• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

এখন গোটা বিশ্বেই আছে বিশুদ্ধ পানির সংকট

  • আবদুল হাই রঞ্জু
  • প্রকাশিত ১৫ অক্টোবর ২০১৯

পানির অপর নাম জীবন। শৈশব থেকেই মানুষ এই আপ্তবাক্য জেনেছে জ্ঞানবাহন বইয়ের মাধ্যমে। অথচ জীবন ধারণের এই প্রয়োজনীয় হিস্যাটুকু মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে এখন পৃথিবীর প্রতিটি জনপদের মানুষকে। মূলত আমাদের চারপাশের পরিবেশদূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন এর অন্যতম প্রধান কারণ। আর এর জন্য মানুষই দায়ী। তাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণ, গ্রিনহাউজ ইফেক্ট, বনায়ন ধ্বংস, নদী ভরাট ইত্যাদির কবলে পড়ে এখন বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে।

পানি ব্যতীত মানুষ বাঁচতে পারে না। এ জন্য বলা হয়, পানির ওপর নাম জীবন। পানি ছাড়া এই ধরণির গাছগাছালি, সবুজের সমারোহ, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা রূপ, জীববৈচিত্র্য কোনো কিছুই কল্পনা করা যায় না। সেই পানি যদি পৃথিবীতে দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায় তাহলে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনা করাও কঠিন হবে। মূলত মিঠা পানি আর লোনা পানির সমন্বয়েই পানির জগৎ। পৃথিবীর মধ্যে তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। অর্থাৎ স্থল ভাগের চেয়ে তিনগুণ এলাকাজুড়েই আছে পানি। তবুও মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় পানির বড়ই সংকট। কারণ স্থলের তুলনায় তিন ভাগ পানি থাকলেও মিঠা পানির চেয়ে লোনা পানির পরিমাণ অনেক বেশি। আর মিঠা পানিই মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীতে উষ্ণতা বাড়ছে। দিন দিন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে আসছে। আর হুহু করে মানুষ বাড়ার কারণে পানির চাহিদাও বাড়ছে। বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ায় মানুষের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণও বাড়ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও তরতর করে কমে যাচ্ছে। এ কারণে তৈরি হচ্ছে পানির সংকট। এ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই তীব্র হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ডব্লিউআরআই’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাতার, ইসরাইল, লেবানন, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, কুয়েত, সৌদি আরব, ইরিত্রিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সানমেরিনো, বাহারাইন, ভারত, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, ওমান ও বসনিয়ায় তীব্র পানির সংকট বিরাজ করছে। এসব দেশে কৃষি, শিল্প এবং মানুষের খাবারের জন্য সারা বছর ভূগর্ভস্থ ও ভূ-উপরিস্থ পানির ৮০ ভাগ পানিই ব্যবহার হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুম এলে পানির চাহিদা বাড়ে। ফলে পানির সংকট দেখা দেয়।

সূত্রমতে, পানি নিয়ে সব থেকে বেশি সমস্যায় পড়েছে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার ১২টি দেশ। এর পরের ১৩তম অবস্থানে রয়েছে ভারত। পানি সমস্যায় থাকা অন্য দেশগুলোর চেয়ে ভারতের জনসংখ্যা তিনগুণ বেশি। উল্লিখিত দেশগুলোর বাইরে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেও পানি সংকট আছে। যদিও পানি সংকটে থাকা বিশ্বের মোট তালিকার মধ্যে ৭১তম অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র (সূত্র : দৈনিক মানবকণ্ঠ তাং ১৮/০৮/১৯ ইং)। অতিসম্প্রতি জাতীয় এক দৈনিকে ‘পানি সংকটে বিশ্বের ৫০ কোটি মানুষ’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। ওই খবর যে উদ্বেগের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই খবরে বলা হয়, গোটা বিশ্বেই চলছে পানির সংকট। বিশ্লেষকদের মতে, বছরজুড়ে বিশ্বের অন্তত ৫০ কোটি মানুষ প্রচণ্ড পানির সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রায় ৪ কোটির ওপরে মানুষ পানির সংকটে রয়েছে। মূলত মানবসৃষ্ট বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের পানি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি। ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের পানির সংকটের বাস্তবচিত্র। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পানি সংকটের এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই অঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেবে। আর এ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে পানির চাহিদা বাড়বে প্রায় ৫৫ ভাগ। সহজেই অনুমেয়, একদিকে পানির সংকট বাড়বে, অন্যদিকে মানুষ বৃদ্ধির কারণে পানির চাহিদাও বাড়বে। ফলে পানির যে তীব্র সংকট হবে, যা অনেকটাই নিশ্চিত করে বলা যায়।

তাই একটি সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন বৃষ্টি ও বন্যার পানি ধারণ করতে হবে। নদ-নদীর পানি সংরক্ষণ করে পরিশোধন করে ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে বন্ধ করতে হবে। এমনকি সমুদ্রের লোনা পানিকেও পরিশোধন করে ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য প্রতিটি দেশকে পানি খাতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করে গবেষণা বাড়ানোর পাশাপাশি নদ-নদী ও লোনা পানিকে খাবার উপযোগী করতে হবে। তা না করতে পারলে নিকট ভবিষ্যতেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেঁচে থাকার নিয়ামক পানি সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশেষ করে খোদ রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত প্রায় অর্ধেক মানুষ নিরাপদ পানি পান করতে পারেন না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে দৈনিক বিশুদ্ধ পানির চাহিদা ২৩০ থেকে ২৩৫ কোটি লিটার। এর মধ্যে ১৭০ কোটি লিটার পানি তোলা হয় ওয়াসার গাড়ির নলকূপ থেকে। বাকি প্রায় ৬০ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হয় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার ৫টি পানি শোধনাগারে শোধন করে। নদ-নদীর পানি পরিশোধন করে ব্যবহারের উপযোগী আরো বেশি করে করতে হবে। তাহলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমে আসবে। আর ঢাকা শহরে বসবাসরত মানুষকে বাঁচতে হলে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমাতে হবেই। বিএডিসির গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সমুদ্রের লোনা পানি ঢাকার ভূগর্ভে প্রবেশ করবে। আর ঢাকার ভূগর্ভে সমুদ্রের লোনা পানিতে পূর্ণ হলে পানির অভাবে মেগাসিটির ২ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে। সময় থাকতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তা না হলে এমন একদিন আসবে, যেদিন ঢাকা ও এর আশপাশে ভূগর্ভস্থ মিঠা পানির বদলে লোনা পানিই উঠে আসবে।

আবার দেশের উত্তরাঞ্চলের অবস্থাও ভয়াবহ। মাত্রাতিরিক্ত সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলনের কারণে পানির স্তর ইতোমধ্যে নিচে নেমে গেছে। এখন উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় কৃষি চাষাবাদে সেচ দিতে ৮/১০ ফুট পর্যন্ত জমিতে গর্ত করে নিচে সেচ যন্ত্র বসিয়ে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। বিশেষ করে উজান থেকে একতরফাভাবে পানি আটক করায় শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। এজন্য তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা এখন অতীব প্রয়োজন। উজানের পানি স্বাভাবিকভাবে না পাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ওপর চাপও বাড়ছে। ফলে পানির স্তর প্রতিনিয়তই নিচে নামছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বর্ষাকালে বৃষ্টি ও বন্যার পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি ছোটবড় নদ-নদী সংস্কার করতে হবে। আর বড় বড় নদীকে ড্রেজিংয়ের আওতায় এনে গভীর করতে হবে। যেন বন্যার পানি ধরে রেখে লো-লিপ পাম্প বসিয়ে নদীর দুপ্রান্ত থেকে পানি তুলে সেচকার্য চালানো যায়। তাহলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অনেকাংশেই চাপ কমে আসবে। অর্থাৎ সমন্বিতভাবে কার্য-পরিকল্পনা গ্রহণ করে পানির সংকট রোধ করতে না পারলে নিকট ভবিষ্যতেই উত্তরাঞ্চলসহ গোটা দেশেই খাবার ও সেচের পানির তীব্র সংকটে পড়তে হবে।

অতিসম্প্রতি জাতীয় এক দৈনিকে ‘৯ বছরেও মেলেনি বিশুদ্ধ পানি’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। ওই খবরে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে রাজশাহী ওয়াসা। উল্লেখ্য, ১৯৮৮ সালে রাজশাহী সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে সিটি করপোরেশনই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নগরবাসীকে পানি সরবরাহ করে আসত। কিন্তু ২০১১ সালে রাজশাহী ওয়াসা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও গত ৯ বছরেও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে পারেননি। রাজশাহী শহরে ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে অতিমাত্রায় আয়রন থাকায় বেকায়দায় পড়েছে নগরবাসী। একই সঙ্গে পানিতে রয়েছে অতিমাত্রার ম্যাঙ্গানিজ ও হার্ডনেস। ফলে এই পানি ব্যবহার করায় চর্মরোগসহ রোগবালাইও ছড়াচ্ছে। আবার ওয়াসার পাইপলাইনে সরবরাহ করা পানিতে গোসল করলে অতিরিক্ত আয়রনের কারণে চুলও আঠালো হয়ে যাচ্ছে। এমনকি অতিমাত্রায় আয়রনের কারণে পাত্রের রংও লালচে হয়ে যাচ্ছে। ফলে ওয়াসার পানি নিয়ে রাজশাহী নগরবাসীর অভিযোগের শেষ নেই।

রাজশাহী ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে দৈনিক পানির চাহিদা ১১ কোটি ৩৩ লাখ লিটার। এর মধ্যে ৯৩ দশমিক ৬৮ শতাংশ পাওয়া যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে। বাকি ৬ শতাংশ পানির জোগান আসছে পদ্মা নদীর শোধনাগার থেকে। আমরা মনে করি, পদ্মার পানি পরিশোধনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা উচিত। আর এমনিতেই বরেন্দ্র অঞ্চল হওয়ায় এখানকার পানির স্তর অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি গভীরে। সংগত কারণেই ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়া জরুরি।

এমতাবস্থায় জীবন রক্ষাকারী পানির ব্যবহারে আমাদের অতিমাত্রায় সচেতন হতে হবে এবং পানির অপচয় রোধ করতে হবে। কারণ পানি অফুরন্ত নয়। একদিন পানিও শেষ হয়ে আসবে। এজন্য ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের পথেই আমাদের হাঁটতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে পানির সংকট মোকাবেলা করা অনেকাংশেই কঠিন হবে। পানি বিশেষজ্ঞরা জানান, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন এখন জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি মানবাধিকার। তথ্য উপাত্ত অনুসারে এখনো বিশ্বের প্রায় ৯০ কোটি মানুষ নিরাপদ পানি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে সৃষ্ট রোগব্যাধিতে প্রতি বছর বিশ্বে পাঁচ বছরের কমবয়সী ১৫ লাখ শিশু মারা যায়।

তবে সমস্যা গভীর হলেও এর সমাধানে সরকার এসডিজির নির্ধারিত সময়সীমা ২০৩০ সালের আগেই সবার জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ২০২১ সাল নাগাদ বিভাগীয় শহরগুলোতে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থিত নিরাপদ পানি সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিরাপদ পানি ব্যবস্থাপনায় লবণাক্ত এলাকার সাত হাজার পুকুরের পানি পরিশোধন করে লবণাক্ততামুক্ত করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে ৩২ হাজার ৬০০টি গভীর নলকূপ খনন করা হয়েছে। বর্ষায় পানি সংরক্ষণে ৪ হাজার ৭০০টি জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে। এসবই বর্তমান বিশ্বে পানি স্বল্পতার ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক খবর। আমরা মনে করি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশবাসী সুপেয় পানির পাশাপাশি নিরাপদ পানির অংশীদার হয়ে উঠবেন।

 

লেখক : সমাজকর্মী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads