• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

সম্পাদকীয়

প্রসঙ্গ আমেরিকার নির্বাচন

  • প্রকাশিত ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

রায়হান আহমেদ তপাদার

 

ব্রিটেনের নির্বাচনের পর এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব। আগামী বছর সেই মহারণ। কেননা বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের অন্যতম শক্তি যুক্তরাষ্ট্র। আর তার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নানাভাবে বিশ্ববাসীর কাছে আলোচিত-সমালোচিত। সেদিক বিবেচনায় আগামী বছরে যুক্তরাষ্ট্রে হতে যাওয়া নির্বাচন গুরুত্ব বহন করছে। কিন্তু কীভাবে নির্বাচিত হন এই ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট? এই পদ্ধতিটি নিশ্চয়ই সুচারু হওয়াটা জরুরি। কারণ আমেরিকার সরকার ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অনেক। তিনি একই সঙ্গে দেশটির সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রধান ও সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ। কংগ্রেসের যে কোনো আইনকে অনুমোদন ও বাতিল করার ক্ষমতা রয়েছে তার। মন্ত্রিসভা গঠন এবং উপদেষ্টা নিয়োগেও রয়েছে একচ্ছত্র ক্ষমতা। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক ও রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেন তিনিই। এমন ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পদ্ধতিটি খুবই জটিল। অনেকেই মনে করেন প্রেসিডেন্ট বুঝি সরাসরি ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হন। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রয়েছে বেশ কয়েকটি ধাপ।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে প্রথমে দলীয় মনোনয়ন জিতে নিতে হয় প্রার্থীকে। আর এই মনোনয়ন পেতেও প্রচারণা চালাতে হয় তাদের। দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করার পদ্ধতিতে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সাধারণত কনভেনশনের মাধ্যমেই দলগুলো তাদের প্রার্থী নির্ধারণ করে থাকে। প্রথমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে ইচ্ছুক প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়নের জন্য নিজেদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। আমেরিকান জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত এক গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টসিয়াল প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়ায় জনগণের ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণের পরিসর বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বিংশ শতকে প্রাইমারি ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল। প্রাইমারিতে দলের রেজিস্টার্ড ভোটাররা অংশ নিয়ে গোপন ব্যালটে ভোট দিয়ে তাদের পছন্দের প্রার্থী বাছাই করে থাকে।

আর চূড়ান্ত প্রার্থী বাছাই করা হয় দলীয় সম্মেলন বা কনভেনশনে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও মূলত ডেমোক্রিটক ও রিপাবলিকান দলের মধ্যে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বিধায় এ দুটি দলের প্রতিই সারা বিশ্বের সচেতন মানুষের দৃষ্টি নিবন্ধিত। তাই স্বাভাবিকভাবেই এ দুটি দলের জাতীয় কনভেনশনের প্রতি আগ্রহ। কারণ, জাতীয় কনভেনশনেই দলের প্রার্থীর নাম চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হবে। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে ২০২০ সালের ১৩-১৬ জুলাইয়ের উইসকনসিনের মিলওয়াকি ফিশারভ ফোরামে। বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার আমেরিকার প্রধান নির্বাহী প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচন ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে মর্মে ঘোষণা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় নির্বাচন বিধি অনুযায়ী প্রতি চার বছর অন্তর নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরে প্রথম মঙ্গলবার দেশটার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ২০২০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩ নভেম্বর যেমনটা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমেরিকান সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী হতে হলে অবশ্যই প্রার্থীকে আমেরিকার প্রাকৃতিক বংশোদ্ভূত নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর হতে হবে। অবশ্যই তাকে ১৪ বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করতে হবে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মনোনয়নের জন্য প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে প্রত্যেকটা রাজ্যে প্রেসিডেন্টসিয়াল প্রাথমিক নির্বাচন বা ককাস অনুষ্ঠিত হয়। কিছু রাজ্যে কেবল প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কয়েকটায় কেবল ককাস এবং অন্যরা উভয়ের সংমিশ্রণ ব্যবহার করে।

কিন্তু প্রাথমিক এবং ককাসের মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। প্রাথমিক নির্বাচনগুলো রাজ্য ও স্থানীয় সরকারগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। আর ককাসগুলো সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়। রাজ্য সরকারগুলো শরৎকালে প্রাথমিক নির্বাচনগুলোর আয়োজন করে। রাজ্যের ভোটাররা ভোট কেন্দ্রে গিয়ে প্রার্থীর পক্ষে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচন প্রক্রিয়া অনেক জটিল ও দীর্ঘ। ২০২০ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখ মঙ্গলবারে নির্বাচন অনুষ্ঠান নির্ধারিত হওয়ায় চলতি সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে। দেশটাতে স্বতন্ত্রসহ কয়েকটা রাজনৈতিক দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে থাকে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের; অর্থাৎ রিপাবলিকান পার্টি ও ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীদের মধ্যে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য কয়েকটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ প্রক্রিয়াগুলো হলো- নির্বাচনের আগের বছরের বসন্তে প্রার্থীরা, যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বদ্বিতা করতে ইচ্ছুক তারা তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন। নির্বাচন কমিশনে প্রার্থিতার বিষয়ে ঘোষণাপত্র জমা দেবেন। নির্বাচনী বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালে রাজ্য ও দলগুলো প্রাইমারি ও ককাস-এর আয়োজন করে। প্রাইমারি ও ককাস শেষে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দলগুলো তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করতে দলের জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে এবং এই সম্মেলন থেকেই দিনগুলো তাদের প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে থাকে।

সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবর এ সময়কালে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা প্রেসিডেন্টসিয়াল বিতর্কে অংশগ্রহণ করেন। অপরদিকে ককাসে দলীয় সদস্যরা একটা সভায় মিলিত হয়ে বিস্তৃত আলোচনা ও বিতর্ক শেষে জাতীয় সম্মেলনে কোন ব্যক্তি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবেন তা নির্ধারণ করার জন্য একটা আনুষ্ঠানিক ভোটের আয়োজন করা হয় এবং ভোটের দ্বারা প্রতিনিধি নির্ধারণ করা হয়। প্রাথমিক এবং ককাসগুলো আবার চার ধরনের। যেমন— সম্পূর্ণ খোলা, বন্ধ, আধা-খোলা এবং আধা-বন্ধ। প্রতিটা রাজ্যকে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এর মধ্যে কোন ধরনের পদ্ধতি সে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। ওপেন বা সম্পূর্ণ খোলা প্রাইমারি ও ককাসগুলোতে কোনো দলীয় প্রতিযোগিতায় দলীয় সদস্য নির্বিশেষে সমস্ত নিবন্ধিত ভোটারদের ভোটাধিকার মঞ্জুর করা হয়। বন্ধ প্রাইমারি ও ককাসগুলোর জন্য সেই দলের প্রার্থীদের ভোট দিতে ইচ্ছুক যে দলের সদস্য হিসেবে তিনি নিবন্ধিত, তাকে ভোটাধিকার দেওয়া হয়। অন্যদিকে রিপাবলিকান দলের জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে ২৪-২৭ আগস্টে উত্তর ক্যারোলিয়ান শার্লোটে স্পেকট্রাম সেন্টারে। জাতীয় কনভেনশনের পূর্বে প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। এ তারিখে প্রথম ককাস ও প্রথম প্রাইমারি অনুষ্ঠিত হবে, যথাক্রমে আইওয়া এবং নিউহ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যে। রাজনৈতিক দলগুলোর জাতীয় কনভেনশনে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পরে সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়কালে পর পর তিনটা এলাকার তিনটা প্রেসিডেন্টসিয়াল বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। এ বিতর্কগুলো ভোটারদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে।

উল্লেখ্য, আমেরিকান সিনেটরের সদস্য সংখ্যা মোট ১০০, প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৪৩৫, মোট সংখ্যা হলো ৫৩৫ সদস্যের সমানসংখ্যক সদস্য বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্য নির্বাচিত হন এবং রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে তিনজন ইলেক্টোরাল সদস্য নির্বাচিত হন। কাজেই ইলেক্টোরাল সদস্য সংখ্যা হলো ৫৩৮। একজন প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে তাকে কমপক্ষে ২৭০ ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হবে। দল থেকে প্রার্থিতা নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনী প্রচারণার প্রাথমিক ধাপ হলো ককাস ও প্রাইমারি। আমেরিকার ৫০ অঙ্গরাজ্য ও টেরিটরির মধ্যে ১০ অঙ্গরাজ্যে এবং টেরিটরিতে ককাস এবং অন্যসব অঙ্গরাজ্যে প্রাইমারি অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আবার কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে ককাস ও প্রাইমারি উভয়ই হয়ে থাকে। ২০২০ সালের ৩ নভেম্বর আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এমনটাই প্রচারিত হয়েছে। তবে বিধান অনুযায়ী এদিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুুষ্ঠিত হয় না। মূলত এদিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য আমেরিকান ভোটাররা ইলেক্টোরাল কলেজের ৫৩৮ সদস্য নির্বাচন করে থাকেন। যেহেতু ইলেক্টোরাল কলেজের ফলাফলে কোন প্রার্থীর পক্ষে ২৭০ ডেলিগেট নির্বাচিত হয়েছেন তা জানা যায়। এর থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় কোন প্রার্থী প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়, এ কারণে ডেলিগেট নির্বাচনের দিনটাকেই প্রেসিডেট নির্বাচনের দিন গণ্য করা হয়ে থাকে। বিধান অনুযায়ী ৩ নভেম্বর ২০২০ সালে আমেরিকান ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য ৫৩৮ সদস্য ইলেক্টোরাল কলেজ নির্বাচন করবেন এবং ঐ ইলেক্টোরাল কলেজের নির্বাচিত ৫৩৮ সদস্য ১৯ ডিসেম্বর ২০২০ রাজধানী ওয়াশিংটনে ক্যাপিটাল হিলে মিলিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ভোট প্রদান করবেন।

আর ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি আমেরিকান বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন এবং ২০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। এভাবেই দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হয়ে থাকে। তবে প্রার্থী বাছাই ও মনোনয়ন সংক্রান্ত বিদ্যমান পদ্ধতি অবশ্য আমেরিকান সংবিধানে বর্ণিত কোনো বিধান দ্বারা নির্ধারণ করা হয়নি। বরং অঙ্গরাজ্যগুলোর দ্বারা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিধি-বিধান দ্বারা এ পদ্ধতি গৃহীত ও পর্যায়ক্রমে বিকশিত হয়েছে। বর্তমানে এ পদ্ধতি আমেরিকানদের দ্বারা সমাদৃত হয়েছে এবং পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা। কিন্তু ডেমোক্রেটিক নেতা ন্যান্সি পেলসি বলেছেন, আমেরিকার মানুষের প্রধান সমস্যা স্বাস্থ্য পরিচর্যা। এ বিষয় থেকে তাদের দৃষ্টি এড়াতে রিপাবলিকানরা অভিবাসন প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। ডেমোক্র্যাটরা জানিয়েছেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরে গেলে তাদের সর্বাগ্রধিকার হবে ট্রাম্প প্রশাসনের কবল থেকে স্বাস্থ্যবীমা রক্ষা। সর্বশেষ জাতীয় জরিপ অনুসারে ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন স্বাস্থ্যবীমা প্রশ্নে ডেমোক্র্যাটদের প্রতি তারা অধিক আস্থাবান। এই আস্থা তাদের জন্য নির্বাচনী বিজয়ে পরিণত হয় কি না, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

 

 

লেখক : বিশ্লেষক ও প্রবাসী লেখক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads