• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ দুরারোগ্য চিকিৎসায় রাষ্ট্রীয় সাহায্য

  • মাহমুদুল হক আনসারী
  • প্রকাশিত ১৪ অক্টোবর ২০১৯

প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা সরকারি-বেসরকারিভাবে সাধ্যের মধ্যে চলছে। যাদের পক্ষে অর্থ বিনিয়োগ করে শিক্ষা ও চিকিৎসা গ্রহণ করার মতো সামর্থ্য আছে তাদের কথা বলার উদ্দেশ্য নয়। বিশাল জনগণের এদেশ; এখানে ধনী, দরিদ্র, হতদরিদ্র অসংখ্য মানুষের বসবাস। যারা দৈনন্দিন কর্ম করে আয়-রোজগারের মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের পক্ষে জটিল কঠিন দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা গ্রহণ করা সোনার হরিণের মতো। দেশে চিকিৎসা ও শিক্ষাকার্যক্রম দিন দিন অগ্রসর হলেও দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য তা দুষ্প্রাপ্য। অর্থ আছে তো শিক্ষা আর চিকিৎসা মিলবে। অর্থ যার নেই তার জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা কোনোটাই নেই। এটা বাস্তব এবং সত্য কথা। তাহলে দেশে যে পরিমাণ আধুনিক উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে উঠছে সেখানে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণি ছাড়া অপরাপর মানুষ অর্থকষ্টে চিকিৎসা নিতে পারছে না। শিক্ষার ক্ষেত্রেও মুষ্টিমেয় কিছু শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখার সুযোগ পায়; অন্যরা হয়তো ঝরে পড়ে অথবা বাড়ির ভিটা বিক্রি করে বেসরকারি কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতে হয়। কিন্তু এটা অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী পরিবারের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে ঝরে পড়া যুবকরা হতাশায় নানা সমাজবিরোধী, রাষ্ট্র পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যায়। হয়ে পড়ে তারা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের আশঙ্কা।

একইভাবে যাদের কঠিন জটিল রোগের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার সামর্থ্য থাকে না, তারা ধুঁকে ধুঁকে মরণের দিকে ধাবিত হয়। তখন রোগীর সহায়-সম্বল, পরিবার সব নিঃশেষ হয়ে পড়ে। রোগীর পরিবার-পরিজন সন্তানাদি থাকলে তখন তারা সম্পূর্ণভাবে নিঃস্ব হয়ে যায়। সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে দুঃখ ও বেদনাদায়ক আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। রোগ-ব্যাধি এটা কাউকে বলে-কয়ে আসে না। কার কখন কী রোগ হয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না। বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা কর্মকাণ্ড, খাদ্য গ্রহণ ও ত্যাগসহ সামাজিক নানা নিয়ম-অনিয়মের কারণে দেশে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ জটিল রোগের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ পরিস্থিতির নানা কারণে এসব রোগ-ব্যাধির জন্ম হচ্ছে। সুতরাং রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রকেও এসব জটিল রোগীর চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে। রাষ্ট্র যেভাবে জনগণের জন্য নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করে থাকে, অনুরূপ জটিল রোগীদের চিকিৎসাপ্রাপ্তি সহজ ও আর্থিক সাহায্যের অনুকূলে রাখাও দরকার। দেশে রাজধানীসহ বেশ কয়েকটি জেলা শহরে দুরারোগ্য ও কঠিন রোগের চিকিৎসাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা নেওয়ার মতো দেশের কয় পার্সেন্ট মানুষের সামর্থ্য আছে সেটা রাষ্ট্রকে চিন্তা করতে হবে। সরকারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যদি কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তার জন্য দেশে ও বিদেশে প্রচুর অর্থ খরচ করতে দেখা যায়। হয়তো তিনি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদের মানুষ। তাই তার জন্য এত প্রাপ্তি। কিন্তু যিনি এ দেশের নাগরিক, যার ভোটে নির্বাচিত হন একজন সংসদ সদস্য এবং সরকার, সে নাগরিকের চিকিৎসাপ্রাপ্তি কতটুকু রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারল সেটাও সরকারকে গভীরভাবে ভাবা দরকার। তাদের জন্য কতটুকু চিকিৎসা ও উচ্চতর শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন করা গেল তা গুরুত্বসহকারে ভাবার বিষয়।

দেশের গ্রামগঞ্জেরর হাজারো মানুষ চিকিৎসার অভাবে শয্যাশায়ী হয়ে বছরের পর বছর মৃত্যুর প্রহর গুনছে। গ্রাম এলাকায় যেসব চিকিৎসা বর্তমানে প্রচলিত আছে সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসায় পাওয়া যায়। উন্নত চিকিৎসা গ্রহণ করতে হলে একজন রোগীকে শহরে আসতে হয়। আর শহরে আসা-যাওয়া এবং চিকিৎসা নেওয়া দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে পড়ে না। রাষ্ট্রের অনেকগুলো উন্নয়ন খাতে লাখো কোটি টাকা খরচ করা হয়। সে ক্ষেত্রে দুরারোগ্য রোগীদের চিকিৎসায় একটা বাজেট রাখা যেতে পারে। তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সহজতর চিকিৎসাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা যেতে পারে। যেভাবে সরকারি চিকিৎসায় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন গোষ্ঠী বা শ্রেণির জন্য সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে, সে ধরনের সুযোগ যেন এ দেশের গরিব-দুঃখী ও অসামর্থ্য রোগীদের জন্য রাখা হয়। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সামর্থ্যহীন রোগীদের যেন চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাষ্ট্র ইচ্ছা করলে তার নাগরিকের কঠিন রোগের চিকিৎসা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশে বড় বড় রোগের জন্য রোগীকে আর্থিক সাহায্য ও চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছে। আমাদের দেশে দু-একটি সংস্থা অনেক আবেদন-নিবেদনের পর  দু-একজনকে সামান্য সাহায্য দিতে দেখা যায়। কিন্তু এটা বলার মতো কোনো সাহায্যের মধ্যে পড়ে না। একজন  কিডনি রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা। তাকে যদি ৫০ হাজার টাকার সাহায্য দেওয়া হয় সেটা কোনো হিসাবের মধ্যে পড়ে না। এ জাতীয় জটিল রোগীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে চিকিৎসা ও অর্থপ্রাপ্তি থাকা চাই।

রাষ্ট্রের নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষ যেভাবে অর্থের জোরে চিকিৎসা এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে, তাকে আরো সম্প্রসারণ ও সহজলভ্য করতে হবে। দেশের আপামর জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষা ও চিকিৎসাকে জনগণের নাগালে আনতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও চিন্তা-চেতনায় আরো গতিশীলতা আনতে হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য যেভাবে পাচ্ছেন, সে অধিকার রাষ্ট্রের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নিশ্চিত হওয়া চাই। তবেই রাষ্ট্রকে সব মানুষের জন্য কল্যাণকর ও উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা যাবে। দেশ আজকের দিনে যে পরিমাণ উন্নয়ন অগ্রগতির দাবি করছে, সে সুফল বাস্তবায়ন করতে হলে সর্বজনীন চিকিৎসা ও শিক্ষার অগ্রগতি ঘটাতে হবে।

  

লেখক : প্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads