• মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪২৮
মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান

মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনী

ছবি : এএফডি ওয়েবসাইট

সম্পাদকীয়

মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান

  • বাংলাদেশের খবর
  • প্রকাশিত ২১ নভেম্বর ২০১৯

মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর আগ্রাসনের প্রাথমিক প্রতিরোধে সেনাবাহিনীর অনন্যসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী এটি সংগঠিত করে। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনের অবস্থান ছিল পূর্ব পাকিস্তানে। এ ডিভিশনের ব্রিগেডসমূহের অধীনে ৫টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ছিল। যার মধ্যে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যশোর সেনানিবাসে, ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুর রাজবাড়ীতে, ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাসে, ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিল্লা সেনানিবাসে এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকায় অবস্থান করছিল।

অপারেশন সার্চ লাইটের গুপ্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঙালিদের ওপর আক্রমণ হলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসমূহ সংঘবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে- এ আশঙ্কায় নানা অজুহাতে মার্চের শুরু থেকেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু দেশব্যাপী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে বাঙালি সেনা সদস্যরা স্থানীয় জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক নেতাদের সংস্পর্শে এসে যে যেখানে ছিল সেখান থেকেই সাধারণ জনতাকে নিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালি সেনাদের প্রতিরোধের বিষয়ে যথার্থই বলা হয়েছে যে এই পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা যদি প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতেন, তবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস ভিন্ন হতো। বাঙালি সেনাদের এ বিদ্রোহ ছিল স্বতঃপ্রণোদিত ও স্বতঃস্ফূর্ত। যুদ্ধের প্রথমদিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালি ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদদের মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকলেও ধীরে ধীরে এসব বাহিনী নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নিজেদের মধ্যে এই যোগাযোগ রক্ষায় সেনা সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমগ্র বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেক সেক্টরের এলাকা ও দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, সীমিত সংখ্যক স্টাফ, অনুন্নত যোগাযোগ মাধ্যম, সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বৈচিত্র্যের কারণে কার্যকর যুদ্ধের প্রয়োজনেই সমগ্র বাংলাদেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করা প্রয়োজন ছিল। ১৯৭১ সালের ১২ জুলাই সকল কমান্ডারদের উপস্থিতিতে সেক্টরের বিভিন্ন এলাকা ও দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়। এই সেক্টরসমূহের সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যে প্রভূত ভূমিকা পালন করেছিল। প্রকৃতপক্ষে সেদিন সংশ্লিষ্ট সবাই এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি প্রচলিত যুদ্ধের জন্যও আমাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতি প্রয়োজন। কেননা গেরিলা যুদ্ধ কোনো প্রচলিত যুদ্ধের বিকল্প নয়। কাজেই একটি নিয়মিত জাতীয় সেনাবাহিনী গঠন করা ছিল অত্যাবশ্যক।

মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানীর পরিকল্পনা ছিল- নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের মাধ্যমে সীমান্তের নিকটবর্তী একটি নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা, ভারতকে নিয়ে সমন্বিত আক্রমণ হলে পুরোভাগে বাংলাদেশের একটি নিয়মিত ব্রিগেড রাখা এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে সুসংগঠিতভাবে সেনাবাহিনীকে সম্প্রসারিত করা। এসব চিন্তা-ভাবনা থেকে ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই জেনারেল ওসমানী ১ আর্টিলারি ব্রিগেড নামে একটি ব্রিগেড গঠন করেন। পরে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তরে দীর্ঘ ১০ দিনব্যাপী সব সেক্টর কমান্ডারের সমন্বয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত বাহিনী কর্তৃক অব্যাহতভাবে পাকিস্তানি অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী জেনারেল ওসমানী আরো ৩টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ঊর্ধ্বতন ৩ জন সামরিক কর্মকর্তা লে. কর্নেল জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল কে এম সফিউলাহ এবং লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের নামের ইংরেজি আদ্যাক্ষর দিয়ে ব্রিগেড ৩টির নামকরণ করা হয় ‘জেড ফোর্স’, ‘এস’ ফোর্স এবং ‘কে’ ফোর্স। এই ফোর্সগুলো স্ব-স্ব দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে জাতির বিজয় ত্বরান্বিত ও নিশ্চিত করেছেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী ত্যাগ করে মোট ১৩১ জন অফিসার মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৫৮ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ভারতের মূর্তি অফিসার প্রশিক্ষণ একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করে যুদ্ধে যোগদান করেন। এই কোর্স-কে প্রথম বাংলাদেশ শর্ট সার্ভিস কোর্স বলা হয়। ৬৭ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাকে দ্বিতীয় শর্ট সার্ভিস কোর্সে ভর্তি করা হয় এবং ১৯৭২ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে ১৩ জন সামরিক অফিসার যুদ্ধ অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন। ৪৩ জন সামরিক অফিসারকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ এবং তার কয়েকদিনের মধ্যে হত্যা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৩ জনকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এছাড়া ৪ জনকে বীরউত্তম, ৮৯ জনকে বীরবিক্রম এবং ১৫৯ জনকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads