• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

সম্পাদকীয়

রাসেল বেঁচে আছেন বাঙালির ভালোবাসার ক্যানভাসে

  • আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর ২০১৯

১৯৬৪ সালের কার্তিকের এক নিশুতি রাত। আকাশে হয়তো চাঁদ ছিল। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে সে রাতটি ছিল ১৮ অক্টোবর। নগরীর প্রায় সব বাড়িতে ঘুমের নিস্তব্ধতা। স্ট্রিটলাইটগুলো পিচঢালা ফাঁকা রাস্তায় আলো ছড়িয়ে যাচ্ছিল। সেই রাতে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আলো জ্বলছিল। কারো চোখে ঘুম নেই। বাড়ির সবাই কান পেতে রয়েছেন নতুন শিশুর মধুময় কান্নার শব্দ শোনার জন্য। মাতৃগর্ভের বেহেশত থেকে নেমে এসে তিনি চিৎকার করে পৃথিবীকে জানিয়ে দেবেন, আমি এসেছি। আমাকে দাও তোমাদের ভালোবাসা। এবং তিনি এলেন গভীর রাতে। তিনি কেঁদে উঠলেন আর  হাসির ঝরনাধারায় ঝলমল করে উঠল বত্রিশ নম্বরের সেই বাড়িটি। পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছেলের নাম রাখলেন রাসেল। কালজয়ী ইংরেজ দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে সন্তানের এই নাম দেন তিনি। নোবেল লরিয়েট বারট্রান্ড রাসেলের শান্তিবাদী জীবনদর্শন দারুণভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রভাবিত করেছিল। রাসেল বিশ্বাস করতেন, উইজডম তথা প্রজ্ঞার প্রথম দরজাটি হচ্ছে ভয়কে জয় করা। যে ভয়কে জয় করতে না পারে, তার পক্ষে প্রজ্ঞাবান হয়ে ওঠা সম্ভবপর নয়। শেখ মুজিব নিজে  নিঃসন্দেহে জয় করতে পেরেছিলেন সব ভয়। জেল-জুলুম এবং দুঃশাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবন বাজি রেখে তিনি পাড়ি দেন সংগ্রামসংকুল কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ। সেই পথ ধরে তিনি আরোহণ করেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার সিংহাসনে। তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। জন্ম হলো একটি জাতির। আর তিনিই হলেন সেই জাতির মহান পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

শেখ রাসেল, শেখ জামাল, শেখ কামাল, শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনার মহান পিতা বিরাট-বিশাল মহীরুহ হয়ে উঠলেন, মহান জাতির সুমহান জনক হলেন। বঙ্গবন্ধু তার এই কনিষ্ঠ সন্তানের মধ্যে নির্ভয়-সুন্দর স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন রাসেল নাম দিয়ে। ছোট্ট রাসেল সেভাবেই বেড়ে উঠছিলেন। জন্মের পর খুব কম সময়ই তিনি পিতার সান্নিধ্য পেয়েছেন। কারাগারেই কেটেছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের বেশিরভাগ সময়। শিশু রাসেল যখন দুই বছরের, তখনো শেখ মুজিব বন্দি আইয়ুব খানের জেলখানায়।  শিশু শেখ রাসেল জেলখানা আর নিজের বাড়ির মধ্যে কী ব্যবধান সেটা বুঝতেন না। বোঝার কথাও নয়। তিনি মনে করতেন ওই জেলাখানাটাই পিতার আরেকটি বাসা। সবাইকে ধানমন্ডির বাসায় রেখে তিনি কেন থাকবেন অন্য বাসায়! ফেব্রুয়ারি মাসের একদিন বাসার সবার সঙ্গে রাসেলও জেলখানায় গিয়েছিলেন আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। রাসেল বাবার হাত ধরে টেনে আধো আধো বোলে বলেছিলেন, বাবা বালি (বাড়ি) চলো। সেদিন পিতার বুকের ভেতর হু হু করে উঠেছিল নিশ্চয়ই। ছলছল করে উঠেছিল চোখ। পাশে যারা ছিলেন, তারাও কান্না চেপে রেখেছিলেন পাষাণ পাথরে।

পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছে রাসেল ছিলেন সাত রাজার ধন। দুই ভাই, দুই বোন চোখে চোখে রাখতেন ছোট এই ভাইটিকে। কোলে তুলে আদরে সোহাগে ছোট ভাইটির মন ভরিয়ে রাখতে চাইতেন তারা। ভাইবোনদের হূদয়জুড়ে ছিল রাসেলকে নিয়ে আনন্দের নিত্য সমীরণ। শেখ হাসিনা-শেখ রেহানা ভাইকে কোলে নিতেন খুব সাবধানে।  ভয় পেতেন; যদি পড়ে যায়! কোল থেকে নামাতেও মন চাইত না। হাসু আপার প্রতি রাসেলের টানটা বুঝিবা আরো একটুখানি বেশিই ছিল। ঘাতকের দল যখন সামনে এসে দাঁড়ালো, তখন রাসেল বলেছিলেন, আমাকে আমার হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দাও। সেই সঙ্গে রাসেল চেয়েছিল মায়ের কাছে যেতে। হাসুর মধ্যে নিষ্পাপ রাসেল নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছিলেন মায়ের ছায়া। রাসেলের খুব পছন্দ ছিল শান্তির পায়রা। বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়ির ছাদে অনেক কবুতর ছিল। পালিত পায়রাগুলো ছিল রাসেলের প্রিয় বন্ধু। এদের খাবার দিতেন, পানি দিতেন। তিনি খুশি হতেন পায়রার উড়াল দেখে। স্কুলের শিক্ষক- সহপাঠীদেরও খুব প্রিয় ছিলেন রাসেল।

যে রাতে রাসেলের জন্ম হলো, হয়তো নরকের আগুন থেকে পালিয়ে সে রাতেই পৃথিবীতে নেমে এসেছিল বিশ্বাসঘাতক মিরণ, মীরজাফর, মোহাম্মদী বেগ, এয়াজিদ-সীমারের প্রেতাত্মা। সংগোপনে এরা বাসা বেঁধেছিল ১৫ আগস্টের ঘাতকদের অন্তরের ভাগাড়ে। এদের লুকিয়ে থাকা সহজ হয়েছিল, কারণ বাইরে দেখতে এরা ছিল মানুষেরই মতো, কিন্তু মানুষ ছিল না। এরা লুকিয়ে ছিল বছরের পর বছর আবারো একদিন মানবতার বক্ষ বিদীর্ণ করবে বলে। বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে ব্যস্ত, বিশ্বসমাজ যখন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল বাংলাদেশের দিকে, বাংলাদেশ যুদ্ধের ক্ষত ও ক্ষতি বিমোচন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য যখন প্রস্তুত হলো, ঠিক তখন আঘাত হানলো বিশ্বাসঘাতকের দল  মুশতাক, ফারুক, রশীদ ও ডালিমসহ  একদল নরপিশাচের বেশে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে এরা হামলা চালালো বত্রিশ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনে। এরা নির্দয়ভাবে হত্যা করল পিতাকে, মাতাকে। খুন করল শেখ কামাল, শেখ জামাল ও দুই ভাইয়ের নব পরিণীতা বধূদের। জাতির পিতা ও তার স্বজন-পরিজনের পবিত্র রক্তে ভেসে গেল বত্রিশ নম্বরের বাড়ি।  ধানমন্ডির লেকের পাড়ের গাছ-গাছালিও হয়তোবা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। বুলেটের কর্ণবিদারি গর্জনে থেমে যায় ভোরের দোয়েল শ্যামার কলকাকলি।  ছোট রাসেলকে নিয়ে আসা হয়েছিল বাড়ির গেটে পুলিশ বক্সে। উদ্ধত বন্দুক নিয়ে ঘাতক এসে রাসেলকে ধরল। নিষ্পাপ শিশুটি তখন বললেন, আমি আমার মায়ের কাছে যাব। মা কোথায় আমার। পিশাচ ঘাতক বলল, এসো তোমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাই। মায়ের কাছে নিয়ে গেল তারা শেখ রাসেলকে, যেখানে রক্তের বিছানায় শুয়েছিলেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা। সেখানে দাঁড় করিয়ে ওরা গুলি চালালো মাসুম শিশু রাসেলের ছোট বুকে। সেদিন সেই মুহূর্তে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু ভবনের ছাদে খোপের ভেতর শান্তির পায়রাগুলো ছটফট করছিল।

আজ শেখ রাসেলের জন্মদিন। এগারো বছরে পা দিয়েছিলেন শেখ রাসেল। রাসেল নেই। তাকে হত্যা করা হয়েছে ১৫ আগস্টের প্রত্যুষে। তিনি শাহাদত বরণ করেছেন পিতা মাতা ভাই ও স্বজনদের সঙ্গে। বেঁচে থাকলে রাসেল আজ পা দিত ৫৬ বছরে। মেধাবী রাসেল হয়তো দায়িত্বে থাকতেন দেশ ও জাতির সেবায়। রাসেলের মুখের দিকে তাকাতেই জাতির পিতার গোটা মুখচ্ছবি আমাদের সামনে ভেসে উঠত। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ একজন বাঙালি, ব্যাক ব্রাশ করা চুল, সফেদ সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামায় আবৃত গোটা শরীর। চিকন কালো রঙের মুজিব কোর্ট-কাঁঠালচাঁপা রঙের শাল গলায় জড়ানো। রাসেলের কোমল হাতের ইশারায় ভেসে আসত বঙ্গবন্ধুর সেই শাহাদাত আঙুল, যার দোলায় হেমিলনের বংশীবাদকের মতো বাংলার মানুষ কখনো রেসকোর্সে, কখনো পল্টন ময়দানে, কখনো আরমানিটোলার মাঠে, আবার কখনো বাহাদুর শাহ পার্কে ওঠবস করত। আনন্দে আন্দোলিত হতো, দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গর্জে উঠত বাঘের মতো। শেখ রাসেলের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে আমরা বঙ্গবন্ধুর গন্ধ পেতাম। রাসেলের শিরায় শিরায় ধমনিতে আমরা শুনতে পেতাম প্রাণাবেগ, প্রাণস্পন্দন। কিন্তু ঘাতকের কালো মেশিনগানের থাবার নিচে রাসেলের জীবনের সেই সুখ-সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ইতিহাসের কাঁটা নীরবে নিস্তব্ধে নিথর হয়ে পড়েছিল ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে। রাসেলকে শারীরিকভাবে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সরিয়ে দিয়েছে বটে, কিন্তু তাকে মারতে পারেনি। রাসেলদের মৃত্যু নেই, তারা মৃত্যুঞ্জয়ী।

রাসেল বেঁচে আছেন বাঙালির হূদয়ে, মানুষের ভালোবাসার ক্যানভাসে, যেমন করে চিরঞ্জীব হয়ে রয়েছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পিতা শেখ রাসেলের, তিনি জনক বাঙালি জাতির। তিনি যে আদর্শ রেখে গেছেন, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণের যে স্বপ্ন তিনি বুনে গেছেন, সেই স্বপ্ন আজ পূর্ণ হচ্ছে এক এক করে, শেখ রাসেলের হাসু আপার নেতৃত্বে। স্বাধীন-সার্বভৌম এবং উন্নত বাংলাদেশের পতাকা আজ সমুন্নত বিশ্বময়। শেখ রাসেলের জন্মদিনে কায়মনোবাক্যে তার শহীদী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা, বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্ট সব শহীদের আত্মার চিরশান্তি।   

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads