্রণ সিংহ ভাগ। বাজারে আসা দুধের মধ্যে বেশিরভাগ দুধই পানি মেশানো। সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ কালেভদ্রে এটা পরীক্ষা করে থাকে। ফলে বাজারে খাঁটি ও নির্ভেজাল দুধ পাওয়া দুষ্করই বটে।

হোটেল-রেস্টুরেন্টে ভেজাল খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য আরেক মারাত্মক হুমকি। এগুলোতে কতরকম ভেজাল যে চলছে তা বলার উপায় নেই। তাদের থালা-বাটি, গ্লাস-গামলা সবকিছুই অপরিষ্কার ও অপরিচ্ছন্ন। বিশেষ করে হোটেলগুলোর রান্নাঘরের দিকে তাকানো যায় না— এত নোংরা ও খারাপ গন্ধ। এসব হোটেলে ভাত, মিষ্টিসহ নানা ধরনের খাবার দ্রব্য প্রায়ই খোলা বা উন্মুক্ত রাখা হয়— উদ্দেশ্য ক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মরা মুরগির মাংস, বাসি-পচা খাবার, নিম্নমানের তেল-মশলা প্রভৃতি রেস্টুরেন্টের ভোক্তাদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ। 

ওদিকে আবার ওষুধের দোকানগুলোতে ভেজালযুক্ত ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে হরহামেশা। ওষুধের প্রকৃত মূল্য অনুসরণ না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রাহক ঠকিয়ে বেশি দাম নেওয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন কথা উঠেছে ওষুধের প্রতিটি পাতায় মূল্য সংযোজনের। সাধারণ মানুষ যাতে সহজেই বুঝতে পারে ওষুধের প্রকৃত দাম। এ ছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস ও খুচরা যন্ত্রপাতির দোকানে বিভিন্ন ধরনের নকল ব্র্যান্ডের জিনিস আসল বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

মানুষের প্রাথমিক মৌলিক খাদ্য নিয়ে এই বিপজ্জনক ভেজালপ্রবণতা সমাজ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত মুনাফা লাভের সহজ কৌশল অবলম্বনের জন্য একশ্রেণির মানুষ নির্দ্বিধায় খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে দেশজুড়ে জনস্বাস্থ্যকেই ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। মূলত সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয়ই এর প্রধান কারণ। পাশাপাশি আইনের উদাসীনতা তথা কঠোর প্রয়োগ না থাকায় এ ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ।

যদিও ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ সালে পাস হয়েছে কিন্তু এটির কোনো কার্যকারিতা নেই বললেই চলে। কালেভদ্রে বাজারগুলোতে প্রশাসনিক ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হলেও ভেজাল ও নকলের লাগাম টানা যাচ্ছে না কিছুতেই। খাদ্যে ভেজাল যেহেতু একটি সর্বাত্মক সামাজিক ব্যাধি, তাই সরকার বা কোনো বাহিনীর পক্ষে এককভাবে এর সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য অবশ্যই সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনা করে ভেজালমুক্ত খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অব্যাহত সামাজিক আন্দোলনই কেবল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।

 

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads