• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

রোহিঙ্গা সমস্যা কোনোভাবেই জিইয়ে রাখা উচিত হবে না

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০১৯

মিয়ানমারের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর যুগের পর যুগ ধরে অত্যাচার চালিয়েছে মিয়ানমার সরকার। তাদের বাড়িঘর, জমিজমা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়েছে তাদের ঘরবাড়ি, প্রার্থনালয়, বিদ্যাপীঠ। ১৯৮২ সালের বার্মিজ নাগরিকত্ব আইনে তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেছে।

পরিস্থিতি অসহনীয় হয়ে উঠলে ২০১৭ সালে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী টেকনাফ বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে এই বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়। তাদের থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করে। এ কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ উপাধি দেওয়া হয়।

২০১৭ সালের আগেও বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কিছু রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে উখিয়া, টেকনাফ ও কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু বড় ঢল নামে ২০১৭ সালে। প্রথম অবস্থায় স্থানীয় জনগণও তাদের প্রতি অকাতরে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ১১ লাখ। দুই বছর ধরে তারা এদেশে আছে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দেওয়ার জন্য দেশি-বিদেশি বহু সংগঠন কক্সবাজারে কাজ করছে। তবে ঘটনা যাই-ই হোক, চাপটা কিন্তু বাংলাদেশের ওপরই পড়ছে। এই ১১ লাখ বাড়তি জনসংখ্যার জন্য সরকারকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাড়তি সমস্যা। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। মাদকের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। প্রতিদিনই এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে নতুন শিশুর জন্মগ্রহণের মাধ্যমে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্ক আর অনিয়ন্ত্রিত বিবাহের ঘটনা ঘটছে।

ফলশ্রুতিতে কক্সবাজার, টেকনাফ এলাকার জনসাধারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশগতভাবে বিভিন্ন রকম হুমকির মধ্যে রয়েছে। পাহাড়, জলাভূমি, বনজ সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখা দিচ্ছে পানি সংকট। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে জীবনের ভীতির মধ্যে ছিল, সেখানে এদেশে তারা আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করছে। কারণ শুধু বাংলাদেশ সরকারই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত অসংখ্য এনজিওর মাধ্যমে তারা পাচ্ছে খয়রাতি সাহায্য। এনজিওগুলোও তাদের দিয়ে ব্যবসা করছে। ফুলে-ফেঁপে উঠছে তারা। বিশ্বব্যাংক, ইউনিসেফসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংস্থার অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী এখানে কাজ করছে।

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র কক্সবাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। তারা ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। জড়িত হচ্ছে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে। স্বাধীনতাবিরোধী কোনো কোনো চক্র রোহিঙ্গাদের সরকারবিরোধী উসকানি দিচ্ছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এদেশ ছেড়ে যাতে তারা মিয়ানমার না যায়, সে বিষয়ে একটা চত্রু তৎপর রয়েছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের জন্য অস্ত্র বানানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। ইতোমধ্যে নানা অভিযোগে ৪১টি এনজিওকে ক্যাম্প এলাকা থেকে প্রত্যাহারও করা হয়েছে।

দেশের স্বার্থেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বেশ কয়েকটি উদ্যোগ কার্যকর করা যায়নি। গত ২২ আগস্ট আরেকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে সম্মত হলেও প্রত্যাবাসন শুরু করার প্রাক্কালে তারা বেঁকে বসে। একজন রোহিঙ্গাও সেদিন ফেরত যায়নি। শুধু তাই-ই নয়, ২৫ আগস্ট কুতুপালং ক্যাম্পে তারা বিশাল শোডাউনও করে। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, নাগরিকত্ব প্রদানসহ তাদের উত্থাপিত পাঁচটি দাবি মিয়ানমার সরকার না মানলে তারা ফেরত যাবে না।

বাঙালি অতিথিপরায়ণ জাতি। এটা বাঙালির ঐতিহ্য। নিজে না খেয়ে তারা অতিথির পাতে খাবার তুলে দেয়। তাই তাদের প্রতি নির্যাতন-নিপীড়ন ও তাদের অসহায়ত্ব প্রত্যক্ষ করে অতিথিজ্ঞানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল। কিন্তু যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে একসময় মানবিক কারণে এদেশে আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, তারা এখন বিষফোঁড়ার মতো জ্বালাচ্ছে। ১১ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে প্রায় ১০ লাখেরই হাতে অবৈধ সিমকার্ড রয়েছে। অসুস্থ, অন্ধ ও শিশু ছাড়া প্রতিটি রোহিঙ্গার হাতে মোবাইল আছে। আর তাতে একাধিক সিমও আছে। কারো কারো হাতে একাধিক মোবাইল। প্রতিটি মোবাইলে গড়ে দুটি করে সিম। এই সিম দিয়ে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি মিয়ানমারসহ বহির্বিশ্বে জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। তারা মোবাইলের মাধ্যমে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, খুনের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকম গুজব ছড়িয়ে তারা রোহিঙ্গাদের উত্তেজিত করছে। প্রত্যাবাসনে আগ্রহী বাঙালিদের মধ্যেও একই উপায়ে বিভেদ-বিভাজন সৃষ্টি করছে তারা। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায়ও অংশ নিচ্ছে। ফেসবুক, ইন্টারনেটের মাধ্যমে নানা রকম গুজব ছড়াচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে-রোহিঙ্গারা এই সিম পেল কী করে? কে তাদের এই সিম সরবরাহ করছে? তাদের আইডি নেই। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাহলে তারা সিম পেল কী করে? এর উত্তর খুবই সোজা। একশ্রেণির অসাধুু ব্যবসায়ী তাদের এই সিমগুলো দিচ্ছে আইডি ও বায়োমেট্রিক ছাড়াই। কেউ কেউ নিজেদের বায়োমেট্রিক করা সিম এদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন সিম বিক্রেতা গ্রেপ্তারও হয়েছে। এই সিমগুলো এই দেশের বিরুদ্ধেই যাচ্ছে। সিমগুলো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গারা অনেকেই আইডি কার্ড পেয়ে গেছে নির্বাচন কমিশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বদৌলতে। সম্প্রতি এমন একজন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাত্র দুই বছরে রোহিঙ্গাদের হাতে অবৈধ আইডি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে সে অর্থের পাহাড় গড়ে ফেলেছে।

রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যেও বিরোধ রয়েছে। ক্যাম্পে অবস্থানকারীদের মধ্যে কিছু লোককে অন্যরা ‘বেঈমান’ বা ‘কাফের’ বলে। তাদের ধারণা, এই লোকগুলো মোবাইলের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তারা মিয়ানমার সরকারের চর। এই লোকগুলোকে যারা নজরদারিতে রেখেছে তাদেরকে অনেকে ‘সন্ত্রাসী’ বলছে। মূল কথা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যেও অন্তর্কোন্দল রয়েছে। গত দুই বছরে এই কোন্দলে ৪৫ জন নিহত হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা, নারী পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য মামলা হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আর রোহিঙ্গাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। কিছুদিন আগে যুবলীগের একজন কর্মী রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিহত হন। গত দুই বছরে এই ইস্যুতে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি।

পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিদ্যুৎ নেই, চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত রাস্তাও নেই। ক্যাম্পের ভেতরে চওড়া কিছু রাস্তা আছে সেনাসদস্যদের চলাচলের জন্য। দুর্গম পাহাড়গুলোতে ওঠার জন্য বালির বস্তা ফেলে আর বাঁশ পুঁতে রাস্তা করা হয়েছে। সোলার বাতিরও কিছু ব্যবস্থা হয়েছে। তার পরও সে পথ দুর্গম। দিনের বেলা ক্যাম্পের চেহারা শান্ত দেখা গেলেও রাত হলেই ক্যাম্পে শুরু হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। কারণ ক্যাম্পের মধ্যে সন্ত্রাসী কাজ করে পালিয়ে যাওয়া খুব সহজ। ক্যাম্পে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু সেই নিরাপত্তা রোহিঙ্গারা কতদিন মানবে-এ বিষয়ে সাধারণ মানুষ সন্দিহান। অনেকে বলছেন, সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ক্যাম্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব রোহিঙ্গারাই নিজ হাতে তুলে নেবে।

আশঙ্কার কথা এটাই যে, উখিয়া ও টেকনাফ এলাকায় এখন স্থানীয় জনগণের চেয়ে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশি। স্থানীয় জনগণ শঙ্কিত এই ভেবে, একদিন না তাদের বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে চলে যেতে হয়। অন্যদিকে এনজিও কর্মীরাও ভীত এই ভেবে যে, এখন না হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভালো সাহায্য-সহযোগিতা দিচ্ছে, তারা সহযোগিতা কমিয়ে দিলে রোহিঙ্গারা তো মারমুখী হয়ে উঠবে। বিপরীত দিকে স্থানীয় জনগণ এনজিওগুলোর ওপর অসন্তুষ্ট এজন্য যে, রোহিঙ্গারা যা চাচ্ছে তাই পাচ্ছে। এমন হলে তো কোনো দিনই তারা এ মাটি ছেড়ে যাবে না। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। এই পরিমাণ টাকা বাংলাদেশের পক্ষে বেশিদিন খরচ করা সম্ভব নয়। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও আস্তে আস্তে সাহায্য-সহযোগিতা কমিয়ে দেবে, এটাই স্বাভাবিক।

এহেন অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আর সেজন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মিয়ানমার সরকারের ওপর অবিরাম চাপ সৃষ্টি করা। চাপ সৃষ্টি করা এজন্য যে, তারা যেন রোহিঙ্গাদের যথাযথ মর্যাদা তথা নাগরিকত্ব দিয়ে নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং সেটা যত দ্রুত সম্ভব। এ জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করা প্রয়োজন। এ সমস্যা আর কোনোভাবেই জিইয়ে রাখা উচিত হবে না।

 

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক যুগ্ম সচিব

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads